এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে সারাবিশ্বে প্রতিদিনই তাপমাত্রা বাড়ার নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে না। মাত্র ক’দিন আগেই ছিলো দেশজুড়ে তীব্র গরম। ঘোষণা করা হয়েছিলো ‘হিট অ্যালার্ট’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। দিন দিন যেন এ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
মার্চ পেরিয়ে এপ্রিল এলেই অসহনীয় গরমে বিপর্যস্থ হয় জনজীবন। সব থেকে কষ্টে থাকেন শ্রমজীবী মানুষ, বয়স্ক মানুষ এবং শিশুরা। গেলো এপ্রিলে সারা দেশের তাপমাত্রা মোটামোটি ৩৬ থেকে ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন এসেছে- অনাগত দিনে কী হবে? ‘দাবদাহ’ পরিস্থিতি কী খারাপের দিকেই যেতে থাকবে, না এ থেকে পরিত্রাণে মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু করার আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট চ্যাপেল হিলের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে: যেকোন শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে তার শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চলের দিনের তাপমাত্র গড়ে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কখনও কখনও ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। এমন প্রেক্ষাপটের সত্যতা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পাওয়া গেছে। ঢাকায় দিনের তাপমাত্র ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকালে রাতের তাপমাত্র মোটামোটি ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠা নামা করেছে। আবার রাজশাহী শহরে দিনের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠলেও রাতের তাপমাত্রা ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসতে দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান জানান: আমরা যে ভাবেই বলি না কেন পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারিগর হল মানুষ। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সকল প্যারামিটার আমরা মাত্রারিক্ত ভাবে বাড়িয়েই চলেছি। ঢাকা শহরকে আমরা কংক্রিটের শহরে পরিণত করেছি। দিনের বেলাতে এই কংক্রিটের দালান-কোঠা, পিচডালা রাস্তা গুলো তাপ শোষণ করে রাখছে। শহরের কোথাও ছায়া নেই। অপরিকল্পিত ভাবে আমরা গাছ কেটে ফেলেছি। জলাশয় গুলো ভরাট করে ফেলেছি। যার কারণে দিনে দাবদাহের পর রাতেও এ তাপ কংক্রিটের দালান গুলো শোষণ করে রাখছে। আমার রাস্তায় যে গাড়ি গুলো চলছে তা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছে। সেগুলোও তাপ বাড়িয়ে চলছে। আমরা এখন অতিমাত্রায় শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করছি। সেটাও তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলার একটি বড় কারণ।
চ্যাপেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণায় বলা হচ্ছে: একটি জায়গাকে যখন শহরে রূপান্তর করা হয় তখন প্রচুর পরিমাণে ইট এবং কংক্রিটের ব্যবহার করা হয়। যা ঘাস এবং বনভূমিযুক্ত ভূমির তুলনার অতিরিক্ত মাত্রায় সূর্যরশ্মি শোষণ করে। শহরে বৃষ্টির পানি শোষণের ক্ষমতাও কমে যায়। যার কারণে শহরের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে যেখানে ঘাসযুক্ত মাটি এবং গাছ রয়েছে, সেখানকার বৃষ্টির পানি ওই ঘাস এবং গাছ নিজের কাছে টেনে নেয়; যার কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকে। আর শহরের বাতাসে যেহেতু জলীয় বাষ্প বেশি থাকে তাপমাত্রার অনুভূতিও সেখানে বেশি থাকে।
ঢাকা ও রাজশাহীর রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য প্রসঙ্গে ড. জিল্লুর রহমান বলেন: ঢাকায় যেটা হচ্ছে, পর্যাপ্ত গাছ এবং জলাশয় না থাকায় দিনের শোষণ করা তাপ শহর ধরে রাখছে। অপরদিকে রাজশাহীতে গাছ এবং জলাশয় আগের তুলনায় কমে আসলেও শহরের চারপাশ দিয়ে এখন এগুলো রয়েছে। যা ওই শহরকে রাতে দ্রুত তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়তা করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: শহরাঞ্চলের এ তাপমাত্রা কমিয়ে আনার উপায় কী?
শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাবনা ওঠে এসেছে চ্যাপেল হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণায়। সেখানে বলা হয়েছে:
১. ব্যাক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। এতে করে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমবে। বিকল্প হিসেবে গণপরিবহণ ব্যবহারে আরও বেশি উদ্যমী হওয়ার তাগিদ গবেষণায়। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবহন, বৈদ্যুতিক বাইক বা বাইসাইকেল ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
২. বসত-বাড়ি নির্মাণে তাপ শোষণকারী নয় এমন উপকরণ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। বাড়ি নির্মাণের প্রাকৃতিক উপাদান বাশ-কাঠের ব্যবহার বেশি বেশি ব্যবহার এবং ছাদে থার্মোপ্লাস্টিক পলি ওলেফিনের (টিপিও) ব্যবহার। টিপিও এটি শোষণের পরিবর্তে তাপকে প্রতিফলিত করে। যার ফলে ঘরের তাপমাত্রা কম থাকে।
৩. কোন ব্যাক্তি যদি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ছাদে ‘ছাদবাগান’ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণায়। এছাড়া বিল্ডিংয়ের ছাদে সাদা রঙ করার কথা বলা হয়েছে। এতেকরে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বিল্ডিংয়ের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
৪. ব্যাক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারকে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনের কথা বলা হয়েছে গবেষণায়। যেমন: ছাদে ‘ছাদবাগান’ ও সাদা রঙ করার জন্য সরকারের নীতিমালা থাকার কথা বলা হয়েছে। এরফল হিসেবে নিউইয়র্ক শহরের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে নিউইয়র্ক শহরের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ একবার শহরের অ্যাপার্টমেন্ট গুলোতে নিদৃষ্ট অংশে বাগান করা এবং সাদা রঙ করার আদেশ প্রদান করেন। যার ফল হাতেনাতে পায় নিউইয়র্কবাসী। ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের মেয়র ছিলেন মাইকেল ব্লুমবার্গ ।
৫. শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে শহরের তাপমাত্রা নিঃসরণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ গবেষণায়। সেখানে সড়ক গুলোকে টাইটানিয়াম অক্সাইড দিয়ে আবৃত করে ফেলতে বলা হয়েছে। এর ফলে রাস্তাগুলো তাপ শোষণের পরিবর্তে তাপ প্রতিফলন করবে। তাতে করে সড়ক গুলো তাপমাত্রা ধরে রাখবে না।
৬. সিঙ্গাপুরের উদাহরণ তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়েছে: সিঙ্গাপুরে শহরের অত্যাধিক তাপমাত্রা একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণে তারা বাড়ি গুলো এমন ভাবে তৈরি করে থাকে যেনো বাতাস ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারে। তাতে করে তাপ বাড়ির মধ্যে আটকা থাকবে না। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাবে। এছাড়া, দেশটি নির্মাণ সামগ্রী নিয়েও ব্যাপক গবেষণা করছে। যেনো নির্মাণ সামগ্রী গুলো তাপ শোষণকারী না হয়।
৮. জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে এবং ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে গবেষণায়। এছাড়া, নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আরও বেশি গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় প্রসঙ্গে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের অবশ্যই শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে। সল্পমেয়াদী পদক্ষেপের মধ্যে ‘ছাদবাগান’ ও বিল্ডিংয়ের ছাদে সাদা রঙ করা যেতে পারে। এতে করে তাপ শোষণের পরিমাণ কমে আসবে। শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করে চলা যানবহনের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন: এগুলো করে আমরা হয়তো আমরা সাময়িক সুবিধা পাবো। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য অবশ্যই আমাদের শহরে বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। এবং যেসকল জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো পুনঃখনন করতে হবে। আর যে খাল গুলো ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধার করে আবারও পূর্বের পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। এছাড়া, শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ তার।
মার্কিন পরিবেশ বিজ্ঞানী অ্যাঞ্জেল হসু বলছেন: আমরা যদি আজই যদি পৃথিবীর সমস্ত গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বন্ধ করে দিই, তবুও শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়বদ্ধ থাকবো। কারণ আমাদের সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুমণ্ডলে রয়ে যাবে।