৩২ দলের ‘ফুটবল-উৎসব’ থেকে এরমধ্যেই রণেভঙ্গ দিয়ে ফিরে গেছে ২৪ দল। ৬৪ ম্যাচের বিশ্বকাপে শেষ হয়েছে ৫৬ ম্যাচ। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী, ফাইনাল মিলিয়ে ম্যাচ বাকি আট, কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হওয়ার আগে টিকেও আছে আটটি দল। এশিয়ার বিশ্বকাপে এখন আর টিকে নেই এশিয়ার একটিও দেশ। পাঁচটি ইউরোপ, দুটি ল্যাটিন আর আফ্রিকার একমাত্র প্রতিনিধি মরক্কো।
বিশ্বকাপের উৎসবে লেগেছে ভাটার টান। দোহার রাস্তায় এখন দেশ-বিদেশের ফুটবল ভক্তদের হরহামেশার মিছিল চোখে পড়ে না। সবচেয়ে করুণ দশা আয়োজক কাতারের ‘ফুটবল-ভক্তদের’। দুর্দান্ত এক আসর আয়োজনে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিলেও, মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে বড়মুখ করে কিছু বলতে পারছে না মেজবানরা। নিজেদের মাটিতে বসা বিশ্বকাপে সবার আগে বিদায় হয়েছে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন কাতারের, গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই হার।
এরপর কাতারের ভক্তদের দেখেছি এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য গলা ফাটাতে। জাপান, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া, ক্যামেরুনের কারণে প্রাণবন্ত ছিল রাতের দোহার রাজপথ। দামী, বিলাসবহুল গাড়ীর দ্রুতগতিতে ছুটে চলা, ক্রমাগত হর্ন আর চিৎকার, বিজয়োল্লাসে মানুষ উদযাপন করেছে ছোট দলের কাছে বড় দলগুলোর নাকাল হওয়ার উৎসব।
সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনকে আশরাফ হাকিমি ও জিয়েচের মরক্কো বিদায়ঘণ্টা বাজাল সেই রাতে দোহার রাস্তায় হাঁটতে সত্যিই ভয় পেয়েছি, যদি উন্মত্ত গাড়ীর একটি ফুটপাতে উঠে পড়ে! কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে কতটা সামলাতে পারবে মরক্কো, তা নিয়ে সংশয় আছে। যদি পর্তুগালকে মরক্কো হারাতে পারে তবে সেদিন পুরো দোহা যে রাবাত হয়ে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই আমার। আরব জাতীয়তাবাদ বলে কথা!
এবারের আসরের শুরুতে যতই চমক থাকুক, জায়ান্ট নাশক হোক, সময়ের সাথে সাথে এখন বিপদ সামলে থিতু ইউরোপের শক্তিশালী দলগুলো। যদিও দুই সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি, স্পেনের সাথে ফিফার সাবেক নাম্বার ওয়ান বেলজিয়াম বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে ফিরে গেছে, সময় যত গড়াচ্ছে ইউরোপীয়রা পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালের আটের পাঁচটি ইউরোপীয় দলই প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নেই।
গত আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপ-ল্যাটিন আমেরিকার অনুপাত ছিল ৬:২। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথমদিনই আলাদা আলাদা দুটি ম্যাচে মাঠে নামছে দুই ল্যাটিন পাওয়ার হাউজ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। বিশ্বকাপের নক-আউট রাউন্ডে একইদিন, একই শহরে ভিন্ন দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মতো জনপ্রিয় দলের মাঠে নামার ঘটনা বিরল। তারপরও সারা ফুটবল দুনিয়া তাকিয়ে থাকবে শুক্রবারের দুই কোয়ার্টার ফাইনালের দিকে।
এই ম্যাচ দুটির উপর হয়তো নির্ভর করবে বিশ্বকাপের আকর্ষণ বা বিবর্ণ হওয়া। ব্রাজিল-আর্জেন্টাইনরাই যে দল দুটিকে সমর্থন করে ব্যাপারটা সেরকম নয়। সারা দুনিয়ায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার চেয়েও বেশী সংখ্যক ভিনদেশী ফুটবল-ভক্ত এই দল দুটিকে সমর্থন করে।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার অভিযান যদি সেমি’র লড়াইয়ের আগে শেষ হয়ে যায় তাহলে শেষ সপ্তাহ বাংলাদেশ, কাতারসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিশ্বকাপ রং হারিয়ে ফ্যাকাসে হবে তা বলতে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। কোয়ার্টার ফাইনালের তুলনামূলক পরিসংখ্যান, ফুটবলারদের ফর্ম ও পারফরম্যান্সে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ব্রাজিল এবং নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে রাখা গেলেও, গত কয়েকটি বিশ্বকাপের আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল এবং তারপরের ম্যাচগুলোর পারফরম্যান্সে বেশ বিবর্ণ ল্যাটিন আমেরিকার দুই পাওয়ার হাউজ।
২০০২’র শেষবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ব্রাজিল ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। একবার মাত্র ‘শেষ-আটের’ গণ্ডি পেরিয়েছে ২০১৪ সালে নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত আসরে। সেবার সেমি’তে জার্মানির কাছে শোচনীয় হারের ক্ষত সেলেকাওদের কাছে এখনো দগদগে।
২০১৮’র আসরে ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’ থেকে বা পড়ে আর্জেন্টিনা, তার আগের আসরে খেলে ফাইনাল। ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ জয়ের পর ৩৬ বছরে এটাই ‘লা-আলবিসেলেস্তেদের’ সেরা বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স। এবার অধিকাংশ ফুটবল বিশেষজ্ঞই আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের মধ্যে যেকোনো একটি দলকে অন্তত: ফাইনালে দেখতে চাইছেন তাদের শক্তিমত্তা ও সামর্থ্যকে বিবেচনায় এনে।
এই পূর্বাভাস মোটেই অসম্ভব নয়। তবে একটাই শর্ত কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি পেরুতে হবে দুই দলকেই। তাহলে সেমিফাইনালে পরস্পরের মোকাবেলা এবং অন্তত: একটি দলের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত। তাতে ১৮ ডিসেম্বর দোহার লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়াম দেখবে ইউরোপের সেরা দলের সাথে ল্যাটিন আমেরিকার সেরা দলের বিশ্বকাপ মহাযুদ্ধ।
এবারের আসরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনাল হচ্ছে না তা নিশ্চিত। অনেকেই বলছেন, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সাথে ফাইনালে বোঝাপড়া হবে ব্রাজিল অথবা আর্জেন্টিনার। আবার কারো করো মতে, ফ্রান্স-ইংল্যান্ড’র কোয়ার্টার ফাইনালের জয়ী দলের হাতেই শেষ পর্যন্ত উঠবে বিশ্বকাপ। তারা ইংরেজ এবং ফরাসীদের বিশ্বকাপ অভিযানে পাচ্ছে ভবিষ্যৎ বিশ্বসেরা দলটির ছায়া।
তবে একথা সাহস করে বলাই যায়, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের উপর নির্ভর করছে এবারের আসরের আকর্ষণ ও ঔজ্জ্বল্য। এই দুই দল ফাইনালের আগে সেমি বা কোয়ার্টার-ফাইনালে যেদিন বিদায় নেবে সেদিনই ফুরবে কাতার বিশ্বকাপের শেষ আকর্ষণ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপ হবে সত্যিই দ্যুতিহীন। ফুটবল বিশ্বকাপের বর্ণিল, রোমাঞ্চপূর্ণ রাখার গুরুদায়িত্ব মেসি, নেইমার, টিটে ও স্কালোনির দলবলের। এটাই ফুটবলের এসময়ের বাস্তবতা।