এই খবরটি পডকাস্টে শুনুনঃ
সব তামাকজাত দ্রব্য এক নয়। সিগারেটের দহনের কারণে একে সবচেয়ে বিষাক্ত হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে, উত্তপ্ত সিগারেট বা ইলেকট্রনিক সিগারেটকে কম ক্ষতিকারক ধোঁয়াবিহীন পণ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই দুই শ্রেণীর পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল কাঁচামাল।
ই-সিগারেট নিকোটিনযুক্ত একটি সমাধান ব্যবহার করে যেখানে গতানুগতিক সিগারেট তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। ডব্লিউএইচও বলেছে ই-সিগারেট পণ্য এবং উত্তপ্ত তামাকজাত দ্রব্য (এইচটিপি) উভয়েই নিকোটিন রয়েছে, তবে গঠনে পার্থক্য রয়েছে। উত্তপ্ত তামাকজাত দ্রব্যে বিশেষভাবে তামাকের কিছু উপাদান থাকে। ই-সিগারেটগুলো প্রায় পনের হাজারেরও বেশি স্বাদযুক্ত প্রয়োজনীয় তেলের দ্রবণ দ্বারা গঠিত, যার মধ্যে অনেকগুলো বিষাক্ত। এগুলো যদিও স্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব রাখে এবং দ্রবণে অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ মিশ্রিত করতে পারে। তবুও, বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরামর্শ দেয় যে তারা প্রচলিত তামাকজাত পণ্যের তুলনায় ৯০ শতাংশ কম ক্ষতিকারক।
বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে সম্প্রতি, একটি প্রতিবেদেনে তামাকের ক্ষতি ও প্রভাব মোকাবিলায় কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রাক্তন পরিচালক রবার্ট বিগলহোল এবং রুথ বনিতা।
প্রতিবেদনে সুস্থ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতে ধূমপানের ক্ষতি কমাতে করণীয় বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়। এছাড়াও, সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’ (এফসিটিসি) প্রণয়নে সরবরাহ কমিয়ে তামাকের চাহিদা হ্রাস করতে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা নিয়েও আলোচনা করা হয়।
মূলত, বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র এফসিটিসি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এফসিটিসির মাপকাঠির সাথে বাস্তবে তামাক সেবনের ঝুঁকি ও ধূমপানের তীব্রতার মধ্যে সামঞ্জস্যতা দেখানো কিছুটা জটিল।
তামাকের ক্ষতি কমানোর আলোচনাকে এফসিটিসি কখনোই নাকোচ করে না, কিন্তু ই-সিগারেট ও নিকোটিনের অন্যান্য বিকল্প পণ্য ব্যবহারের নীতিমালাকে এফসিটিসি নিজ নিজ দেশের উপর ছেড়ে দেয়। এই পণ্যগুলোয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অনুমোদন না থাকায় বিশ্বব্যাপী ধূমপানের কারণে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা ১.৩ বিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্যকর জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ই-সিগারেট এবং অন্যান্য বিকল্প পণ্যগুলোর সাথে তামাকজাত পণ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। সংস্থার ইতিবাচক নেতৃত্ব ও প্রযুক্তিগত সহায়তা ই-সিগারেট ও বিকল্প পণ্যগুলোর ব্যবহারকে প্রভাবিত করছে। ভারত ও আশেপাশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৩৪টি দেশ এসব বিকল্প বা কম-ক্ষতিকর ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে।
কিছু দেশে বিকল্প পণ্য অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধূমপানের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নিউজিল্যান্ডে ই-সিগারেট বৈধ হওয়ার পর প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ধূমপানের হার হ্রাস পেয়ে ২০২২-২৩ সালে ৬.৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৭-১৮ সালে ১৩.৩% ছিল। অর্থাৎ, বিগত ৫ বছরে এই পরিমাণ ৪৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একইসাথে, প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ভ্যাপিংয়ের হার ২.৬ শতাংশ থেকে ৯.৭ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, ব্যবহারকারীরা এটি ধূমপান বর্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। নিউজিল্যান্ডে বিশেষ কোন তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ছাড়াই ধূমপানের হারে এই পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডের ধূমপান-মুক্ত আইনে ‘তামাকমুক্ত প্রজন্ম’ শীর্ষক একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে, যেখানে খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রে ৯০% তামাক হ্রাস এবং খুচরা তামাকের বাধ্যতামূলক ডিনিকোটিনাইজেশন করার কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে নিউজিল্যান্ড সরকার ৫ শতাংশ বা তার কম প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যাকে ২০২৫ সালের মধ্যে ধূমপানমুক্ত করার কথা বলেছে। একইসাথে তারা ২০২২ সালের ধূমপান-মুক্ত আইনটি বাতিল করতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
সাম্প্রতিক অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে, ২০২৫ সালের মধ্যে সকলের সমর্থন ও সম্মতিক্রমে নিউজিল্যান্ডকে স্মোক-ফ্রি বা ধূমপান-মুক্ত করার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইসাথে, অন্যান্য উচ্চ-আয়ের দেশগুলো নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ এই নিকোটিন ডিভাইজগুলো ব্যবহার করে ধূমপানের প্রবণতা হ্রাস করতে সফল হয়েছে। সুইডেন স্নাস ব্যবহার করে তামাকজনিত রোগে মৃত্যুসহ ২০২২ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ধূমপানের হার ৬ শতাংশ হ্রাস করেছে। স্নাস ও ই-সিগারেট ব্যবহারের মাধ্যমে নরওয়ে ধূমপানের হার হ্রাস করার ক্ষেত্রে একই রকম সাফল্য পেয়েছে। ভ্যাপিং ইংল্যান্ডে প্রাপ্তবয়স্কদের ধূমপান ত্যাগ করতে সাহায্য করছে। জাপানে তামাকের সেবনের তুলনায় ভ্যাপিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
কিন্তু, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই ধূমপানের হার কমাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো তামাকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নীতিমালা। যদিও অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সিগারেটের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা হচ্ছে, তবে ই-সিগারেটের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি বিবেচনা করলে তামাকের তুলনায় ই-সিগারেটের উপাদানগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে, পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ও বিধানের অনুপস্থিতির কারণে ই-সিগারেটের অনিয়ন্ত্রিত প্রাপ্যতা যুবকদের নিকোটিন গ্রহণে উৎসাহিত করে।
এতে করে প্রতিনিয়ত অযাচিত ভ্যাপিং বৃদ্ধি পেলেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ভ্যাপিং তরুণদের ধূমপানের দিকে পরিচালিত করছে। যদিও, ভ্যাপিং করা অধূমপায়ী তরুণদের সংখ্যা নেহাতই কম। যুবক-যুবতীদের এই অনিয়ন্ত্রিত ভ্যাপিং প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি প্রচারসহ বিক্রয় বিধিনিষেধ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তবে এই ব্যবস্থাগুলো অবশ্যই যারা ধূমপান করে বা ছেড়ে দেওয়ার উপায় খুঁজছেন তাদের স্বাস্থ্যের চাহিদার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের বাজার সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখে ধোঁয়ামুক্ত পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে তামাক শিল্পের উদ্দেশ্য সকলের বোধগম্য নয়। তামাক শিল্পকে লাভজনক থাকতে হলে কম ক্ষতিকারক বিকল্পে স্থানান্তর হতেই হবে। কেননা, নিকোটিনের সরবরাহকারী হিসেবে সিগারেট ছাড়াও অন্যান্য পণ্য ইতোমধ্যেই বাজারে আসা শুরু করেছে।
বিভিন্ন গবেষণায় নিকোটিন পণ্যগুলোকে সিগারেটের সমতুল্য হিসাবে বিবেচনা করার এবং একইভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রতি জোর দেওয়া হয়। তবে এটি বুঝতে হবে যে, ক্ষতির কারণ মূলত তামাক পোড়ানো, নিকোটিন নয়। তামাক সেবনের ক্ষতিকর স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলোকে মাথায় রেখে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সকলের নজর দেওয়া উচিৎ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ই-সিগারেট এবং নিকোটিন ডিভাইস বা বিকল্প পণ্যগুলোকে একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ইংল্যান্ড কিংবা জাপানের মতো যে দেশগুলো তামাকের ক্ষতি হ্রাসের সুবিধা ভোগ করছে তাদের উচিৎ অন্যান্য দেশগুলোকে এ পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করা।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)