কাতার বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বল ‘আল রিহলা’। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অ্যাডিডাসের এই বলটি অত্যন্ত উচ্চ-প্রযুক্তির ফুটবল। বলটি পাম্প করতে হয় না, বরং চার্জ করলে ৬ ঘণ্টার মতো খেলা যায়। সবকিছু ঠিক থাকলেও, এবারের বিশ্বকাপে রাউন্ড অব সিক্সটিন শেষ হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এখন পর্যন্ত ফ্রি-কিকে গোল হয়েছে মাত্র দুটি। এই রহস্যময়ী ফুটবলটি কেমন তা জানার চেষ্টা করেছি আমরা।

একটি গোল এসেছে গ্রুপ স্টেজে ওয়েলসের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের মার্কাস র্যাশফোর্ডের ডান পা থেকে, আর দ্বিতীয় ফ্রি-কিক গোলটি পেয়েছেন বাঁ-পা থেকে সৌদি আরবের বিপক্ষে মেক্সিকোর লুই শাভেজ। র্যাশফোর্ডের গোলটি ২০ ইয়ার্ড দূর থেকে কিছুটা কোণাকুণি বক্সের বাম দিক থেকে ঘণ্টায় ১১৫.৬৩ কিলোমিটার বেগে গোলকিপারের বাম দিকে প্রায় টপ কর্নারে। আর শাভেজের গোলটি ৩২ ইয়ার্ড দূর থেকে বক্সের মাঝ-বরাবর ঘণ্টায় ১২১.৬৯ কিলোমিটার বেগে গোলকিপারের বাম দিকে টপ কর্নারে বেশ খানিকটা বাঁক নিয়ে।
সেট-পিস এক্সপার্ট ইংল্যান্ডের ফুল-ব্যাক কাইরেন ট্রিপিয়ের বলছেন, আল রিহলা বলটি ক্রস এবং শুট করার সময় অন্য বলের চেয়ে বেশি হালকা অনুভব হয়। আল রিহলা শব্দের অর্থ যাত্রা বা যাত্রা করা। বিশেষত যখন বলটি শূন্যে থাকবে তখন দ্রুতগতিতে যাত্রা করবে। গ্রাউন্ড স্পিড-ও থাকবে, তবে তা আকাশে ওড়ার সময়কার মতো নয়। যদি বল বেশি জোরে মারা হয়, তাহলে হোক সেটি ক্রস, ফ্রি-কিক বা তীব্র শুট, তাহলে বলটি আকাশের দিকেই বেশি উড়ে যাবে। আর তেমনটিই দেখা গেছে রাউন্ড অব সিক্সটিন পর্যন্ত। বলটি রানিং অবস্থায় পোস্টে রাখতেও হিমশিম খেতে দেখা গেছে খেলোয়াড়দের।
আল রিহলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস অবশ্য বলের এই আকাশপথে দ্রুতযাত্রা নিয়ে গর্বই করছে। তারা বলছে, বিশ্বকাপের অন্যান্য ফুটবলের চেয়ে এই বলটি আরও দ্রুতগতির। বলটির আকার এমন যেটি আরও বেশি টার্গেটে যাবে, আকাশে ওড়ার সময় স্থিরতা থাকবে আর বাঁক-ও নেবে, এমনটাই দাবি অ্যাডিডাসের। খেলায় অবশ্য এসবের খুব কম প্রতিফলন দেখেছি আমরা। বিশেষ করে এইটিন-ইয়ার্ড বক্সের বাইরে রোনালদো, মেসি, নেইমারসহ বেশকিছু ফ্রি-কিকের সুযোগ পেয়েছেন বহু নামী-দামি খেলোয়াড়। কিন্তু গোল হয়েছে মাত্র দুটি। তাই অ্যাডিডাসের কথার সাথে এই মুহূর্তে একমত হতে পারছি না।
২০১০ সালের বিশ্বকাপে জাবুলানি বলটি নিয়েও প্রচুর কথা হয়েছিল, বিশেষ করে গোলকিপাররা খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। ইংল্যান্ড কিপার জাবুলানি বলটিকে অভিহিত করেছিলেন ‘জঘন্য’ হিসেবে, আর ফ্রেঞ্চ কিপার হুগো লরিস বলটির নাম দিয়েছিলেন- ‘বিপর্যয়’।
২০১০ বিশ্বকাপে সমস্যা ছিল গোলকিপাররা জাবুলানি বলটিকে কোনোভাবেই সামলাতে পারছিলেন না, কারণ বলটি এতো বেশি দিক পরিবর্তন করছিল গতির সাথে যা ভাবাই যায় না। তবুও অ্যাডিডাস তখন বলেছিল, ফুটবল সৃষ্টির ইতিহাসে সবচেয়ে গোলাকৃতি বলটিই ছিল জাবুলানি, জুলু ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়, আনন্দ করা। গোলকিপারদের জন্য আনন্দজনক না হলেও গোল যারা করেছেন, তাদের জন্য জাবুলানি যে আনন্দময় ছিল, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আল রিহলা বলটির ভেতর রয়েছে মোশন সেন্সর, যাতে ভিএআর সিদ্ধান্তগুলো নেয়া সহজ হয়ে গিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বলটিকে রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করা যাচ্ছে। ফিফার সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তির সহায়তায় সব ধরনের তথ্য দিচ্ছে আল রিহলা। সেন্সরটির ওজন মাত্র ১৪ গ্রাম। সেন্সরটি তৈরি করেছে কাইনেক্সন। বলটিকে পরীক্ষা করা হয়েছে গবেষণাগারে, বাতাসের টানেলে এবং ফুটবল মাঠেও।
কিছুদিন আগে রেডিট-এ একটি ছবি পোস্ট করা হয়, যেখানে দেখা যায় খেলার আগে আল রিহলাকে স্মার্টফোনের মতোই চার্জ করা হচ্ছে। বলের ভেতর যে সেন্সরটি রয়েছে তা চলছে একটি ছোট্ট ব্যাটারি দিয়ে। পুরো তথ্য কাইনেক্সনের ব্যাকএন্ড সিস্টেমে মুহূর্তের মধ্যেই চলে আসে মাঠের পাশেই স্থাপিত অ্যান্টেনার মাধ্যমে।
এ তো গেল বল-প্রযুক্তির কথা। ফিরে যাই ফ্রি-কিকের আলোচনায়। যে দুটি গোল এই বিশ্বকাপে হয়েছে ফ্রি-কিক থেকে তা একটু দূর থেকেই হিট করা হয়েছে এবং বেশ জোরে হিট করতে হয়েছে। ফুটবলটির প্রযুক্তিগত সংযোজন কোনো কারণে প্রভাব ফেলেছে কি না তা ফিফা, অ্যাডিডাস বা কাইনেক্সন জানায়নি খোলাসা করে, তবে এটি বেশ বোঝা যাচ্ছে যে ফ্রি-কিক থেকে আল রিহলাকে জালে পাঠাতে হলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কৌশল রপ্ত করতে হবে।
সবশেষ কথা, মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। বারবার ফ্রি-কিকের অনুশীলন ছাড়া আর কোনো গতি নেই। নিশ্চয়ই কোচ, সাপোর্ট স্টাফ এবং ফুটবলাররা এই বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি করে ভাবছেন কোয়ার্টার ফাইনালের আগে।
কারণ, ফ্রি-কিকের মতো সেট পিস থেকে ম্যাচের চেহারা পাল্টে যায় এবং এইটিন ইয়ার্ডের বাইরে প্রতিটি ইঞ্চিতে একটি ফ্রি-কিক মহামূল্যবান। আর প্রত্যেকটি স্কোরিং সুযোগ কে না কাজে লাগতে চায়। তাই মনে হচ্ছে, আল রিহলাকে আরও বেশি অধ্যয়ন করেই কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচের যাত্রা শুরু করবে আটটি দলই।