বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফিল্ম স্কুলের আলাপে ‘আদিম’
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফিল্ম স্কুলে ‘আদিম’ নির্মাণের গল্প শোনালেন যুবরাজ শামীম
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ফিল্ম স্কুল বলা হয় রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি অব সিনেমাটোগ্রাফি (ভিজিআইকে)-কে। ১৯১৯ সালে মস্কোতে প্রতিষ্ঠিত এই ফিল্ম স্কুলের সাথে জড়িয়ে আছে পৃথিবীখ্যাত কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকারদের নাম। বুধবার (৭ ডিসেম্বর) এই স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক সহ ফিল্ম একটিভিস্টরা আয়োজন করে শুনলো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘আদিম’ নির্মাণের গল্প।
‘আদিম’ এর নির্মাতা যুবরাজ শামীম চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন, ১ ডিসেম্বর মস্কোর এই ফিল্ম স্কুল থেকে ই-মেইল যোগে একটি অনলাইন কনফারেন্সের আমন্ত্রণপত্র পান। যেখানে তাকে জানানো হয়, ৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল কনফারেন্সে ‘আদিম’ নির্মাণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ফিল্ম স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকরা শুনতে আগ্রহী।
নির্মাতা যুবরাজ বলেন, এমন সুযোগ সত্যিই আমার জন্য আনন্দের। এই আনন্দের প্রধান কারণ বলা যায়, এই ফিল্ম স্কুলের ছাত্র ছিলেন আমার চলচ্চিত্র গুরু আন্দ্রেই তারকোভস্কি। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো আমার জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণার।
রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি অব সিনেমাটোগ্রাফি (ভিজিআইকে)-তে আয়োজিত সেই ভার্চুয়ালে কনফারেন্সে ‘আদিম’ নিয়ে নির্মাতা যুবরাজ শামীমের দেয়া বক্তব্যটি চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য হুবুহু তুলে ধরা হলো:
আমি মূলত ফিল্মমেকার নই কিংবা নিজেকে ফিল্মমেকার ভাবার চেয়ে স্ট্রিটপেইন্টার ভাবতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমি আমাদের দেশের পথঘাটে বিভিন্ন চিত্রশিল্পীকে দেখেছি ইটের সুরকি, কাঠ কয়লা যা তাদের হাতে আছে তাই দিয়েই রাস্তার বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকতে। যেখানে তাদের কোন প্রত্যাশা নেই, তারা শুধু ভালোলাগা থেকেই নিজের মত করে ছবি আঁকেন। আমার নিজেকে মূলত রাস্তার ঐ চিত্রশিল্পী মনে হয়। আর যদি নিজেকে ফিল্মমেকার পরিচয় দিতেই হয়, সেক্ষেত্রে নিজেকে আমি ফিল্ম ওয়ার্কার বলতে চাই। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমার কাজ শুধু ছবি বানিয়ে যাওয়া।
আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘আদিম’ নির্মাণের ক্ষেত্রেও আমার ভেতরে এমন ভাবনাই কাজ করেছে। শুরুতে আমি অন্য একটা গল্প নিয়ে বিভিন্ন দেশের ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডের জন্য এপ্লাই করতে থাকি কিন্তু কাজ হয়নি। আমার তখন মনে হয় ফান্ড কিংবা ইনভেস্টরের অপেক্ষায় না থেকে বরং আমার এমন একটা গল্প চিন্তা করা উচিত যা ঐ স্ট্রিটপেইন্টারের মতই হাতের কাছে যা তাই দিয়েই শুট করা সম্ভব। সেই সময়টায় আমি রেললাইনে খুব বেশি সময় কাটাতাম। রেললাইনের আশেপাশের মানুষজনের সঙ্গে আমি দীর্ঘসময় গল্প করতাম। এরপর একদিন স্টেশনেরই একজনকে আমার ভীষণ ইন্টারেসিস্টং মনে হয়। তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এই ভাবনাই ‘আদিম’ নির্মাণের শুরু। তখন আমার মনে হয়, এই মানুষগুলোর গল্প নিয়ে ছবি বানাতে হলে আমার এই মানুষগুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হবে, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আরো গভীরভাবে মিশে যাওয়া জরুরী। এরপর আমি বস্তিতে, যেখানে তারা থাকেন- সেখানে আমি স্থায়ীভাবে তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি।
গল্প নির্মাণের পাশাপাশি আমি ভাবতে থাকি কোন উপায়ে ছবি নির্মাণের টাকা জোগাড় করা সম্ভব। যদিও আমি জানতাম ‘আদিম’ নির্মাণের প্রোডাকশনকস্ট তুলনামূলক অনেক কম। কিন্তু সেই সময় আমার কাছে কোনো টাকাই ছিল না। তাই আমি আমার পরিচিত বন্ধুদের কাছে টাকা লোন নেয়ার পরিকল্পনা করি। তখন আমার ফিল্মমেকার বন্ধু মোহাম্মদ নূরুজ্জামান ছবির শেয়ার বিক্রি করার পরামর্শ দেন। তার আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয় । আমি ফেসবুকে আমার ছবির শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেই। শুরুতে তেমন কোন সাড়া পাইনি। কিন্তু আমি হাল না ছেড়ে নিয়মিত ফেসবুকে ছবির শেয়ার কেনার আহ্বান করি, সেই সঙ্গে প্রতিদিন আমার বস্তিজীবনের অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে মানুষের সঙ্গে শেয়ার করতে থাকি। বস্তিতে থাকাকালীন পুলিশ আমাকে মাদকসেবী ভেবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন আর স্থানীয় মাদকব্যবসায়ীরা আমাকে ক্রাইম রিপোর্টার ভেবে নানাভাবে সমস্যার সৃষ্টি করেন। এই ঘটনাগুলো ফেসবুকের কল্যাণে মানুষের সামনে চলে আসে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। ধীরে ধীরে আমার কাজের প্রতি মানুষের আস্থা জন্মায়, সাধারণ মানুষেরা ছবি শেয়ার কিনতে শুরু করেন।
শুরুতে আমি স্থানীয় থিয়েটার আর্টিস্ট নিয়ে ‘আদিম’ নির্মাণের পরিকল্পনা করি। কিন্তু বস্তিতে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছে এই জীবন সম্পর্কে যার অভিজ্ঞতা নেই, সে শুধু অনুকরণ করবে, বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে বস্তির লোকজন দিয়েই অভিনয় করাতে পারলে ছবিটা প্রাণবন্ত হবে। আমি তখন ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা বলতে থাকি এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা আমার কথা সহজে নিতে পারেনি। কারণ তারা ছবি বলতে তথাকথিত নায়ক নায়িকাদের ছবিই বুঝতো এবং সেই সাথে তারা কখনোই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়নি। তাই তারা নার্ভাসও ছিল। আমি তাদেরকে নানা উপায়ে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলি এবং মূল শুটিং-এর আগে প্রায় তিন মাস আমরা রিহার্সেল করি। এভাবেই আমাদের ‘আদিম’ নির্মাণের যাত্রা শুরু হয়।
‘আদিম’ নির্মাণের সময় আমি ভাবিনি আমার অর্জন কী হতে যাচ্ছে। বরং আমি আদিম নির্মাণের জার্নি ভীষণভাবে উপভোগ করেছি। পরবর্তী সময়ে ৪৪তম মস্কো আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসবের স্বীকৃতি আমাকে আমার দেশে সুপরিচিত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন বহু মানুষ আমার পরবর্তী ছবিতে ইনভেস্ট করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ইতোমধ্যে আমি আমার পরবর্তী ছবির পরিকল্পনা করছি। সেই সঙ্গে আদিম’র অভিনয়শিল্পী এবং এই অবহেলিত মানুষদের সম্পর্কে এখন অনেকেই জানতে শুরু করেছেন। এখন আমাদের সমাজের উচ্চশ্রেণীর কেউ কেউ জানতে শুরু করেছেন। আশা করছি তারা খুব শিগগির এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবেন। আশার কথা হলো, আদিম’র অভিনয় শিল্পীদের কেউ কেউ মূল মিডিয়ায় অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।