বিশ্বের ‘টপ টেন ফেস্টিভাল লিস্ট’ এর অন্যতম এবং বৃহত্তম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব আমস্টারডামের ইডফা’য় শনিবার রাতে বিশ্ব প্রিমিয়ার হয়েছে সারা আফরীন প্রযোজিত নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের নতুন ছবি ‘অন্যদিন…’ এর। নেদারল্যান্ডসের স্থানীয় সময় রাত ৯টায় শুরু হয়ে প্রদর্শনীটি চলে প্রায় ১১টা পর্যন্ত।
পৃথিবীর সুন্দরতম ৫০টি সিনেমা হলের লিস্টে ১ নম্বর আমস্টারডামের তুসানস্কি থিয়েটার। অত্যন্ত প্রাচীন ও জনপ্রিয় এই থিয়েটারে টিকেট কেটে ‘অন্যদিন…’ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন হলভর্তি দর্শক। এই প্রদর্শনীতে নির্মাতা সহ বাঙালি দর্শক ছিলেন মোট চারজন!
এরমধ্যে নির্মাতার প্রবাসী একজন বন্ধু ছাড়াও সস্ত্রীক ‘অন্যদিন…’ দেখেছেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ। বিশ্ব প্রিমিয়ারে ‘অন্যদিন…’ দেখার অভিজ্ঞতা এবং ডাচ দর্শকরা কীভাবে বাংলাদেশের এই ছবিটি গ্রহণ করেছেন- সেটিও পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ। জানিয়েছেন, সপ্তাহখানেক আগেই ইডফায় কামার আহমান সাইমনের ‘অন্যদিন…’ দেখাবে, সেটা জানতে পারেন। এরপর নিজ থেকেই ইডফার সাথে যোগাযোগ করে প্রিমিয়ারে উপস্থিত হন। যেখানে উপস্থিত হয়ে অসংখ্য ডাচদের সাথে বসে বাংলাদেশের সিনেমা দেখার বিষয়টিকে ‘স্মরণীয়’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি জানান, তুসানস্কি থিয়েটার একেবারে আমস্টারডামের প্রাইম লোকেশনে। বহু প্রাচীন স্টুডিও। সেই থিয়েটারে বসে বাংলাদেশের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা অভূতপূর্ব। টিকেট কেটে ডাচরা এসেছে, চুপচাপ বসে কামারের ‘অন্যদিন…’ দেখেছে- এই অনুভূতিও আমার জন্য বিরল।
ছবি চলাকালীন তুসানস্কি থিয়েটারের পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, সিনেমাটি ছিলো দুই ঘণ্টার। এই সময়ে কাউকে বিরক্ত হতে দেখিনি। সবাই খুব চুপচাপ সিনেমাটি দেখছিলেন। সিনেমাটি শেষ হলে সবাই হাত তালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। শুধু তাই নয়, সিনেমা শেষ হওয়ার পর নির্মাতার সাথে আলোচনা অনুষ্ঠানটিও নিবিড় মনোযোগে সবাই শুনছিলেন, কথা বলছিলেন।
‘মজার ব্যাপার হলো স্ক্রিনিং শেষ হওয়ার পর আলোচনা শুরু হলো। ফেস্টিভাল ডিরেক্টর ডাচ নারী নির্মাতা কামারকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিলেন, যে কথাগুলো খুব ইন্টারেস্টিং।’ -বলছিলেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রদূত।
সিনেমাটি নিয়ে নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, কামারের ‘শুনতে কি পাও!’ না দেখলেও তার বাকি কাজগুলো দেখেছি। তার সিনেমা ভাবনা দারুণ, এবং আলাদা। ‘অন্যদিন…’ এর প্লট একেবারে ‘র’। আমার আপনার হয়তো এই সিনেমার অনেক বিষয় নিয়ে অস্বস্তি লাগতে পারে, কিন্তু সাইমন সব ‘র’ জিনিস তুলে ধরেছেন তার এই সিনেমায়। এগুলো যে পশ্চিমেও উপস্থাপন করা যায়, এটা দেখলাম! কামার যেন পশ্চিমাদের বলতে চাইলেন, তোমার আমার চিন্তার জায়গায় কোনো তফাৎ নাই।
‘অন্যদিন…’-এ রিয়েল লাইফের মানুষকে তুলে ধরেছেন কামার আহমান সাইমন, এমনটা মন্তব্য করে এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কামারের এই সিনেমার চরিত্ররা কেউ অভিনয় করেননি, সবাই রিয়েল লাইফের মানুষ। অনেকগুলো ঘটনা জোড়া লাগানো, কিন্তু পুরোপুরি সিনেমার ট্রিটমেন্ট। যদিও সিনেমা মানেতো খুব পরিশীলিত একটি বিষয়, কিন্তু কামার রিয়েলিটিকে তুলে ধরেছেন। কন্টেন্ট উপস্থাপন, সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট- এই দুটি বিষয় খুব দারুণভাবে সম্পন্ন করেছেন কামার। আর এজন্যই অন্য যেকোনো সিনমার চেয়ে ‘অন্যদিন…’ আলাদা। আমি বাংলাদেশি বলে এভাবে বলছি না, এই সিনেমার ভাষা ই সার্বজনীন।
তিনি বলেন, আরো ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, প্রিমিয়ারের আগে যখন নির্মাতা কামারের সাথে কথা বলছিলাম, তখন জানতে পারি- বিশ্ব প্রিমিয়ারের আগে নির্মাতা নিজেও বড় পর্দায় সিনেমাটি দেখেননি। মানে নির্মাতা নিজেও আমাদের সাথে বসে প্রথমবার দেখলেন ‘অন্যদিন…’।
অন্যদিকে ইডফা’র ওয়েবসাইটে ‘অন্যদিন…’কে বলা হয়েছে‘ফিলসফিকাল ও ক্যালাইডস্কোপিক’। বিষয়টি নির্মাতার কাছেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এরআগে এ বিষয়ে কামার নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “প্রথম সারির উৎসব, বৃহত্তম উৎসব, মূল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, লিড ফেস্টিভ্যাল, সুন্দরতম থিয়েটার, বিশ্ব অভিষেক, সেরা পুরষ্কার, অস্কার- এতোসব খবরের ভিড়ে ইডফা’র ওয়েবসাইটে “অন্যদিন…” নিয়ে একটা কথা চোখে লেগেছে- ‘ফিলসফিকাল ও ক্যালাইডস্কোপিক’। ক্লিশে ফেস্টিভ্যাল পলিটিক্সে নারীবাদী, মৌলবাদী, গরিববাদী, বিশ্ববাদী, ফ্যাকরাবাদী, ইত্যাদি বাদানুবাদের বাইরে ইডফা “অন্যদিন…”এ একটা ফিলসফিকাল ও ক্যালাইডোস্কোপিক ছবি খুঁজে পেয়েছে, নির্মাতা হিসাবে এর চাইতে আনন্দের আর কি হতে পারে!”
নন-ফিকশন ছবির জগতের সেরা চলচ্চিত্রগুলা উপস্থাপন করার জন্য চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে দুনিয়াজোড়া খ্যাত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ইডফা। তিন শতাধিক শক্তিশালী ও কাব্যিক ছবি দেখানো হয় ১২ দিনের এই উৎসবে, যেখানে টিকেট কেটে ছবি দেখতে আসেন আড়াই লক্ষাধিক দর্শক।
এই বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে শ্রেষ্ঠ নন-ফিকশন ফিচার ছবির মর্যাদাপূর্ণ পুরষ্কারের দৌড়ে আছে ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানী, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালসহ মোট ২১টি দেশের ১৪টি ছবি। যার মধ্যে কামারের হাইব্রিড ছবি ‘অন্যদিন…’। ২৫ নভেম্বরের একটি আড়ম্বরপূর্ণ পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এই ফল ঘোষণা করা হবে আমস্টারডামের বিখ্যাত আই ফিল্ম মিউজিয়ামে।