ছয়, ছয়, ছয় এবং আরেকটি ছয়! ফাইনালের ফাইনাল ওভারে কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের ব্যাটিং তাণ্ডব মুহূর্তেই এলোমেলো করে দিল সব। ২০১০ আসরের পর ইংল্যান্ডকে আবারও চ্যাম্পিয়ন দেখতে যারা মুখিয়ে ছিলেন, তাদের চোখ দুটি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রসারিত করে দিলেন ব্র্যাথওয়েট। ধাতস্থ হতে সময় নেয়ার আগেই দর্শক সারিতে বসা অনেকের মুখ ফুটে বের হতে বাধ্য করেছিলেন, ‘ওহ, এটা কী হল!’ মানে অনুমান পুরোটাই উল্টে গেছে, ৬ বলে ১৯ রানের সমীকরণ ২ বল থাকতেই মিলিয়ে ফেলেছেন ক্যারিবীয় ব্যাটার।
টানটান উত্তেজনা, রোমাঞ্চকর লড়াই, স্নায়ুচাপী ম্যাচ, নাকি এক কথায় টি-টুয়েন্টির রূপকথার ফাইনাল— নির্দিষ্ট কোনো একটা বললেও ক্যারিবিয়ানদের ট্রফি জয়ের আখ্যান শেষ হবে না। যেটা হবে মানে হয়ে গেছে, বেন স্টোকস ও ইয়ন মরগানের ইংলিশদের বিধ্বস্ত করে প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তুলে নিয়েছে ড্যারেন সামির দল। ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল, রোববার— এই তারিখের দিন ও রাত পুরোটাই ছিল ক্যারিবিয়ানদের দখলে। ঘণ্টা পাঁচেকের ব্যবধানে যারা মেতে উঠেছিল দুটি বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে।
দুপুরে মেয়েদের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মেতেছিলেন উইন্ডিজ। রাতে ইডেন গার্ডেনসে গেঞ্জি খুলে দৌড়ালেন ডোয়াইন ব্রাভোরা— একদিনে দুটি বিশ্বকাপ শিরোপা, যেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের রূপকথা! মারমার-কাটকাট সংস্করণে প্রথম ছয়বারের আসরে ২০১০ সালের পর আরেকবার শিরোপা ঘরে তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
এই লেখাটি ছেলেদের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ২০১৬ সালের আসর নিয়ে। কিন্তু কয়েক হাজার শব্দ একটি মানুষকে নিয়েই লিখে রাখা উচিত— কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। কী করে ফেললেন তিনি। পাদপ্রদীপের আলো যেন এসে পড়ল নতুন কক্ষে, তাতে আলোকিত করে দিল সব কক্ষপথই। ক্রিস গেইল, মারলন স্যামুয়েলস, ডোয়াইন ব্রাভো, আন্দ্রে রাসেলদের মতো টি-টুয়েন্টির বড় বড় তারকার নাম ছাপিয়ে ততক্ষণে আলোচনায় ব্র্যাথওয়েট। টানা চতুর্থ বলটি আকাশে উড়িয়ে সেই গর্জন, সব জয়ীরা বুঝি এভাবেই উদযাপন করেন! এমন করেই দলকে জিতিয়ে নেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেন!
ব্র্যাথওয়েট নামটি ফাইনালের আগে মানে, সেই ১০ বলে চার ছক্কায় ৩৪ রান করার আগে, খুব একটা পরিচিত ছিল না। উইন্ডিজদের হয়ে ছোট সংস্করণে তখন খেলেছেন মাত্র সাতটি ম্যাচ। আগের চার ইনিংসে ব্যাট হাতে এসেছে মোটে ২৫ রান। আর শিরোপার মঞ্চে সব উল্টে গেল, স্টোকসকে চারবার উড়িয়ে মারলেন, এক ইনিংসেই করলেন ৩৪ রান! ম্যাচে ফিরে আসা ইংলিশদের দিলেন হতবাক করে দেয়া হারের স্বাদ। অবিশ্বাস আর হতাশায় মুখ ঢাকলেন স্টোকস। এও সম্ভব! কলকাতার রোমাঞ্চ, উত্তেজনাকর ফাইনাল সীমানা প্রাচীর ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ৬ষ্ঠ আসরের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে লেখা হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম।
ইডেনে সেদিন শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ব্যর্থতায় পড়ে ইংল্যান্ড। ১২ ওভারের পর বোর্ডে আসে ১০০ রান, নেই টপ অর্ডারের ৪ ব্যাটার। পুরোপুরি ব্যর্থ জেসন রয়, অ্যালেক্স হেলস। অধিনায়ক মরগান করতে পারলেন মাত্র ৫ রান! টিকে গেলেন জো রুটের ৩৬ বলে ৫৪ রানের ইনিংসে। শেষদিকে ডেভিড উইলির ১৪ বলে ২১ রানের ক্যামিওতে কিছুটা আশা দেখাচ্ছিল। ৯ উইকেট হারিয়ে ১৫৫ অবশ্য শঙ্কাও দেখাচ্ছিল বেশ। এই উইন্ডিজের বিপক্ষে গ্রুপপর্বের ম্যাচে ১৮২ রানের লক্ষ্য ছুঁড়েও যে পারেনি ইংলিশরা, সেখানে গেইল-স্যামুয়েলসদের সামনে মোটে ১৫৬ রান, মামুলিই!
মোটেও মামুলি যে ছিল না সেটা প্রথম তিন ওভারেই বোঝা গেল। শিরোপার মঞ্চে এসে ব্যাটার রুট পুরোদস্তর বোলার হয়ে গেলেন। মরগানের বুদ্ধির পক্ষে কাজও করলেন, শুরুতেই ফিরিয়ে দিলেন আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকানো গেইলকে, ব্যর্থ করলেন জনসন চার্লসকেও। চারে নামা লেন্ডল সিমন্স যেন সব হিসেবে গুঁড়িয়ে দিলেন, উইলির প্রথম বলেই পড়লেন এলবির ফাঁদে। বোর্ডে তখন ২.৩ ওভার শেষে ৩ উইকেটে ১১ রান।
প্রায় ছিটকে পড়া ম্যাচটি বাঁচাল ব্রাভো-স্যামুয়েলস জুটি। ২৭ বলে ২৫ রান করে ব্রাভো ফিরলে আরেকবার চাপে পড়ে ক্যারিবিয়ানরা। এবার ব্যর্থ হলেন বড় নাম রাসেল ও অধিনায়ক ড্যারেন সামি, যথাক্রমে করলেন ১ ও ২ রান! অপরপাশে ৬৬ বলে ৯ চার ৩ ছক্কায় ৮৫ রানে ব্যাট করছেন স্যামুয়েলস। শেষ ওভারে ক্রিজে আসলেন ব্র্যাথওয়েট। ১৫৫ রানের ম্যাচ এমন রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে, সেটি অনুমান করা তখনও কঠিনই ছিল। আর ব্র্যাথওয়েট যেটা করেছেন সেটাকে রূপকথা না বলেও পারা যাবে না।
আদ্যোপান্ত ২০১৬ বিশ্বকাপ
ভারতের সাতটি শহরে আয়োজিত বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ১৬ দল। ৮ দল সরাসরি বিশ্বকাপে ছিল। বাছাইপর্বের আটটি দল দুটি গ্রুপ হয়ে খেলেছিল। চার দলের গ্রুপের শীর্ষ দলটি যোগ দেয় সেরা আট দলের সঙ্গে। দশ দলের আসর ভাগ হয় দুটি গ্রুপে। প্রতি গ্রুপের শীর্ষ দুটি দল খেলে সেমিফাইনাল।
বিশ্বকাপে দল বাছাইয়ের আগে খুব জটিল একটি সমস্যায় পরে যায় ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। ২০১৫ সালের অক্টোবরে হঠাৎ বেঁকে বসে পাকিস্তান। দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের তখনকার প্রেসিডেন্ট শাহরিয়ার খান জানান, শ্রীলঙ্কায় প্রস্তাবিত সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারত না খেললে তারা বিশ্বকাপ বয়কট করবেন। যদিও শেষপর্যন্ত ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলেছিল পাকিস্তান। কিন্তু বাংলাদেশ বাদে গ্রুপে ভারতসহ বাকি তিন দলের সঙ্গে হেরে আসর থেকে বিদায় নিয়েছিল।
বিশ্বকাপে অন্যতম ফেভারিট ভারত ‘বি’ গ্রুপের রানার্সআপ হয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের এই গ্রুপটিতে চারটি ম্যাচের চারটিতে জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিতে ইংল্যান্ডের সামনে পড়ে নিউজিল্যান্ড। অন্যগ্রুপের সেরা হয়ে শেষ চার নিশ্চিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও রানার্সআপ হয়ে আসে ভারত।
সেমিতে নিউজিল্যান্ডের ছোঁড়া ১৫৩ রান ৭ উইকেট ও ১৭ বল হাতে রেখে পেরিয়ে যায় ইংল্যান্ড। আরেক সেমিতে ভারতের ছোড়া ১৯৩ রানের লক্ষ্য জনসন-সিমন্ডস-রাসেলের তাণ্ডবে ২ বল হাতে রেখে পেরিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনালে গ্রুপপর্বের পুরনো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক জয় তুলে ভারত ছাড়ে ক্যারিবিয়ানরা।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আখ্যান
বাংলাদেশ বাছাই থেকে কোনো রকমে কোয়ালিফাই হলেও পরে কোনো ম্যাচে একটিও জয় আনতে পারেনি। না জিতেই সুপার টেন থেকে বিদায় নিলেও ২০১৬ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বেশকিছু ব্যক্তিগত সাফল্য এসেছে। পরিসংখ্যানের পাতায় ভালোই আলো ছড়িয়েছিল টাইগাররা। সবচেয়ে বেশি রান, সর্বোচ্চ ইনিংস, সেরা বোলিং ও সবচেয়ে বেশি ছক্কা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দখলেই ছিল।
এক নজরে বিশ্বকাপ
ভারতের আসরে দলকে ফাইনালে নিতে না পারলেও ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের কচুকাটা করেছিলেন বিরাট কোহলি। নির্বাচিত হয়েছিলেন আসরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে। ওমানের বিপক্ষে একটি শতক হাঁকানো তামিম করেছেন সর্বাধিক রান, তার দখলে ছিল ২৯৫ রান। ড্যাশিং ওপেনারের ১০৩* রানের ইনিংসটিই ছিল আসর সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের হয়ে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ হওয়ার পাশাপাশি এটি ছিল বাংলাদেশের ব্যাটারদের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি শতকও।
আসরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন দ্য ইউনিভার্স খ্যাত ক্রিস গেইল। ১২টি উইকেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেয়ার শীর্ষে ছিলেন আফগানিস্তানের মোহাম্মদ নবী। সেরা বোলিং ফিগারের তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশের সেনশেসন মোস্তাফিজুর রহমান। কাটার মাস্টার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে তুলেছিল ৫ উইকেট। যদিও ব্যাটিং ব্যর্থতায় খুব বাজে হার মেনেছিল টাইগার দল।