বর্ষবরণের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে নারী লাঞ্ছনার ঘটনাকে ‘তেমন
কোনো বিষয় না’ বলে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নারীসমাজ। এমন ‘টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে’ বলে
মন্ত্রীর মন্তব্যে সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ মিলনায়তনে মঙ্গলবার বিকেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘সংগ্রামী নারীর সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে দেওয়া তার ওই বক্তব্যের খবর প্রচার হওয়ার পর থেকেই প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে মানুষ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন: পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙালি জাতির জীবনে বছরের প্রথম দিন। এই পহেলা বৈশাখে অনেক নারী-পুরুষ রাস্তায় থাকে। এই কোটি কোটি মানুষের দেশে ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ থাকে। তার মধ্যে এমন কী ঘটনা ঘটেছে যা সংবাদ হওয়ার মতো? এরকম দু’একটা টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই না।
জার্মানিতে খ্রিস্টীয় নববর্ষের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে মন্ত্রী বলেন, ‘উন্নত দেশে এর চাইতে বেশি ঘটে। এর চেয়ে আরও মারাত্মক মারাত্মক ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকেই সরকারের সমালোচনা করতে চান যে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ।’
নৌ-মন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীতে বহু দেশ আছে যারা নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে মনে করে। অনেক দেশ আছে নারীদের সঠিক অধিকার দেয় না।’
শাজাহান খানের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ও বিশিষ্ট নারী নেত্রী আয়েশা খানম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নারী দিবসের একটি অনুষ্ঠান, যেখানে নারী অধিকার ও নারীর সম্মান নিয়েই আলোচনা; সেখানে নৌ-মন্ত্রীর এরকম বক্তব্য খুবই দুঃখজনক।
‘নারীর অধিকার নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েও নারীকে সম্মান, মর্যাদা, অধিকার কীভাবে দিতে হয় তা যদি আমরা ঠিকভাবে না জানি তবে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা ভিন্ন পরিচয় বহন করে,’ বলে মন্তব্য করেন আয়েশা খানম।
তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখের ঘটনা নিয়ে অনেক প্রতিবাদ, অনেক কথাবার্তা হয়েছে। এরপরও নারী দিবসের মতো আন্তর্জাতিক ইভেন্টে গিয়ে দেশের একজন মন্ত্রী এরকম কথা বলছেন!
‘আমার মনে হয়, নারী পুরুষের সমতা শুধু মুখে উচ্চারণের কোনো বিষয় নয়। ধারণাটি বুঝে এবং উপলব্ধি করে আমাদের ধারণার ভেতরে নেয়া দরকার,’ উল্লেখ করে আয়েশা খানম বলেন, ‘আমরা কতোটুকু জেন্ডার সচেতন হচ্ছি, নারীর সমতার ধারণা আমরা কতোটা গ্রহণ করছি, হঠাৎ হঠাৎ এমন দু’একটি উক্তিতে কিন্তু তা প্রকাশ হয়ে পড়ে।’
দেশের একজন নীতি নির্ধারকের পক্ষ থেকে এ ধরণের বক্তব্য আসাটা খুবই লজ্জাজনক বলে মনে করেন আয়েশা খানম।
আয়েশা খানমের গলায় দুঃখ, বিরক্তি আর হতাশার সুর থাকলেও রাগ এবং ক্ষোভের টান ছিলো সুপ্রীতি ধরের কথায়।
নারী বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টার-এর সম্পাদক সুপ্রীতি ধর বলেন, মন্ত্রী খুবই দায়িত্বহীন একটি কথা বলেছেন। ‘একজন মন্ত্রী হিসেবে তিনি কি তাহলে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন না? সরকার কি এখন বলবে এটি একটি বিছিন্ন বক্তব্য? কারণ আমরা ভোট দিয়ে যখন তাদের নির্বাচিত করি, তারা তো সরকারেরই প্রতিনিধি। তাহলে তো এটা সরকারের বক্তব্য।’
‘এখন সরকার যদি ভাবে পহেলা বৈশাখের ওই ঘটনায় কোনো নিপীড়ন ঘটেনি, তাহলে তো নারী অধিকার, নারী নিরাপত্তার জন্য আমাদের কোনো আন্দোলনেরই কোনো মানে নেই। আর নববর্ষের ঘটনায় আমরা যতো প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করে যাচ্ছি সেগুলোও তো বিফলে গেলো,’ বলতে বলতে ক্ষোভ ঝরে পড়ে সুপ্রীতির কণ্ঠে।
সুপ্রীতি ধর বলেন, নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য বিবেচনা করলে বলতে হয়, পহেলা বৈশাখের ঘটনায় যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে তারও তো কোনো দরকার নেই। কারণ তার কথা অনুযায়ী, তেমন কিছুইতো ঘটেনি।
‘তিনি যৌন নিপীড়ন বলতে কী বোঝেন? ঠিক কতটুকু কী ঘটলে তার কাছে তা যৌন নিপীড়ন বলে মনে হবে? তার শিক্ষা এবং মেধা অনুযায়ী ‘যৌন নিপীড়ন’ তার কাছে কী অর্থ বহন করে?’ নৌ-মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন সুপ্রীতি ধর।
‘মন্ত্রীর মতো একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে কী করে তিনি এমন একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা, যার প্রতিবাদে সারা দেশ ফুঁসে উঠেছিলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা-ও আবার নারী দিবসের একটি অনুষ্ঠানে?’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক।
এরকম বক্তব্য মেনে নেওয়ার জন্য ওই অনুষ্ঠানে যে নারীরা উপস্থিত ছিলেন এবং যাদেরকে সেখানে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে তাদেরকেও দায়ী করেন সুপ্রীতি ধর।
‘তারা কি মন্ত্রীর কথাগুলো বোঝেননি? শুধু সংবর্ধনা পেয়েই কি তারা বিগলিত হয়ে গেলেন? সংবর্ধনা পেতে এসে এ ধরনের কথা শুনেও কি তাদের মনে কোনো বিকার বা প্রতিক্রিয়া হয় না?’
সুপ্রীতি ধর বলেন, ‘এদের জন্যই নারী অধিকার আন্দোলন বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। তাদের জায়গায় আমি হলে সেখানেই সংবর্ধনা ফিরিয়ে দিয়ে আসতাম। মনে সামান্য পরিমাণ লজ্জা থাকলেও তাদের উচিৎ সেই সংবর্ধনা ফিরিয়ে দেয়া বা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করা।’