ডা. সামন্তলাল সেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা। পরিচয় না দিলেও এক নামেই তাকে দেশ-বিদেশের অনেকেই চেনেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের পোড়া রোগীদের কাছে তার পরিচয়, নতুন জীবন দাতা তিনি।
দেশের প্রথম বার্ন ইউনিটের যাত্রা শুরু হয় তার হাত ধরেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ বেডের ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই যাত্রা শুরু। তারপর কেবলই এগিয়ে চলা। দেশে এখন অনেক প্লাস্টিক সার্জন। ঢাকা মেডিকেলের সেই বার্ন ইউনিট এখন ৩০০ শয্যার। পোড়া রোগীদের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মূল সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করছেন সামন্তলাল সেন।
তবে এতদূরে পৌঁছানোর এ পথটা মোটেও মসৃন ছিল না তার জন্য। বলতে গেলে অনেকটা একাই যুদ্ধ করেছেন। ঘুরেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে, পিছু পিছু। শুনেছেন অনেক কটু কথাও। কিন্তু দমে যাননি। সার্জারি করে মানুষের চেহারা সুন্দর করে অনেক টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তারি জীবন শুরু করা সামন্তলাল সেনের এখন স্বপ্ন একটাই; বাংলাদেশের কোনো পোড়া রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান।
চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে এসব বিষয়ের পাশাপাশি বিশেষায়িত এ চিকিৎসাক্ষেত্র নিয়ে কথা বলেছেন প্রথিতযশা এ চিকিৎসক।
শুরুটা যেভাবে
নিজের কর্মজীবনের নাটকীয় শুরুর বর্ণনা সামন্তলাল সেন বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করি তখন আমার একদম খালি হাত ছিল। ইন্টার্নশিপ এবং গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করে ১৯৭৪ সালের ঢাকায় আসলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। তখন প্লাস্টিক সার্জারির কিছুই ছিল না। আমাকে একজন ডাক্তার বললেন, তুমি প্লাস্টিক সার্জারিতে জয়েন করো। আমার স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় প্লাস্টিক সার্জন হবো, আমার প্রচুর টাকা হবে। কারণ প্লাস্টিক সার্জনদের প্রচুর টাকা।
‘১৯৮০ সালে যখন আমি ঢাকা মেডিকেলে যোগ দিলাম, পোড়া রোগীদের দেখে আমার সব স্বপ্ন পরিবর্তন হয়ে গেল। যখন এখানে এলাম, দেখতাম পোড়া রোগীরা বারান্দায়, বাথরুমের পাশে, সিঁড়ির পাশে, যেখানে সেখানে পড়ে থাকতো। তাদের কোনো রকম যত্ন ছিল না, অযত্ন-অবহেলায় তাদের বেশিরভাই মারা যেত। তাদের বিছানা পর্যন্ত ছিল না। এগুলো দেখে আমি আমার সব স্বপ্ন ত্যাগ করলাম। তখন আমি চিন্তা করলাম, চেহারা সুন্দর করতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কয়জন আছে। বড় লোকের বউ, বড়লোকের মেয়ে বা কেউ মোটা থেকে চিকন হতে চায়, এই ধরনের। এটা হচ্ছে, যাদের প্রচুর অর্থ আছে, তাদের আলাদা একটা চাওয়া। কিন্তু মানুষকে বাঁচাতে হলে পোড়া রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। তখন আমি আমার সব স্বপ্ন ত্যাগ করে যুদ্ধ শুরু করি ১৯৮০ সাল থেকে।’
যাদের সহযোগিতা ছিল
তখন আমার সাথে ছিলেন অধ্যাপক কবির উদ্দিন সাহেব, জেনারেল সার্জন একজন এবং আমার সরাসরি শিক্ষক অধ্যাপক শহীদু্ল্লাহ স্যার। এই দুইজন ( কবির উদ্দিন এবং শহীদুল্লাহ) আমাকে বললেন, যে চলো আমরা কিছু একটা করি; মানুষের এত কষ্ট সহ্য করা যায় না।… আমরা অনেক, অনেক কষ্ট করেছি, যুদ্ধ করেছি…।
‘উনিতো ধান্দা করছেন, টাকা নিয়ে কলকাতা পালিয়ে যাবেন’
আজকে অনেকে আছে আমার সাথে আছে, আমার সঙ্গে যায়। কিন্তু তখন আমি গুলিস্তানে গিয়ে একা একটা টাইপ করতাম (বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়ার জন্য)। একা একা মানুষের পিছে পিছে ঘুরতাম। অনেকে অনেক কথা বলেছে। আমি এ ধরনের কথাও শুনেছি… উনিতো ধান্দা করছেন, টাকা নিয়ে কলকাতা পালিয়ে যাবেন। কিন্তু এখন আমার এসব কথা মনে হলে খুব ভালো লাগে… আমি ইন্ডিয়াতেও যাইনি, কোথাও যাবোও না। আমার বাবা-মা এদেশে মারা গেছেন আমিও এখানেই মারা যেতে চাই, এটাই আমার দেশ।
শুরু হয়েছে, শেষ হবে না
এই যুদ্ধ শুরু করে করে আমি তখন চিন্তা করছিলাম, আমি একা যদি অপারেশন করি, তবে কতগুলো করতে পারবো। মানুষেরেতো একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ৭০ বা ৮০ বছর পরে আমাকে থামতে হবেই। কিন্তু আমি যদি একটি জিনিস বানিয়ে রেখে যাই, তবে তা কিন্তু থামবে না, সারাজীবন চলবে। এই যে যারা এখন চালাচ্ছেন, এরাও একদিন হয়তো চলে যাবে, তখন আরেক গ্রুপ আসবে; মোট কথা যতদিন দেশ থাকবে ততদিন এই হাসপাতাল থাকবে।
অবদানের স্বীকারোক্তি
আমরা এখন ৫০০ বেডে যাচ্ছি। এখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অনেক অবদান। পোড়া রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তার অবদান যে অনেক এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ১৯৮৬ সালে তিনি একবার এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। তখনই তিনি আমাকে বলছিলেন এই রোগীদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। উনার কাছ থেকে আমি যতটা সাপোর্ট পেয়েছি, সেজন্য আমি পেরেছি। না হলে পারতাম না।
স্মরণে মা
আর আমার মা। তিনি খুব সাধারণ মহিলা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, বাবা, তুমি যদি সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করো, গরীব মানুষের জন্য কিছু করো, আমার আত্মা শান্তি পাবে। সেই জন্য আমি সবসময়ই চিন্তা করি, সাধারণ মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায়।
এই দেশে প্রতিবছর ৬ লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে যায়; বিভিন্ন কারণে। যারা পোড়ে তাদের বেশিরভাগই গরীব মানুষ। আর পোড়া রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যয়বহুল। আর গরীব মানুষের পক্ষে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করানো কোনদিনই সম্ভব হবে না। সুতরাং আমি মনে করি যে বড় হাসপাতালটা হচ্ছে, এটি হলে এদেশের বহু মানুষের উপকার হবে।
বাবার বলা অপ্তবাক্য এবং ডিসিপ্লিন
আমি একটি জিনিস মনে করি, বিশ্বাস করি, আর্লি টু বেড… গুড ফর হেলথ। আমি রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমিয়ে যাই, আবার ভোর পাঁচটার দিকে উঠি। কিছু পূজা অর্চনা আছে, সেগুলো করে আমি বের হই। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া, ঘুম থেকে উঠা এবং সময়টা নিয়ন্ত্রণ করে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার বাবা আমাকে বলতেন যে তুমি কাউকে অপেক্ষায় রাখবে না, দরকার হলে তুমি আগে গিয়ে বসে থাকবে। আমাকে যদি কেউ বিয়ের দাওয়াত দেয় তবে ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে আমি আগেই বের হই। যদি আগেই পৌঁছে যাই, তবে গাড়ির মধ্যেই বসে থাকি। ডিসিপ্লিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবং আমার স্ত্রী…
এই যে আমার যুদ্ধ, এত কিছুর পেছনে আমার স্ত্রীর অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ সে যদি আমাকে সাপোর্ট না দিত… আমার ছেলে-মেয়েরা বলতো, বাবাতো শুধু বার্ন বার্ন করেই শেষ হয়ে গেল… এমনকি আমি জানতামও না যে আমার ছেলে-মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে। এগুলো সব দেখাশো না করতো আমার বউ। তাই আমি সারাদিন রাত এখানে কাজ করতে পেরেছি। তাই আমি মনে করি, আমার এখানে আসার পেছনে আমার স্ত্রীর অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ আমার যদি ঘর ঠিক না থাকতো, তাহলে আমি বাইরে তো এত কাজ করতে পারতাম না। কারণ মনের শান্তি সবচেয় বড়।
বাংলাদেশের ডাক্তাররা বিশ্বজয় করতে পারে
আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের ডাক্তারদের দক্ষতা আছে। কিন্তু সুযোগ পায় না বলে সেটা তারা প্রমাণ করতে পারে না। যদি সুযোগ দেওয়া যায় বাংলাদেশের ডাক্তারদেরকে, তারা অনেক ভালো ভালো কাজ করবে। কারণ আপনি আজকে যদি ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জেতার চিন্তা করতে পারেন, তবে চিকিৎসায় কেন পারবেন না। সাবিক আল হাসান, মুশফিকতো বিদেশের কারও ছেলে না, এদেশেরই ছেলে, আপনার আমার মতই। সুতরাং ওরা যদি পারে তবে আমরা পারবো না কেন?
তরুণ ডাক্তারদের প্রতি
আমি এখন যেখানেই যাই, আমার তরুণ ডাক্তারদের ডাক দেই। কোনো মিটিং করতে গেলেই আমি বলি, আমার যারা দর্শক থাকবে, তারা ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী বা তরুণ ডাক্তার হয়। কারণ, এখন আমার তরুণদেরকেই বোঝাতে হবে। তাই তরুণ ডাক্তারদের প্রতি আমার একটাই আবেদন, যে ডাক্তাররা ওপরওয়ালার বিশেষ আশীর্বাদ নিয়ে জন্ম নেয়; টাকাও রোজগার করতে পারে, মানুষের ভালোবাসাও পায়। আমার আর জীবনে কী দরকার আছে বলেন, আমার দুইটা বাচ্চা, স্ত্রী, আমরা একটা ভালো বাসায় থাকি, একটা গাড়িতে চড়ি। এই শহরে কতজন লোকের বাচ্চাকাচ্চা গাড়িতে করে স্কুলে যায় বলেন। অনেকে তো দেখি ভ্যানে করেও যায়। কিন্তু আমাকে তো ওপরওয়ালা গাড়ি কেনার সামর্থ্য দিয়েছে। আর কী দরকার? আমার চারট বাড়ি হয়ে কী লাভ? আমি এক জায়গায় হাত রাখবো, এক জায়গায় পা রাখবো, এরকমতো না। আমি একটা ভালো বাসায় থাকতে পারি ঘুমোতে পারি এটুকুইতো যথেষ্ট। সুতরাং আমি আমার তরুণ ডাক্তারদের উদ্দেশ্য একটি কথাই বলবো, একটু দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসতে হবে, রোগীকে ভালোবাসতে হবে। বাংলাদেশের রোগীরা কিন্তু বেশি কিছু চায় না। এপ্রোন পড়ে গিয়ে যদি পিঠে হাত রেখে বলে আপনি কেমন আছেন, তাতেই অনেকে ভালো হয়ে যায়, আর কিচ্ছু লাগে না। ডাক্তার যদি একটু ভালো ব্যবহার করে, তাহলেই কিন্তু অনেকেই ভালো হয়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, পরবর্তী প্রজন্মের ডাক্তারা এরকম হবে। তারা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে।
রোগীদের প্রতি
রোগীর চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, প্রথম ২৪ ঘণ্টা হচ্ছে গোল্ডেন আওয়ার। ধরেন এখন পুড়লো, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তাকে বাঁচানো যায় না। রংপুরে যদি একটা গরীব মানুষ পুড়ে যায়, তাহলে ওর টাকা যোগার করতে করতেই তো এক সপ্তাহ লেগে যাবে। ঢাকায়তো সবাই আসতে পারে না। কারণ এখানে আসলে হাসপাতালে টাকা না লাগুক, থাকতে খেতে তো টাকা লাগে। কিন্তু আমি যদি রংপুরে একটা ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলেতো তাকে এত কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হবে না। এজন্যই এটিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
যে স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়
আমার স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। আমার স্বপ্ন বাংলাদেশের কোনো পোড়া রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। মারাতো যাবেই, সবাইকেই মারা যেতে হবে, কিন্তু ভালো চিকিৎসা পেয়ে যেন মারা যায়। একটা গরীব মানুষের মনে যেন এই আক্ষেপ না থাকে যে আমি আমার বাবাকে চিকিৎসা করাতে পারিনি। সবাই যেন মনে এইটুকু শান্তি রাখতে পারে যে, বাঁচাতে না পারলেও আমি চেষ্টা করেছিলাম।
যা নিয়ে ব্যস্ত আছি
বর্তামানে আমি চিকিৎসা কম করতে পারি কারণ আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে একটি দায়িত্ব দিয়েছেন, সারা দেশে বার্ন ইউনিটকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সেই লক্ষেই কাজ করছি। আশা করছি আগামী বছরের মাঝমাঝি থেকে সেখানে আমরা কাজ করতে পারবো। এটা প্রধানমন্ত্রীর নামে হচ্ছে, বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। বিল্ডিং ইতোমধ্যে অনেক দূর উঠে গেছে। যেভাবে কাজ এগুচ্ছে তাতে আমরা তাড়াতাড়িই কাজ শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি।