চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

বীরকন্যাদের সাফ জয়ের একবছর

KSRM

দেশের সাফল্য বিস্মৃতপ্রায় ফুটবলের জাগরণের দিন হিসেবে ১৯ সেপ্টেম্বরকে স্মরণ করা যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছেলেদের ফুটবলে যখন চলছিল অধঃপতন, স্রোতের বিপরীতে দৌড়ে নানা সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে দেশের ফুটবল কন্যারা গর্বে ভাসিয়েছিলেন। ইতিহাস গড়ে একবছর আগে আজকের দিনেই সাবিনা-মারিয়া-কৃষ্ণাদের নৈপুণ্যে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ।

ফাইনালের আগেরদিন তারকা মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তারের ফেসবুকে পোস্ট করা দীর্ঘ কথামালা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সেখানে শিরোপা জয়ের অগ্রিম ঘোষণাটি যেন ছিল এক বাঘিনীর হুংকার। পাঁচবার সাফের মঞ্চে এসে একবার রানার্সআপ, তিনবার সেমিফাইনাল এবং একবার গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয়ার অতীতও স্মরণ করিয়ে দেন।

Bkash July

আবেগ ছুঁয়ে যাওয়া পোস্টে সানজিদা লিখেছিলেন, ‘ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।’

গ্রুপপর্বে প্রথমে মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেয়। হ্যাটট্রিক করেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। শেষ ম্যাচে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ওঠে লাল-সবুজের দল।

Reneta June

শেষ চারে ভুটানের জালে গুনে গুনে ৮ গোল দেয় টিম টাইগ্রেস। আবারও হ্যাটট্রিক করেন গোলমেশিন সাবিনা।

কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সোমবারের সেই সোনাঝরা সন্ধ্যায় শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল গোলাম রব্বানি ছোটনের দল। লাল-সবুজদের হয়ে দুটি গোল করেছিলেন কৃষ্ণারানী সরকার, অপর গোলটি ছিল শামসুন্নাহার জুনিয়রের।

গোটা আসরে প্রতিপক্ষ জালে গোল উৎসবে মেতে ওঠার পিঠে নিজেদের জাল অক্ষত রাখাকেও ধারাবাহিক ঘটনা বানিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। ২৩ গোল দেয়ার বিপরীতে ফাইনালে এসে কেবল একটি গোল হজম করেছিল গোলাম রব্বানি ছোটনের শিষ্যরা। পোস্টের সামনে বাংলাদেশের দেয়াল হয়ে উঠেছিলেন আসরসেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমা।

সেরা গোলদাতা ও আসরসেরা হন ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ সাবিনা খাতুন। ফাইনালে গোল পাননি, যদিও ছিল একটি অ্যাসিস্ট। ৫ ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিকসহ ঝুলিতে জমিয়েছিলেন ৮ গোল। মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কত্বের আর্ম ব্যান্ডটা সাত বছর ধরে পরে আছেন। স্ট্রাইকিং পজিশনে খেলা তারকা ফুটবলার প্রতিপক্ষের জন্য ক্রমাগত হয়ে উঠেছেন এক আতঙ্কের নাম! বারবার প্রতিপক্ষ জালে ত্রাস ছড়িয়ে সাবিনা হয়ে উঠেছেন গোলমেশিন।

অপরাজিত চ্যাম্পিয়নদের আক্রমণ ও মধ্যমাঠের পাশাপাশি রক্ষণও ছিল বেশ শক্তিশালী। গোলরক্ষক রূপনার সামনে রক্ষণে দুর্ভেদ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন চার ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, শিউলি আজিম ও শামসুন্নাহার সিনিয়র। ডি-বক্সে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা বল নিয়ে ঢোকার আগেই তারা হামলে পড়েছেন বিপদমুক্ত করতে।

গোল করার পাশাপাশি নিজেদের জাল অক্ষত রাখায় মিডফিল্ডাররা রেখেছেন অবদান। মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার ও মনিকা চাকমা সেরাটা দিয়ে ধরে রেখেছিলেন মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণ। আক্রমণ গড়ে তুলে স্ট্রাইকারদের বল যোগান দেয়ার পাশাপাশি তারা নিজেদের সীমানায় বল নিয়ে ঢোকার আগেই প্রতিপক্ষকে রুখে দেয়ার কাজটা দারুণভাবে সামলেছিলেন।

আক্রমণভাগে এক সাবিনাকে আটকে রাখাই হয়ে উঠেছিল অসম্ভব। আরেক স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্না করেছিলেন ৪ গোল। স্বপ্নার বদলি খেলোয়াড় হিসেবে দুবার নেমে দুই গোল পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণা চাকমা। চার গোল করা কৃষ্ণারানী সরকার পুরো মাঠজুড়ে দুর্দান্ত খেলেছিলেন। শামসুন্নাহার জুনিয়রও সাফল্য এনেছিলেন।

মেয়েদের কোচের দায়িত্ব পালন করায় একসময় বন্ধুদের খোঁচা শুনতেন গোলাম রব্বানি ছোটন। তাতে দমে যাননি একটুও। দিনের পর দিন মেয়েদের আগলে রেখেছেন সন্তানের মতো করে, ভালো-খারাপ সময়ে তাদের নিয়ে লড়েছেন একসাথে। ফাইনালের পর জাতীয় দলের সাবেক কোচ স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘২০১৬ সালে আমাদের ক্যাম্প শুরু হয় ৩৫ জন নিয়ে। সেই পথচলায় এখন ক্যাম্পে ৭০ জনের মতো আছে।’

সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে ছাদখোলা বাসে বীরকন্যাদের বরণ করে নেয়ার দাবি তীব্রতর হতে থাকে। একসময় এটি জন-দাবিতে পরিণত হলে আসে সুখবর। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেন, ছাদখোলা বাসেই হবে বীরকন্যাদের যাত্রা। বাংলাদেশে ছাদখোলা বাস না থাকাও পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের উপরের অংশ কেটে কয়েক ঘণ্টায় রঙ লাগিয়ে করা হয় প্রস্তুত।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হিমালয়ের দেশ নেপালে লাল-সবুজের বিজয় কেতন উড়িয়ে বাংলাদেশের বীরকন্যারা ২১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় দেশের পথে রওনা করেন। মেয়েরা যখন দেশে পৌঁছান, ঘড়িতে ঠিক দুপুর ১:৪৫ মিনিট।

বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে ছাদখোলা বাস পর্যন্ত আসতে সাবিনাদের লেগে যায় প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো! পৌনে দুইটায় বিমান থেকে নামা চ্যাম্পিয়নরা যখন বাসে উঠে পড়েন, ঘড়িতে সাড়ে তিনটার বেশি। এ সময়ের মাঝে বিমানবন্দরে ঘটে যায় অনেককিছু। সাবিনাদের জায়গা করে দিতে সংবাদকর্মী-জনতার চাপের মুখে পুলিশকেও হতে হয় কঠোর। সাংবাদিকদের সাথে তো মৃদু ধাক্কাধাক্কিও হয়ে যায় নিরাপত্তাকর্মীদের। বাতিল করা হয় বিমানবন্দরের সংবাদ সম্মেলন। তারপর বাইরের ভিড় ঠেলে বাস পর্যন্ত আসতে আরেকদফা জনতার ঢল অতিক্রম করতে হয়েছিল সানজিদাদের।

ছাদখোলা সেই বাসটি কাকলি, জাহাঙ্গীর গেট হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে বিজয় সরণী-তেজগাঁও-মৌচাক ঘুরে কাকরাইল পৌঁছেছিল। সেখান থেকে ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাপলা চত্বর দিয়ে মতিঝিলে বাফুফে ভবনে যখন পৌঁছান বীরকন্যারা, তখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা।

বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার পথে সাফজয়ীরা পড়েছেন জ্যামের শঙ্কায়, গরমে কিছুটা অস্থিরও ছিল উল্লাসের মাত্রা! ছাদখোলা বাসটি বনানীতে আসলে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পথচারী-সেতুর বিলবোর্ডে আঘাত পান ঋতুপর্ণা চাকমা। তাৎক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তারকা মিডফিল্ডারের কপালে দিতে হয় তিনটি সেলাই। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নেয়া হয় বাফুফে ভবনে। পরে অবশ্য সুস্থ বোধ করেন ঋতুপর্ণা।

ছাদখোলা বাসটি দীর্ঘ ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। প্রায় পুরো রাস্তাজুড়ে দু-ধারে ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢল। ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল রাজপথ। হাততালি আর স্লোগানে স্লোগানে গলা চড়ানো সমর্থকদের ভিড় ঠেলে যাত্রা সম্পন্ন করেন সাবিনা-সানজিদারা।

চার ঘণ্টার বেশি সময়ের রাজসিক যাত্রা শেষে কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয় চ্যাম্পিয়নদের। সেখানে বিজয়ী মেয়েদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বাফুফে সভাপতি। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৬ ও মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল দলের সদস্যরা স্বাগত জানান সাউথ এশিয়ান ফুটবলের মুকুটধারীদের।

বাফুফে ভবনে প্রেস-কনফারেন্সে শিরোপাজয়ী অধিনায়ক সাবিনা বলেছিলেন, ‘লক্ষ্য থাকবে দেশের মানুষকে হাসিখুশি রাখার। কারণ এতকিছুর পরে এখন আর বলার অবকাশ নেই, বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলে কতটা আসক্ত এবং ভালোবাসে। সবসময় সাথে ছিলেন, ভবিষ্যতেও সমর্থন করে যাবেন। আশা করি আমরা দেশকে আরও ভালো ট্রফি উপহার দিবো।’

বিজ্ঞাপন