বিশ্বকাপ ফুটবলে এখন চলছে শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেওয়ার জোর লড়াই। ব্রাজিল ও পর্তুগাল কাল শেষ ষোলোয় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। এর আগেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। এবারের বিশ্বকাপের অন্যান্য ফেভারিটদের মধ্যে ক্রোয়েশিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম- এই দেশগুলোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা এখন নানান সমীকরণের দোলাচলের মধ্যে রয়েছে। তবে উল্লেখিত দলগুলোর মধ্যে বেশি বিপদে আছে জার্মানি, আর্জেন্টিনা এবং বেলজিয়াম। গ্রুপের শেষ ম্যাচে জয় ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ নেই বললেই চলে।
গ্রুপের শেষ ম্যাচে ৩০ নভেম্বর রাত ১টায় আর্জেন্টিনা লড়বে পোল্যান্ডের বিপক্ষে। একই সময়ে সৌদি আরব লড়বে মেক্সিকোর বিপক্ষে। ১ ডিসেম্বর রাত ৯টায় বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়া একে অপরের মুখোমুখি হবে। একইদিনে রাত ১টায় কোস্টারিকার মুখোমুখি হবে জার্মানি। আসলে প্রথম রাউন্ড শেষে অনেকটাই পরিষ্কার হবে অটুট শক্তিমত্তা দিয়ে কোন কোন দেশ চ্যাম্পিয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন গ্রুপের এখন যে পয়েন্ট সমীকরণ সেখানে বড় ধরনের অঘটন ঘটতেই পারে। এবারের বিশ্বকাপে কম শক্তিশালী দলগুলো বড় বা শক্তিশালী দল হিসেবে ট্রেডমার্ক পাওয়া দলগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। অনেক প্রতিপক্ষ দৃশ্যত তুলনামূলক দুর্বল হলেও খাটো করে দেখার তাই কোনো অবকাশ নেই। ফলে কোনোভাবেই সুনির্দিষ্টভাবে আগাম বলা যাচ্ছে না আর কোন কোন দেশ নিশ্চিত দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠবে।
‘ই’ গ্রুপের কথাই ধরা যাক। এই গ্রুপে রয়েছে স্পেন, জাপান, জার্মানি এবং কোস্টারিকা। প্রতিটি দলেরই দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সম সুযোগ আছে। তবে এই গ্রুপে জাপান কোস্টারিকার বিপক্ষে জয়ী হলে স্পেন ও জার্মানির মধ্যে যেকোনো একটি দলের প্রথম রাউন্ডেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হতো। গ্রুপ ‘সি’তে আর্জেন্টিনা খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। গ্রুপ ম্যাচে শেষ খেলায় পোল্যান্ডকে হারাতেই হবে। ড্র করলেও কিঞ্চিত সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকিয়ে থাকতে হবে সৌদি আরব এবং মেক্সিকোর মধ্যকার ম্যাচের ফলাফলের দিকে। এমন সব নানান সমীকরণ আর আজকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ম্যাচ নিয়ে কথা হয় সাবেক তারকা ফুটবলার মামুন জোয়ার্দ্দারের সাথে।
ফুটবলের সোনালী দিনের শেষ সময়ের এই তারকা অনেকদিন ধরেই কানাডা প্রবাসী। যে ফুটবল তাকে তারকাখ্যাতি দিয়েছিল সেই ফুটবলের মধুময় স্মৃতিটুকু তার জীবনের সেরা সম্পদ হিসেবে আত্মায় ধরে রেখেছেন। ফুটবল বলতে মামুন এখনও ভীষণ পাগল, আবেগী। ঢাকার মাঠে মামুন আক্রমণভাগে দ্যুতি ছড়িয়েছেন অনেক অনেকদিন। বল ধরেই মাথা নিচু করে ক্ষিপ্রগতিতে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে পড়তেন। ঢাকার মাঠের উন্মাতাল ফুটবল দর্শকদের মন তিনি জয় করেছিলেন ড্রিবলিং আর গতি উপহার দিয়ে।
এবার কোন দেশ চ্যাম্পিয়নের দাবিদার? এমন প্রশ্নে মামুন বললেন, এবারের বিশ্বকাপে আরও নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে। দ্বিতীয় রাউন্ডেই সেসব ঘটনা আরও দৃশ্যায়িত হবে। বিগত দিনে যারা বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন কোনো দেশের চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফ্রান্স, স্পেন, জার্মান, ব্রাজিল- এসব দেশের বাইরে নতুন কেউ এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মামুন বলেন, ‘এবারের প্রতিটি ম্যাচের ট্রেন্ড আলাদা। কম শক্তিশালী দল বলে কিছু নেই। সবাই সমানে সমান লড়াই করছে। আর্জেন্টিনা, জার্মানি, বেলজিয়ামের মতো দলের গ্রুপ ম্যাচে পরাজয় নানান সম্ভাবনার উঁকি দিচ্ছে। এ কারণেই সামনের ম্যাচগুলো আরও ঘটনাবহুল হতে পারে।’
বিশ্বকাপে ফ্রান্সের খেলা বেশ ভালো লেগেছে মামুনের। তবে জার্মানি তাকে ভীষণ হতাশ করেছে বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, ‘জার্মানি সেই আগের মতো নেই। এই দলটি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জার্মানির খেলায় যে অবারিত শক্তির সৌন্দর্য ছিল তা যেন মাটিতে মিশে গেছে।’
এবারের বিশ্বকাপে এশিয়ার টিমগুলোর পারফরম্যান্স আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও ভালো বলে মনে করেন তিনি। তার দৃষ্টিতে সৌদি আরব, জাপান, সাউথ কোরিয়া খুবই ভালো খেলেছে। কাল সাউথ কোরিয়ার পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। বলেন, ‘ভাগ্যের ফেরে বঞ্চিত হল সাউথ কোরিয়া। প্রাপ্ত সুযোগগুলো পরিপূর্ণতা পেলে কোরিয়ানরা হাসিমুখে মাঠ ছাড়তে পারত। কিন্তু সেটা আর হয়নি।’
আজ রাত ১টায় সবার নজর থাকবে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দিকে। আজ ইরান জয়ী হলে প্রথমবারের মতো নকআউট পর্বে যাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করবে। গত ম্যাচে ওয়েলসকে হারিয়ে তারা দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সব স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে। নিজস্ব গ্রুপ ‘বি’তে পয়েন্ট তালিকায় ইরান দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই গ্রুপের পয়েন্ট সমীকরণে ইরান ড্র করতে পারলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
শুধু রাজনীতির ময়দান বলে নয়, ফুটবল ময়দানেও ইরান-যুক্তরাষ্ট্র লড়াই বরাবরই আকর্ষণীয়। তবে ফুটবল লড়াইয়ে ইরান এগিয়ে। এ পর্যন্ত এই দুদলের মুখোমুখি লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ইরানকে পরাজিত করতে পারেনি। বরং ’৯৮-এর বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে পরাজিত করার স্মৃতিই ইরানের বড় শক্তি। সেবার গ্রুপ পর্বের (এফ) খেলায় ইরানের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। ইরান যুগোস্লাভিয়া ও জার্মানির কাছে পরাজিত হলেও রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রকে ঠিকই পরাজিত করেছিল।
এই ম্যাচ নিয়ে মামুন বলেন, ‘ওয়েলসকে ইরান হারাতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রকে হারানো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের টিম স্পিরিট অনেক ভালো। বিগত দুটি ম্যাচ তারা খারাপ খেলেনি। তবে এই দেশের বিরুদ্ধে ইরান বরাবরই জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে। ইরানের প্লেয়ারদের একটু বয়স বেশি হওয়ার কারণে দমে ঘাটতি আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা আগে লিড নেবে তারা অনেক এগিয়ে থাকবে ম্যাচ কন্ট্রোলিং-এর ক্ষেত্রে। যে কথা আগেই বলেছি, এশিয়ার ফুটবলে মান অনেক বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে। আজ যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যকার ম্যাচটি হোক উপভোগ্য, আনন্দময়। ইরান প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে যে বিষাদ, যে দুঃখবরণ করে নিয়েছে তা আজ শোধরাতে পারলে সেটাও হবে ইতিহাস। তবে মনে রাখতে হবে আমেরিকাও জেতার জন্যই খেলবে।’