তিনি গানের ফেরিওয়ালা। গানে সুরে সত্য আঁকেন। যুদ্ধে কিংবা বিপ্লবে। প্রেমে কিংবা অপ্রেমে তার কণ্ঠ সুরারোপিত হয়। হুংকার কিংবা ঝংকারে, গানই তার প্রধানতম অস্ত্র। নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের ওলট পালটকে থুরাই কেয়ার তার! কিন্তু অবিচল এক জায়গায়। সমস্ত ন্যায্য দাবী দাওয়ার পক্ষে তার অবস্থান। কথা সুরে প্রতিরোধে যেমন নামেন, তেমনি অসহিষ্ণু পৃথিবীতে প্রেমের বান ডেকে নামান। যা আছড়ে পড়ে, চারদিকে। এটা তার পুরনো অভ্যেস।
দুঃখজনক বিতর্কের মুখোমুখিও হয়েছেন বহুবার। তবু এসবে আক্ষেপ নেই মোটেও। লোকের ভালোবাসায় যেমন পুলকিত হন মুহূর্তে। বুক পেতে ঘৃণার কুণ্ডলিও পকেটে পোড়েন তিনি। সমালোচনা নিতে কার্পণ্য নেই তার! রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা উঠলে শত মানুষের সামনে বসে সাবলীল কণ্ঠে তাই তিনি বলে উঠতে পারেন, ‘তাতে আমার বয়েই গেছে। আমি শিল্পী, রাজনীতির মারপ্যাঁচ আমার কাজ নয়!’ পরক্ষণেই কোমল কণ্ঠে এও বলে উঠতে পারেন,‘এসব দিয়ে আমাকে বিচার করবেন না!’
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরেই ঢাকায় এসেছেন সুমন। নিরাপত্তার অজুহাতে নির্ধারিত ভেন্যুতে গাওয়ার সুযোগ পাননি। অনিশ্চয়তা থাকলেও বিকল্প ভেন্যুতেই মাত করেছেন এই কালজয়ী স্রষ্টা! তাকে শুনতে ও দেখতে লোকের অভাব নেই। বিরতি দিয়ে তাকে নিয়ে আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা ছিলো মোট তিন দিন। সুমনকে নিয়ে মানুষের এমন আগ্রহ, আয়োজকরা টিকেট সরবরাহ করতেই হিমশিম খেয়েছেন! টিকেট ছাড়ার এক দিনের মধ্যে সব টিকেট হাওয়া’র খবর গণমাধ্যমেও এসেছে।
সুমনের এবারের ট্যুরের শেষ আয়োজনটি ছিলো শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে। আগের দুটি কনসার্ট না দেখার আক্ষেপ কবীর ঘুচিয়ে দিয়েছেন মাত্র একটি সন্ধ্যাতেই! বয়স ছাড়িয়েছে তিহাত্তর! তবু দুর্বোধ্য নন। কী সতস্ফূর্ত সুমন! কী সহজ! শুধু কী গায়কীতে? তার বলা অভিজ্ঞতার গল্পগুলোও যেনো সহজ শব্দের গান হয়ে স্পর্শ করেছে। হৃদয়ে। গভীরে। আপাদমস্তক হিউমারে মোড়ানো সুমন! কথার যাদুতেই কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন তিনি। করেছেনও।
গান দিয়ে ঢাকার মানুষকে সুমনের মুগ্ধতা ছড়ানোর গল্প অনেকেই করেছেন। লিখেছেন আমাদের আর আর সহকর্মী বন্ধুরাও। বাহুল্য’র দিকে না গিয়ে বরং সুমনের ভঙ্গি নিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো।
সচরাচর গানের আয়োজনের যে ঢঙ, তাতে সুমন সস্তিবোধ করবেন না এটা অনুমেয় ই ছিলো- কিন্তু তাই বলে এতো ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে তাকে দেখা যাবে, হয়তো আমার মতো যারা প্রথমবার স্বচক্ষে তাকে দেখতে পেলেন- তারাও এতোটা প্রত্যাশা করেননি! সম্ভবত এই ভঙ্গিটা আর আরদের থেকে সুমনকে আলাদা করে দেয়। আপন করে তুলে!
কিবোর্ড বাজিয়ে সুমন গাইছেন। সন্তর্পণে। একা। হঠাৎ গান থামিয়ে তিনি ডাকছেন সঙ্গে থাকা যন্ত্রশিল্পীদের। যারা এতোক্ষণ মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে হয়তো এমন মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিলেন। দেখা গেলো, খুনসুঁটিতে মেতে উঠছেন কবীর। আবার গাইতে শুরু করেছেন। সুমনকে দেখে মনে হলো, তিনি গাইছেন তার নিজস্ব ড্রয়িং রুমে। অতি পরিচিত আবহে। আর তার সামনে যারা, তারা সবাই যেনো তার হৃদয়ের খুব কাছের! সবার সাথেই যেনো তার মিতালি!
গান গাওয়ার এক পর্যায়ে সমস্ত ঘরে অন্ধকার ঢেলে দিয়ে শুধু সুমনে ফোকাস হয় আলো! সঙ্গে সঙ্গে এমন আলোকসজ্জা পরিবর্তন করতে বলেন সুমন। উপস্থিত দর্শকের মুখ দেখে গান গাইতে পারার আর্জি তখন সুমনের কণ্ঠে। তার এমন সরল অনুরোধে হল রুমের সব আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সুমনের সস্তি ফেরে। শ্রোতাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নিজের আপন আঙিনায় ধারণের এই গুণ বা টেকনিক খুব কম শিল্পীর মধ্যেই দেখেছি।
একের পর এক গান শুনিয়েছেন সুমন। বলে গেছেন গানের পেছনের গল্পও। সম্মোহিত শ্রোতা দর্শককে দেখেছি আরও গুটিয়ে যেতে। আরও শীতল ও কোমল স্পর্শে সুমনকে অনুভব করতে! গানের মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ থেমে যান সুমন। বলতে শুরু করেন অন্য গল্প। তার যাপন সময়ের গল্প। গান থামিয়ে বেহুলাকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া নদীর সাথে সুমন খুঁজে ফেরেন আন্তসম্পর্ক। যেনো বেহুলার সেই ভেলাতে চড়েই সুমন নিজ ঘরে ফেরেন। প্রতিদিন। সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে! শোনান সেই নদীটির সাথে তার নিজ ঘরের দূরত্ব বিষয়ক গল্প! মিথ ও সময়ের মিথস্ক্রিয়ায় তৈরী হয় ঘোর। যে ঘনঘোর সুমন জিইয়ে রাখেন পুরোটা সময়।
মানুষের মাঝে থেকে যাওয়ার আকুতিও কি ঝরে পড়ে নাই, এই ঢাকার কনসার্টে? ‘টাকা পয়সা একদিন থাকবে না। কাজটা থেকে যাবে।’-এটাই চিরায়ত সত্য। যদিও এমন সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বছর দুই আগে ভিন্ন কথা বলেছিলেন কবীর সুমন। হয়তো অভিমানে। প্রকাশ করেছিলেন ইচ্ছেপত্র (উইল)। সেখানে তিনি স্পষ্ট বাংলায় জানিয়ে ছিলেন, তার মৃত্যুর পর যেন তার সমস্ত সৃষ্টি ও স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র ধ্বংস করে দেয়া হয়! কোটি মানুষের মগজে যার সৃষ্টি ছড়িয়ে গেছে, তা কি ধ্বংস করা সম্ভব! এমন প্রশ্নও তো উঠেছিলো সেদিন। নাকি উঠে নাই? ঢাকায় শুক্রবার সন্ধ্যায় সুমন যেনো ফিরলেন শিল্পীত ঢঙে। অভিমান ভুলে। যেনো সবার উদ্দেশ্যেই বলতে চাইলেন, গান দিয়েই মানুষের মনে টিকে থাকতে চান। তিনি না থাকলেও যেনো তার সৃষ্টি মানুষ ধারণ করেন। কী আকুতি সেই কণ্ঠে!
‘জীবন থেকে প্রতিদিন একটি করে সন্ধ্যা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রেম কিংবা বিপ্লব ছাড়াই।’- নিজেদের ভার্চুয়াল বায়োতে একরকম নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ঝুলে থাকা বাস্তবতা কিংবা সাইনবোর্ড। এরমধ্যেই যেনো ঘুরপাক আমাদের বেশিরভাগ মানুষের। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কুণ্ডলিতে বসে হাপিত্যেশ কিংবা আক্ষেপ করে বাঁচা নাগরিকদের জন্য যেনো আশীর্বাদ হয়ে এলো কয়েকটি সুমন সন্ধ্যা! প্রেমে কিংবা মায়ায় ঘোরগ্রস্ত করে গেলেন সুমন। যা আগামী বেশকিছু সন্ধ্যার খোরাক! যদিও সুমন কথা দিয়েছেন, আবার তিনি ফিরবেন এই বাংলায়!
ছবি: মাহবুব আলম