২০০৯ সাল। ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ। দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় গিয়াস উদ্দিন সেলিমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’। তখন তিনি ছিলেন একজন তরুণ নির্মাতা। নতুন নির্মাতার প্রথম ছবি মুক্তির আগে তা নিয়ে তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিলো না কারো। বিশেষ করে সিনেমা ব্যবসায়ীদের। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তির পর সব হিসেব নিকেষ পাল্টে যায়।
খুব কম সময়ের মধ্যেই ‘মনপুরা’র দর্শকপ্রিয়তা ছড়িয়ে যেতে থাকে শহর থেকে গ্রামে। সব শ্রেণির দর্শকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় চঞ্চল চৌধুরী ও ফারহানা মিলি অভিনীত ছবিটি। মনে করা হয়, নানা কারণে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো- ‘মনপুরা’র মাধ্যমে আবারও প্রেক্ষাগৃহে ফিরে তারা।
গ্রাম বাংলার আবহমানের প্রেমের গল্পটি দেখে সেসময় মুগ্ধ হননি, এমন বাঙালি দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই মাইলফলক বাংলা ছবিটির ১৩ বছর পূর্তি রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি)। গেল বছর ইচ্ছে থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে ঘটা করে ‘মনপুরা’র এক যুগ পূর্তি উদযাপন সম্ভব হয়নি, তবে এ বছর বিশেষ এই দিনে ‘মনপুরা’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ঘরোয়া আড্ডার কথা জানালেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম।
তার আগে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে ‘মনপুরা’ নিয়ে কিছুটা স্মৃতি আওড়ালেন নির্মাতা। সেই সঙ্গে সমসাময়িক কাজ ও প্রসঙ্গেও কথা বললেন তিনি-
নির্মাতার মুখে ‘মনপুরা’ শুরুর কথা…
‘মনপুরা’ আমি লিখতে শুরু করেছিলাম ১৯৯৭ সালে। ফার্স্ট ড্রাফট করি মাসখানেকের মধ্যে। তখন এটা নিয়ে আমার নাটক করার কথা ছিল। সেই সময়তো আমি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতাম। নাটকটি নির্মাণ করতে পরী চরিত্রে কাস্টিং ঠিক করলাম আফসানা মিমিকে। তাকে স্ক্রিপ্টটা পড়তে দেই। সে এটা পড়ে আমাকে জানায় ‘সেলিম ভাই, এটা তুমি নাটক করো না, সিনেমা করো।’ তখন আমি খুবই নবীন রাইটার এবং ডিরেক্টর। কেউ আমাকে সিনেমার জন্য টাকা দিবে না, এটাই স্বাভাবিক। হলও তাই। এরপর ২০০৩ সালে আমি এটা আমি উদ্যোগী হয়েছিলাম। তখন পরী চরিত্রে এটার কাস্টিং হিসেবে জয়া আহসান এবং সোনাই চরিত্রে আমরা রিয়াজকে ভেবেছিলাম। সে সময়ও সিনেমাটি করতে পারিনি।
এরপর ২০০৭ সালে ‘মনপুরা’ নির্মাণের উদ্যোগ নিই। এর মাঝখানে প্রায় দশ বছরের মত টেলিভিশনে ডিরেক্টর হিসেব কাজের অভিজ্ঞতা হয়। একটু একটু করে প্রযোজক পেতে শুরু করলাম। সিনেমার জন্য টিম গোছানো শুরু হল। স্পেশালি টেলিভিশনে এতদিন ধরে যাদেরকে নিয়ে কাজ করেছি, তাদেরকে নিয়েই কাজ শুরু করলাম। প্রায় দুই বছর কাজ করে ‘মনপুরা’ সম্পন্ন করলাম। থার্টি ফাইভে শুট করেছিলাম। শুট করার প্রায় ছয় মাস পর আমি প্রথম ফুটেজ দেখতে পেয়েছিলাম, এখন তো আমরা যখন শুট করি তখনই ফুটেজ দেখতে পারি। মনিটর ছিলো না সেসময়। কোন অভিজ্ঞতা ছিলোনা সিনেমার, কিন্তু সবার মধ্যে ছিলো অফুরান আন্তরিকতা। পুরো দলের প্রাণটা ছিল, জানটা ছিল। আমার মনে হয়, আমাদের প্রত্যেকের যে প্রচেষ্টা ছিলো সেটা পরবর্তীতে সিনেমায় দেখা গেছে।
‘মনপুরা’র সাফল্য কি পরবর্তী কাজগুলোতে নির্মাতাকে চাপে রেখেছে?
আমি একদমই চাপ অনুভব করি না। ২০০৯ সালের বাস্তবতা আর ২০২২ সালের বাস্তবতা আলাদা। আগে একটা সিনেমা নয় মাস প্রেক্ষাগৃহে চলেছে, হলসংখ্যা ছিলো ছয়শোর মতো। এখনতো সিনেমা হলের সংখ্যা হাতে গোনা, তারপরও মাসখানেক এর বেশি একটি সিনেমা চলছে না। কিছুদিন প্রেক্ষাগৃহে চলার পর সেটা ওটিটিতে যাচ্ছে। এখনকার বাস্তবতা আলাদা। ফলে আমার কোনো চাপ নেই। সময়ের সাথে নিজেকে আপডেট করাই আমাদের কাজ।
অনেকে আপনাকে ‘অভিনেতা নির্মাণ’র কারিগর মনে করেন!
একজন অভিনেতার, তার যদি নিজের ক্ষমতা না থাকে অভিনয় সম্ভব নয়। সৌভাগ্যবশত আমি হয়তো ভালো অভিনেতাদের খুঁজে পেয়েছি। আমার কাজ হচ্ছে অভিনেতাকে উস্কে দেয়া – তাকে এটা বলা যে ‘তুমি ছাড়া এই চরিত্র পৃথিবীর আর কেউ পারবে না।’ এটা বললে তার ভরপুর কনফিডেন্ট থাকে এবং ভালো অভিনয় করে। এটা সেই অভিনেতা-অভিনেত্রীর কৃতিত্ব, আমার কাজ হচ্ছে ওকে একটু উস্কে দেয়া।
ওটিটি কি সিনেমা হলের জায়গা নিয়ে নিতে পারে?
আমার এটা মনে হয় না। সিনেমা হল মানুষকে একটা কনসার্টের আনন্দ দেয়। তিন চারশো লোক একসাথে বসে একটা সিনেমা উপভোগ করে। কেউ একজন যদি হেসে ওঠে, সেটাও সংক্রমিত হয়। কেউ একজন কাঁদলে সেটাও সংক্রমিত হয়। কিন্তু ওটিটি একদম পার্সোনাল প্লাটফর্ম। পারসোনাল ডিভাইসে একা একজন সেটা দেখেন। সিনেমা হলের আবেদন একেবারে আলাদা। সিনেমা হল কিংবা ওটিটি কোনটার আবেদনই ফুরিয়ে যাবে না, ওটিটি শুধু নতুন মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হলো।
বর্তমানে গিয়াস উদ্দিন সেলিম ব্যস্ত সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ‘কাজলরেখা’ নিয়ে। ইতোমধ্যে প্রাকপ্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন। শিগগির যাবেন শুটিংয়ে। এছাড়া মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার নির্মিত ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ছবি ‘পাপ-পুণ্য’ এবং চরকির প্রযোজনায় ‘গুণিন’ চলচ্চিত্র দুটি। নির্মাতা জানিয়েছেন, শিগগির ছবি দুটি সিনেমা হলে দেখতে পারবেন দর্শক। পরবর্তীতে ‘গুণিন’ দেখা যাবে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকিতে।