যেই পেঁয়াজগুলো আরো ১০ থেকে ১৫ দিন খেতে থাকলে পুষ্ট হতো বা আকারে বড় হতো সেই পেঁয়াজগুলোই এখন বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ঘাটতি মেটাতে আমদানি করা পেঁয়াজের পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে এই অপরিণত পেঁয়াজগুলো।
প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খেত থেকে পেঁয়াজ চুরি যাওয়ার আশঙ্কায় ও অতি মুনাফার আশায় তারা অপরিপক্ক পেঁয়াজ বেচে দিচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মাঝবাড়ি ইউনিয়নের খামারবাড়ি গ্রামের কৃষক জোনাব আলীর অন্তত ১০ শতাংশ জমির পেঁয়াজ চুরি হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ চুরি হয়ে যায়। এছাড়া দাম এখন বেশি। তাই বিক্রি করে দিচ্ছি।
কৃষকের অপরিপক্ক পেঁয়াজ বিক্রি করায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ধারণা, পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকার নিচে আর আসবে বলে মনে হয় না।
এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে ব্যবসায়ীরা বলেন, ভারত আগের মত হয়তো পেঁয়াজ দেবে না। দিলেও হয়তো বাড়তি দামে বাংলাদেশকে আমদানি করতে হবে। একই ঘটনা ঘটবে মিয়ানমারের সাথেও। সার্বিকভাবে বলা যায়, দেশে বর্তমানের চেয়ে উৎপাদন কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ লাখ টন বাড়ালে দাম হয়তো আগের অবস্থানে অর্থাৎ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় ফিরবে। অন্যথায় ৫০ থেকে ৭০ টাকার মতই দাম থাকবে।
তারা বলেন, এ বছর অত্যধিক দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা যথেষ্ট খুশি হয়েছেন। বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেক কৃষক অপরিণত অবস্থায় হাজার হাজার টন পেঁয়াজ তুলে ফেলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারওয়ান বাজার ও শ্যামবাজারের কয়েকজন পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলেন, ধরুন- সারা দেশ থেকে অপরিণত অবস্থায় ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ তোলা হয়েছে। এই পেঁয়াজগুলো যদি পরিপক্ক অবস্থায় তোলা হতো তাহলে এর পরিমাণ হতো প্রায় ৩ গুণ অর্থাৎ দেড় লাখ। তাহলে এখানেই ঘাটতি দাঁড়ালো ১ লাখ। এই ঘাটতি নতুন করে সৃষ্টি হলো। আগামী বছর এই ঘাটতি মেটাতে বাড়তি চাপে পড়তে হবে বাংলাদেশকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন, পেঁয়াজ এখনো বড় হয়নি। আরও অনেক বড় হওয়া দরকার। এই ছোট পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষকেরা। আমরা এটা নিয়ে শঙ্কিত। পেঁয়াজের উৎপাদন তো কমে যাবে। জানুয়ারি মাসে কী উপায় হবে!
তবে ব্যবসায়ীদের এসব যুক্তিকে উড়িয়ে দিলেন কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও গবেষকরা। তারা বলেন, এসব ব্যবসায়ীদের খোঁড়া যুক্তি। দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন।
তাছাড়া ভারত পেঁয়াজ দিবে না বা বেশি দাম নিবে-এসবের কোনো ভিত্তি নেই। ভারত রপ্তানিকারক দেশ, রপ্তানি করবেই। তবে দেশে উৎপাদন বাড়ানোটা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
পাবনা জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজহার আলী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পেঁয়াজের খুব বেশি ঘাটতি হবে না।
তিনি বলেন, সারা দেশের পেঁয়াজের ৪ ভাগের ১ ভাগই উৎপাদন হয় পাবনায়। গতবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৫ লাখ টন থাকলেও হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টন। কিন্তু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হওয়ার কারণে কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। এই বছর ৪৯ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদননের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৬ লাখ টনের বেশি।
আজহার আলী বলেন, এখন যেগুলো তোলা হচ্ছে সেগুলো মুড়িকাটা পেঁয়াজ। পাবনায় প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে এ ধরনের পেঁয়াজ চাষ করা হয়। দাম বেশি থাকায় কৃষকরা ছোট ছোট পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছে। তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে আরো ১০ থেকে ১৫ দিন পরে তোলার জন্য।
তিনি বলেন, অপরিণত অবমস্থায় তুলে ফেলায় উৎপাদনের পরিমাণ কিছু কম হলেও নতুন করে পেঁয়াজ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অতএব ছোট পেঁয়াজ তোলার কারণে ঘাটতি খুব বেশি হবে যে তা নয়।
প্রায় একই মতামত প্রকাশ করেন ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এখন যে পেঁয়াজগুলো তোলা হচ্ছে সেগুলো মুড়িকাটা জাতের পেঁয়াজ। এগুলো সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। নতুন অবস্থায় ব্যবহার হয়ে থাকে। এগুলো দুই মাসেই তোলা হয়। অতএব এসব পেঁয়াজ তোলার কারণে খুব বেশি সমস্যা হবে না।
কিন্তু গত ১০ থেকে ১৫ দিন আগে পাতাসহ যে পেঁয়াজগুলো তোলা হয়েছে সেগুলো মূলত আসল পেঁয়াজ না। সেগুলো অপরিণত অবস্থায় তোলা হয়েছে। এই পেঁয়াজগুলোর পরিমাণ যে খুব বেশি, তা নয়। তবে এগুলো পরিণত সময়ে তোলা হলে পরিমাণে আরো বেশি হতো বলে মনে করেন তিনি।
কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, এখনও পেঁয়াজের চারা লাগানো হচ্ছে। এগুলো উঠবে মার্চ-এপ্রিলের দিকে। এর আগ পর্যন্ত পর্যাক্রমে মুড়িকাটা পেঁয়াজগুলো উঠতে থাকে।
“তবে পেঁয়াজের কিছুটা ঘাটতি হতে পারে এমন আশঙ্কা যারা করছেন তা অমূলক নয়। যেহেতু অপরিপক্ক অবস্থায় দাম বেশি পাওয়ার আশায় পাতাসহ কিছু পেঁয়াজ তোলা হয়েছে সেক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি হতে পারে। এইজন্য কৃষকদের আরো বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উৎসাহ এবং পরামর্শ দিচ্ছি।”
ফরিদপুরে ৩৭ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ করা হচ্ছে। এই জমিতে ৪ লাখ ৬০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীদের যুক্তিগুলোকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ভারত পেঁয়াজ দিবে না বা দাম বেশি রাখবে এ ধরনের যুক্তি একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য। অতএব তারা রপ্তানি না করে কি পচাবে? বাংলাদেশ সব সময়ই ভারত থেকে আমদানি করে এটা নতুন কিছু নয়। তবে অপরিণত পেঁয়াজ তোলায় কিছুটা ঘাটতি হতে পারে বলে মনে করেন এই গবেষক।
“যে পেঁয়াজটা আমদানি করা হচ্ছে তা খুব সস্তা নয়। দেশি পেঁয়াজ পুরোপুরি বাজারে না আসা পর্যন্ত দাম আগের মত স্বাভাবিক নাও হতে পারে।”
নাজনীন আহমেদ বলেন: কৃষকরা চিন্তা করে মৌসুমের সময় পেঁয়াজের দাম কম থাকে। যেহেতু এখন দাম বেশি তাই অপরিণত হলেও বিক্রি করলে দাম বেশি পাওয়া যাবে। এ কারণে তারা বিক্রি করে দিচ্ছে।
“তবে এটা বলা যেতে পারে এখন যেভাবে চলছে পেঁয়াজের বাজার, যদি চাহিদামত সত্যিই উৎপাদন না হয়, তাহলে দামে কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে। পূর্ণ মৌসুমে দাম খুব বেশি না ও কমতে পারে। এজন্য সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি বলেন: যেহেতু বেশি মুনাফার আশায় আগেই পেঁয়াজ তুলে চাহিদা মেটানো হচ্ছে সেক্ষেত্রে ২০২০ সালে হয়তো জুলাই-আগস্টের দিকে পেঁয়াজের মজুদ কমে আসতে পারে। অন্যান্য বছর মৌসুমের পরে পেঁয়াজের সরবরাহ যতদিন থাকতো ২০২০ সালে কিন্তু ততদিন থাকবে না।
তাই আগেই হিসাব করে দেখতে হবে কত পরিমাণে উৎপাদন হয়েছে? মজুদ কী পরিমাণে রয়েছে? আর কী পরিমাণ আমদানি করতে হবে? সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে হবে। নতুবা আগামী বছরও সংকটে পড়তে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) সনৎ কুমার সাহা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কৃষকদের সাথে সরাসরি কথা বলেছি। তাদের চাহিদা মত সব ধরনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। উৎপাদনের জন্য নতুন জাতের পেঁয়াজ দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে অনেক কৃষক পেঁয়াজে লোকসান করেছে। ৫ থেকে ৮ টাকা দরে কেজি বিক্রি করেছে। কিন্তু এ বছর সংকটে পড়ে শিক্ষা নিয়েছি। আগামী বছরে যাতে কোনো সমস্যায় না পড়তে হয় সেজন্য ৩০ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে এর সাথে কৃষক যেনো ন্যায্য মূল্য পান সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
এ বছর কত টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে জানতে চাইলে সনৎ কুমার সাহা বলেন, আমার কাছে এ বিষয়ে তথ্য নেই। মহাপরিচালক বলতে পারবেন। কিন্তু কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল মুঈদকে কয়েকবার ফোন ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও পাওয়া যায়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন। এর মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়। ফলে বছরে ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে ৮ থেকে ৯ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে। প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়।