চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘খণ্ডহর’কে ঘিরে আজও মৃণালকে স্মরণ করে যে গ্রামের মানুষেরা

‘খণ্ডহর’কে ঘিরে আজও জন্মদিনে মৃণাল সেনকে স্মরণ করা হয় আউশগ্রামের কালিকাপুর রাজবাড়িতে! ভারতের পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অমরপুরের জঙ্গলমহলে আজও তাঁর জন্মদিন এলেই ক্যালেন্ডারের তারিখের পাশে হাত বোলান অশতীপর বৃদ্ধ লাজপত রায়। তিনি কালিকাপুর জমিদার বাড়ির প্রবীণ সদস্য। দীর্ঘ দিন জমিদারবাড়ির দুর্গা পূজোর ম্যানেজার ছিলেন তিনিই। তিনি আর তাঁর স্ত্রী মিলিয়ে খণ্ডহরের শুটিং করতে আসা পরিচালককে খাইয়ে ছিলেন আলু পোস্তো, ডাল, ভাত আর বাড়ির পুকুরের মাছের ঝোল। সেই সুখস্মৃতিই মনে পরে জীবন সায়হ্নের স্মৃতিতে। তাঁর বাড়ির উঠান, ছাদ, উপরতলায়, গলি এবং দুর্গাদালান, শিবমন্দির এবং মহলের আরও বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়েছিল ‘খণ্ডহর’ ছবির।

বর্তমানে জীবিত দুর্গাদালানের পিছনের মহলে রয়েছেন রাজ পরিবারের লাজপত রায় আর তাঁর স্ত্রী। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। তিনি বলেন, ‘মৃণাল বাবু এসে বসতেন শুটিং এর ফাঁকে আমার বারান্দায়। হালকা পাজামা আর প্যান্টালুম, সাদা রঙের পোশাকে বেশ মানাতো তাঁকে। চোখের কালো চশমার ভেতরে গভীর চোখে, স্থির হয়ে কথা বলতেন। খুব যোগাযোগ রাখতেন। ফোন করতেন।’ আরও এক জীবন্ত কিংবদন্তী পরিচালক তরুণ মজুমদারের সঙ্গে পরিবারটির দীর্ঘ দিনের সখ্যতা রয়েছে।
তবে মৃণাল সেনের জন্মদিন এলেই মনে পরে তাঁদের। স্মরণ করেন শ্রদ্ধায়। বাড়ির সেই চৌকিটিকে জন্মদিনে সম্মান জানান লাজপত আর তাঁর স্ত্রী। ভগ্ন খণ্ডহরের দিনগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মৃণাল সেন হাঁটছেন, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা বন্দী চোখ, নাসিরুদ্দিন, শাবানারা বসে রয়েছে শটের ফাঁকে বাড়ির বারান্দায়। স্মৃতির প্রেক্ষাপটে এই সবই মনে পরে বৃদ্ধ দম্পতির।

সেখানকার দুর্গামন্দির আর নাটমন্দির ও লালু ওরফে লাজপত রায়ের বাড়ি ও দুর্গামন্দিরের গলি, উঠান, উপরে এবং তার চারপাশের বারান্দাতে খণ্ডহরের বেশ কিছু দৃশ্যের শুট হয়েছিল। সিনেমা শুরুর ২৭ মিনিটের মাথায় নাসিরুদ্দিন শাহ, পঙ্কজ কাপুর আর অন্নু কাপুরের কথোপকথনের একটা লম্বা দৃশ্য এখানেই তোলা হয়েছিল, লালু বাবুর উঠানেই। অসম্ভব ভালো ভিজ্যুয়াল, ক্যামেরা খুব সুন্দরভাবে গোটা জায়গাটাকে ধরেছিল। সিনেমার দৃশ্যে দেখা যায় কথাবার্তা বলতে বলতে ফটোগ্রাফার সুভাষ (চরিত্রের নাসিরুদ্দিন শাহ) এখানে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলেন, কালিকাপুরের মহলেই।

যে সিনেমা আজ ইতিহাস! সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রর ছোটগল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’-কে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাসের সেই সিনেমাটি। পরিচালক মৃণাল সেনের নক্ষত্রখচিত কাস্ট। ছবিটির মুখ্য চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, পঙ্কজ কাপুর আর অন্নু কাপুর। বাংলা সিনেমা জগত থেকে ছিলেন শ্রীলা মজুমদার এবং রাজেন তরফদার। ছায়াছবিতে শাবানা আজমির মায়ের ভূমিকার অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী গীতা সেন! যিনি ছিলেন পরিচালক মৃণাল সেনের স্ত্রী।

ছবির গল্প শুরু হয় তিন বন্ধুকে ঘিরে। এই তিন বন্ধু একসময় শহর ছেড়ে এক গণ্ডগ্রামে গিয়ে দিন তিনেকের ছুটি কাটানোর জন্য যান। আর সেই ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতা ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সিনেমার কাহিনি। এদের মধ্যে একজন সুভাষ (নাসিরুদ্দিন শাহ) পেশায় আর নেশায় ফটোগ্রাফার। বেড়াতে বেড়িয়ে এক সন্ধ্যায় এদের মধ্যে একজন দীপুর (পঙ্কজ কাপুর) আত্মীয়ের গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায় এই তিন বন্ধু। এর পরের আড়াই দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই চিত্রনাট্যের জাল বোনা শুরু হয়।
গল্পের যে বাড়িতে তিন আগন্তুক এসে পৌঁছায়, গ্রামের সেই বাড়িটি কোন মামুলি বাড়ি নয়, বরং বলা যায় এক সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ ছিল। সে বাড়ির অতীত গৌরব বহু আগেই অন্তর্হিত। এখন সেটি ভগ্নপ্রাসাদে পরিণত হয়েছে। বিশাল বিশাল থাম, বিরাট দুর্গাদালান, সামনের নাটমন্দির, কড়িবর্গার অলিন্দ সব কিছু নিয়ে অতীত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে কোনওমতে শুধু টিকে রয়েছে, প্রকৃতির মাঝে। বিশাল এই পোড়ো ভগ্ন প্রাসাদের বাসিন্দা মাত্র দু’টি মানুষ। অসুস্থ, শয্যাশায়ী একজন এবং দৃষ্টিহীন এক মহিলা (চরিত্রে গীতা সেন) আর তাঁর একমাত্র অবিবাহিত মেয়ে যামিনী ( তার চরিত্রে শাবানা আজমি)। এই রাজপ্রাসাদের ইতিহাস কাহিনী।

অন্তিম শয্যায় অন্ধকার জড়ো জীবনে বৃদ্ধা একটিমাত্র ক্ষীণ আশা নিয়ে বেঁচে আছেন। আর কোনো স্বাদ নেই। যামিনীকে পাত্রস্থ করবেন তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় নিরঞ্জনের হাতে, এই স্থির করে রেখেছেন। চার বছর আগে কোনো এক সময় নিরঞ্জন এখানে এসে তাঁকে কথা দিয়ে গিয়েছিল যামিনীকে সে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। তবে কথা রাখেনি সে। সে আর হয়নি। নিরঞ্জন কথা না রেখে, আর কোনও দিন ফিরেও আসেনি এই রাজবাড়িতে। ছবির বাস্তবে সে বিয়ে করে গল্পের মতো সংসারী এবং শহরবাসী। তবে সে খবরটুকুও বৃদ্ধাকে জানানো হয়নি, আশার শেষ প্রদীপটুকুও হঠাৎ নিভে যাবে সেই আশঙ্কায়। যামিনী নিজেও জানে এই ঘটনা। তবুও মুখ বুজে আছে। শুধু মায়ের জন্য। আর এ জীবনে সে শুধু দেখভাল আর সেবা করে যায় অসুস্থ মাকে।

মা ও মেয়ের এই নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎই আবির্ভাব তিন বন্ধুর। কোন এক মুহূর্তে, ভাগ্যের পরিহাসে, দীপু এবং তার বন্ধুদের উপস্থিতি মেয়ের চিন্তায় জর্জরিত দৃষ্টিহীন এই হতভাগ্য মহিলার মনে বিশ্বাস তৈরি করে। যে নিরঞ্জনই আবার ফিরে এসেছে দীপুর সঙ্গে। আশা জাগে। সে এসেছে কথা রাখতে, যামিনীকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে এমনটা ভাবে। বৃদ্ধার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার কথা ভেবে তাঁর এই ভুল ভাঙাতে যামিনী বা দীপু কেউই সাহস করে উঠতে পারে না এই ভেবে, যদি কিছু ঘটে যায়। গল্পের বাঁকবদলে এক সময় আসে সেই মুহূর্ত যেখানে দীপু দেখা করতে আসে শয্যাশায়ী বৃদ্ধার ঘরে, তার সঙ্গে। তার সঙ্গে তার ঘরে আসে সুভাষও। বৃদ্ধা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন আনন্দে দীপুর সঙ্গে নিরঞ্জন এসেছে এই ভেবে। বৃদ্ধার বারংবার প্রশ্নের উত্তরে ঘরের সবাই নিশ্চুপ। ডাকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অস্থির বৃদ্ধা অসহায়ভাবে ডাকতে থাকে। হাত বাড়িয়ে নিরঞ্জনকে খুঁজতে থাকেন। ঘটনার আকস্মিক অভিঘাতে অনেকটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে চরিত্রের সুভাষ। কয়েক মুহূর্তের ইতস্ততা কাটিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বৃদ্ধার বাড়ানো হাত ধরে। নিরঞ্জন ভেবে পরম নিশ্চিন্তে বৃদ্ধাও আঁকড়ে ধরেন সুভাষের হাত। তারপর জিজ্ঞাসা করেন যামিনীকে সে বিয়ে করবে কিনা? এক লহমায় সুভাষের সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে যায়। সেই মুহূর্তেই বৃদ্ধার ভুল ভাঙানোর মতো মানসিক জোড় সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি সে। বৃদ্ধার হাত ধরা অবস্থাতেই ‘হ্যাঁ’ বলে দেয় সে। এরপর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন বৃদ্ধা, বিছানায়।

এই ঘটনার পরেই দগ্ধ পরিচালক যামিনী এবং সুভাষের মধ্যে এক সূক্ষ জীবনরসায়ন তৈরির মুহূর্তগুলি দেখান। যার বেশিরভাগটাই অনুচ্চারিত ছবি জুড়ে। ছবিতে দেখা যাবে যামিনী একবার একান্তে সুভাষকে পায়। সেও হয়তো কিছু বলতে চায় সুভাষকে। তবে ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আর কিছু মুখ ফুটে বলে উঠতে পারে না সে সময়। চরিত্র জীবনের কিছু কথা অব্যক্তই রয়ে যায়, এই সময়। যামিনীর অসহায়তা সুভাষকে কিছুটা নাড়া দেয়। সুভাষও হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল এই নিয়ে, তবে বাস্তবকে স্বীকার করে বলে উঠতে পারেনি সেও গল্পের বাঁকে। শুধু কিছু নিঃশব্দ কাটাছেঁড়া চলতে থাকে দু’জনের মনের গহীনে। তৈরি হয় জীবন চরিত্রের রসায়ন।

ছবি জুড়ে সব কিছুই থেকে যায় অনুচ্চারিত। শেষে সুভাষের স্টুডিওতে যামিনীর সাদা-কালো পোর্ট্রেট ক্ষণিকের স্মৃতি হয়েই ঝুলতে থাকে। রক্তমাংসের চরিত্ররা তো আছেনই, তাঁদের ছাপিয়েও পুরো সিনেমাটা জুড়েই এই প্রাচীন ভগ্নপ্রায় বিশাল প্রাসাদটা নিজেই এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছে যেন। এই পৃথিবীর বুকে এই বাড়িটি যেন আলাদা একটা গ্রহ, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, ধীরে ধীরে তাও অবধারিতভাবে এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের দিকে, সঙ্গে এই গ্রহের বাসিন্দা দু’টি মানুষকেও একই পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের আবহে। খণ্ডহরের বাসিন্দা যামিনী আর তার মায়ের জীবনের গল্প বাড়িটির মতোই ভাঙাচোরা। হারিয়ে যাওয়া অতীত পরে রয়েছে। যেখানে কোনও ভবিষ্যৎ নেই, আশার আলো নেই, শুধু বেঁচে আছে এক ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানের নিরেট অন্ধকারে।

বাড়ির প্রতিটি ঘরে, অলিন্দে, প্রকাণ্ড থামগুলোর আবডালে, বারান্দায় ছাদে শুধু চাপচাপ অন্ধকার আর বিষাদ মাখামাখি হয়ে আছে। সূর্যের আলোও আর কোন নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হয় না। আর সেই অন্ধকার যেন ছড়িয়ে গেছে যামিনীর জীবনে, তার মায়ের চোখে। নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও ভবিতব্য নেই।

জানলে অবাক হবেন কোন একটিমাত্র বাড়ি নয়, চার-চারটি বাড়ি মিলিয়ে শুটিং হয়েছিল এই কালজয়ী সিনেমার। অসাধারণ এডিটিংয়ের কাজে চারটি বাড়ি মিলেমিশে এক হয়ে গেছে যেন, দর্শক ধরতেই পারবেন না কেমন চরিত্রের আদলে মিশে গেছে বাড়ির কড়িবর্গার সঙ্গে প্রাচীনত্ব আর ইতিহাস। কিংবদন্তী পরিচালক মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’ ছবির সিংহভাগ শুটিং হয় ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম জঙ্গলমহলের পরমানন্দ রায় প্রতিষ্ঠিত কালিকাপুর রাজবাড়িতে, পশ্চিম বঙ্গের বীরভূমের বোলপুরের অদূরে চৌপাহারি জঙ্গল লাগোয়া রায়পুরের লর্ড সিনহার বাড়িতে এবং কলকাতার বিজয় মঞ্জিল বা বর্ধমান হাউসে, সেইসঙ্গে বাওয়ালি রাজ এ।

এই চারটি বাড়ির মধ্যে সিনেমার সিংহভাগ অংশ জুড়েই আছে কালিকাপুর রাজবাড়ি। একে একে মহাজনের ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে এর প্রশস্ত কোর্ট ইয়ার্ডে, অলিন্দে, তিনশো বছরের প্রাচীন দুর্গামণ্ডপে, দালানে, নাটমন্দিরের থামের আড়াল দিয়ে আর সাতমহলা জমিদারবাড়ির ইতিউতি জুড়ে। সিনেমা শুরুর সাতাশ মিনিটের মাথায় যখন দেখানো হয় তিন বন্ধু গল্প করছে এক উঠোনে যেখানে থামের সারি সেটা এই কালিকাপুর রাজবাড়ির চত্বর, সুন্দর দীর্ঘ উঠান।

এই ছবির শুটিং হয়েছে বজবজের কাছে বাওয়ালি রাজবাড়িতে। কালিকাপুর রাজবাড়ির অন্দরমহলের ঘর আর বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই, তাই ঘরের দৃশ্য যেখানে যামিনীর মা এক বিশাল ফোর পোস্টার বেডে শয্যাশায়ী, সেটি আসলে বাওয়ালি রাজার একটি ঘর। বর্তমানে এটি একটি মহার্ঘ হেরিটেজ হোমস্টে।

এছাড়াও বাড়ির ছাদেও বেশ কিছু দৃশ্যের শুট করা হয়েছে। এক জায়গায় দেখা যায় ছাদে আরামকেদারায় বসে রোদ পোহাতে পোহাতে তিন বন্ধুর কথোপকথন আর এক জায়গায় শীলা মজুমদার এবং শাবানা আজমির একসঙ্গে শট যেখানে শীলা মজুমদার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করছেন সুভাষের বিষয়ে। এই শটগুলোতে ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায় একটি পঞ্চরত্ন বিশিষ্ট টেরাকোটার মন্দির। এটি কালিকাপুরের বিখ্যাত জোড়া শিব মন্দির। ছাদ থেকে দেখা মন্দিরটি হল বাওয়ালি রাজপরিবারের কূলদেবতা রাধাকান্তের মন্দির। বেশ কিছু শট নেওয়া হয়েছিল বাড়ির উঠোনের মধ্যেই এক কুয়োতলায়। কিছু জল তোলা এবং বাসন ধোয়ার দৃশ্য রয়েছে ছবি জুড়ে। এটাই হল বীরভূমে লর্ড সিনহার বাড়ি। আর এই বাড়ির চত্বরেই রয়েছে কুয়োতলাটি।

বর্ধমান হাউস সাজানো গোছানো বাড়ি। এখানকার রাজকীয় কাঠের সিঁড়িতে সুভাষের স্বপ্নদৃশ্যটি শুট করা হয়েছিল। খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখানো হয়েছিল সুসজ্জিতা যামিনী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। এডিটরের কৃতিত্ব হল এই সবকটা প্রাচীন বাড়িকে সুন্দরভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারটি বাড়ি মিলিয়ে শ্যুটিংয়ের উদ্দেশ্য হয়তো ছিল বাড়ির ব্যাপ্তি ছবির দর্শকদের কাছে ফুটিয়ে তোলার। আর একটি বাড়িতে হয়তো সবক’টা দরকারি এলিমেন্ট পাওয়া যেত না, তাই পরিচালক এটি করেছিলেন।

ফিরে আসি কালিকাপুর রাজবাড়িতে কিংবদন্তী পরিচালকের কালজয়ী ছবির তৈরির গল্পে। এই বাড়িটিকে, গ্রামটিকে ঘিরে আমার দীর্ঘ গবেষণার কাজ। আমার তৈরি শুটিং করার ছবির তালিকা, ইতিহাসের শেষপ্রহরের অবশিষ্ট জমিদার বাড়ির ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার এখন সবার টোকার বিষয়। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে অজয়নদের তীরের এই মৌখিড়ার অদূরে কালিকাপুর গ্রামের জমিদার বাড়িটির দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। গড় জঙ্গলের ছোঁয়া মাখা, বর্ধমান রাজাদের শেষ অবশিষ্ট দেওয়ানের ইতিহাসখ্যাত সাত মহলা বাড়ি আমার অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। ঘন শালের জঙ্গল আর তার বুক চিরে রাস্তা চলে গেছে কালিকাপুরের দিকে, লালমাটির রাস্তায় গত বছর পিচ হয়েছে। আউশগ্রামের এই জঙ্গলে খোয়াইয়ের দৃশ্য অপূর্ব। পানাগড় সিউড়ি স্টেট হাইওয়ে থেকে ১১ মাইলের মোড়ে আউশগ্রামের দিকে ঢুকতে ২ কি.মি. পথ কালিকাপুর গ্রাম। প্রাইমারি স্কুলের দীর্ঘ মাঠ, জঙ্গলঘেরা পেরোলেই সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা, একটা দীর্ঘ পুকুর লালদীঘি আর কালিকাপুর রাজবাড়ির অবয়ব দৃশ্যমান হবে। সাতমহলা বাড়ির ভিতরে রয়েছে বাড়ির পুকুর এবং পাশে রাজারপুকুর। গ্রাম বাইরে মৌখিড়া যাওয়ার পথে রয়েছে চাঁদনি। ছিল নীলকরদের নীলকুঠি। রাজাদের ঠাকুর রাধাবল্লভের মন্দির প্রতিষ্ঠিত না হলেও সেখানকার ভগ্নঅতীতের দালানের ভেতরে রয়েছে পুকুর রাধাবল্লভ। তবে রাজার পরিচিতি নিয়ে জমিদারদের এই রাধাবল্লভ, জোড়া শিবমন্দির, দুর্গাদালানের দুর্গার পুজো করেন অভিনেতা পিগলু ভট্টাচার্য। এখনও পর্যন্ত কালিকাপুরে ৩৪২ টি ছবির শুটিং হয়েছে। এখানেই সুজয় ঘোষের ‘তিন’ ছবির শুটিং এ এসেছিলেন বলিউডের জীবন্ত কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চন। কে আসেননি এখানে? দেশ বিদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বহু পরিচালক এসেছেন এখানে।

অজয় নদের তীরে মৌখিরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন সদগোপ বংশীয় রায়রা। এই পরিবারের কর্তা ছিলেন অতীতের পিছনের ১২তম পরমানন্দ রায়। শোনা যায় তিনি ছিলেন বর্ধমান রাজ পরিবারের নায়েব। আর তার সুবাদেই তিনি কৃষি ও নদী পথের ব্যবসায় প্রভূত অর্থ উপার্জন করে জমিদারি পত্তন করেন। কালিকাপুরের এই রায় পরিবারের আদি নিবাস ছিল আউশগ্রামের নদী তীরের মৌখিরাতে। কালিকাপুরের রায় পরিবারের সুবীর রায়, লাজপত রায়, অসিত রায়দের থেকে জানা যায়, প্রতিবছর বর্ষায় অজয় নদের বানে প্লাবিত হত মৌখিরা, ভোগাতলা, মঙ্গলপুর, হরিনাথপুর গ্রাম গুলো। সেজন্যই জমিদার পরমানন্দ রায় কিছুটা দূরে বনলাগোয়া উঁচু ডাঙায় কালিকাপুরে চলে আসেন বসতি নিয়ে। বর্ধমান রাজাদের একশো বিঘার কালী রয়েছে সেখানে। সেই কালীর নামেই গ্রামনাম হয়েছে কালিকাপুর। কালিকাপুরের প্রাসাদ তৈরি হয় ইংরেজির ১৮১৯ সনে। এটি আক্ষরিক অর্থেই সাতমহলা বাড়ি। পরমানন্দ রায় তাঁর সাত ছেলে কিংবা বিতর্কে বলা হয় তার সাত ভাইয়ের জন্য সাতটি মহল তৈরি করেন, পাশাপাশি। এর সঙ্গে যোগ হয় একটি রাজকীয় দুর্গাদালান আর সংলগ্ন বিরাট পর্দানশিন নাটমন্দির। এছাড়াও মূল প্রবেশদ্বারের ঠিক বাইরে বাঁ-দিকে তৈরি হয় একজোড়া হংশেশ্বর ও পরমেশ্বর নামের শিবমন্দির। দুর্গাদালানের ঢুকার গেটে রয়েছে সাইন বাদকদের আসন।

শুধু খণ্ডহর নয়, আরও বেশ কিছু সিনেমার পটভূমি ছিল এই রাজবাড়িই। যদিও ‘খণ্ডহর’ সিনেমাতেই এই বাড়িটি সবচেয়ে ভালোভাবে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। আর অপর্ণা সেনের ‘গহনার বাক্স’ ছবিটিও, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ এখানেই নির্মিত।

কালিকাপুরে শুটিং হওয়া ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ সিনেমাটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ইতিহাসবিদ সোনাদার রোমাঞ্চকর অভিযান। ইতিহাসের সঙ্গে রহস্য থ্রিলারের মিশিয়ে দেওয়া, অনেকটা যেন বাঙালি প্রফেসর ইন্ডিয়ানা জোনস। যাঁরা সিনেমাটা দেখেছেন তাঁরা কালিকাপুরের জোড়া এই শিব মন্দিরদু’টিকে দেখলে রিলেট করতে পারবেন। সিনেমায় এই মন্দিরের গর্ভগৃহের তলাতেই ছিল লুকোনো সুড়ঙ্গের মুখ যার নিচে গুপ্তধনের ভাণ্ডার। বাস্তবে অবশ্যই তেমন কিছু নেই। এই সিনেমার শুরুতে সোনাদা যখন গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের পথে আসছে, সেই শটগুলি এই রাজবাড়িতে আসার পথেই নেওয়া। প্রসেনজিৎ এর অভিনয়ের নতুন ছবি, মুক্তির অপেক্ষায় ‘আয় খুকু আয়’, এর বেশির ভাগ অংশের শুটিং হয়েছে এখানে।

ল অ্যাওয়ার্ড পান সেরা ডাইরেক্টর হিসেবে আর শাবানা আজমি পেয়েছিলেন সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা। একইসঙ্গে ছবিটির এডিটর মৃন্ময় চক্রবর্তী পান সেরা এডিটরের সম্মান। এ ছাড়াও শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ফিল্ম হিসাবে গোল্ডেন হুগো আর মন্ট্রিয়ল ফিল্ম ফেস্টিভালে দ্বিতীয় সেরার পুরস্কার জিতে নেয় ‘খণ্ডহর’। মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’। কালিকাপুর আর সেখানকার রায়রা বলেন আমাদের ‘খণ্ডহর’।