শরীয়তপুর জেলার একটি গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সাবিনা আক্তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল পরীক্ষার চাপমুক্তির আনন্দ নিয়ে। বাড়ি ফিরেই মা-বাবার মুখে জানতে পারলো, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ ও বিয়েতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে পরিবার থেকে তার উপর নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। বয়সের বিচারে শিশু সাবিনা প্রতিবাদে অভিমানে আত্নহননের পথ বেছে নেয়। গতমাসে (নভেম্বর) ঘটে যাওয়া এই ঘটনা ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়া ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আইনের খসড়ায় ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর রাখা হলেও আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের মত নিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের নারী অধিকার, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনগুলো এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। প্রস্তাবিত আইনের ওই বিশেষ ধারা বাতিলের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন ও সমাবেশও হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া ওই আইন পাস হলে তা মেয়েদের আরও বেশি বাল্যবিয়ের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে বলে তাদের যুক্তি ও দাবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য প্রতিবাদকারীদের দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, আর্থসামাজিক বিষয় বিবেচনা করেই এই আইন হয়েছে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যারা বিরোধিতা করছে তাদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কম, শহরে বাস করে তারা গ্রামের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারছে না। তিনি ওই বিষয়ে প্রেক্ষাপট বুঝতে বিরোধিতাকারীদের কিছুদিন গ্রামে বাস করারও পরামর্শ দিয়েছেন। রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর হয়তো এই আইন পাশে কোনো বাধা থাকছে না। কিন্তু সকলেই মনে করেন, ‘বাল্যবিবাহ’ একটি বহু পুরনো এবং অত্যন্ত ভয়াবহ সমস্যা। শারীরিক-মানসিক বিচারে পরিণত বয়সী বর-কনে না হলে তা দেশের প্রচলিত আইনে বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত। বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট যাইহোক বাল্যবিবাহের কুফলের শিকার হয় কন্যাশিশুরা, বাল্যবিবাহ সংকুচিত করে দেয় নারীর বিকাশমান পৃথিবী। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার স্বপ্নের পরে ভবিষ্যতে যে সন্তানের মা হবেন, তাকে অবশ্যই পরিপক্ব-পরিণত হতে হবে। তা না হলে সন্তান পালন থেকে শুরু করে সমাজ-সংসারের দায়িত্ব পালন তার কাছে বোঝা হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া বাল্যবিবাহের ফলে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুসহ প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের আশঙ্কা বেড়ে যায়, বাড়ে পারিবারিক কলহ বিবাদ। শরীয়তপুরের সাবিনার প্রতিবাদ ও আত্মহননের মতো ঘটনা কালেভদ্রে হলেও এর বাইরে যেসব শিশু-কিশোরী পরিবার ও সামাজিক চাপে বাল্যবিবাহ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের পরিণতি মোটেই সুখকর নয়। বর্তমানে দেশে বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৫২ শতাংশ, তবে বর্তমানে প্রান্তিক চিকিৎসা সেবার মান বাড়ার কারণে মাতৃমৃত্যুর হার সন্তোষজনক হারে কমেছে। সার্বিক পরিস্থিতি ও দেশের আইনের চর্চা-প্রয়োগ ব্যবস্থা বিবেচনা করে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মা-বাবার সম্মতি ও আদালতের অনুমতিতে শিশু-কিশোরীদের বিয়ে দেওয়ার বিধানটি বাল্যবিবাহ বৈধকরণ আইন হিসেবে অপব্যবহার হতে পারে। শিশু-কিশোরী ধর্ষণের ঘটনার পরে তা বিয়ের নামে ধামাচাপার ঘটনার আশঙ্কাও করছেন অনেকে। এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়ে যাওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে ধর্মান্তকরণের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের দেশে যারা মেয়ের বাল্যবিবাহ দেন, তাদের মধ্যে কতজনের আদালত পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা আছে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। আবার দেশে আইন প্রয়োগে নজরদারিই বা কতোটুকু আছে? সার্বিক দিক চিন্তা করে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আরো আলোচনা করে এবং প্রেক্ষাপট বিচার করে সংশোধন করা যেতে পারে।