বাংলাদেশে নারী বক্সিংয়ের শুরুর সময়ের একজন তামান্না হক। পেশাদার বক্সার হিসেবে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বর্তমানে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন। আত্মরক্ষার পাশাপাশি মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও ভূমিকা রাখছেন এ তারকা অ্যাথলেট।
দেশে মেয়েদের জন্য সবক্ষেত্রে নিরাপত্তার পরিস্থিতি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি, চলার পথ নয় মসৃণ। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, উত্যক্ত ও হেনস্তার শিকার প্রতিনিয়তই হতে হচ্ছে তাদের। মেয়েদের সুরক্ষা ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঠিক এ বিষয়টি নিয়েই কাজ করে চলেছেন তামান্না। রেপ অ্যান্ড প্রিভেনশন সেলফ ডিফেন্সের উপর হয়েছেন লাইসেন্সধারী। আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
কিক বক্সিংয়ের উপরও তামান্নার রয়েছে দক্ষতা। শিখছেন কুংফু, রয়েছেন ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার প্রত্যাশায়। এ অবস্থানে আসার পেছনের ইতিহাসটা মসৃণ ছিল না। জানালেন, তার ব্যক্তিজীবনে নেই কোনো পুরুষের অবদান। মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য বক্সিং ছেড়ে দিতে হবে- এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে করেছেন সংগ্রাম, অনেকের কাছে হয়ে উঠছেন অনুপ্রেরণার বড় উদাহরণ।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দেশে সকলক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলেও নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে তাদের চলতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, একটি মেয়ে যখন ভিকটিম হন, তারপর আমাদের কী করণীয় থাকে? চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারীতায় তামান্না বললেন সেসবই।

‘মেয়েদের প্রধান সমস্যাটা পরিবার থেকেই আসে। এটাই সত্যি। পরিবার থেকে যতটুকু সমর্থন দরকার, সেটা আমরা পাই না। শুধু বলা হয় তুমি পড়ালেখা করবে, হয়তো কোনো একটা চাকরি করবে, তারপর একটা বিয়ে দিয়ে দেবে, ব্যাস শেষ। কিন্তু এটাই একটা মেয়ের জীবনের চক্র হতে পারে না।’
‘একটা মেয়ে যখন ভিকটিম হবে, ভিকটিম হওয়ার আগে সে যখন আক্রান্ত হবে, তারপর করণীয় কী এসবের আগে আমরা যদি মনে করি পরিবার থেকে শিক্ষাটা দেয়া উচিৎ। কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে, দুর্ঘটনা হতেই পারে। আমরা কি পরিবার থেকে এটা আশা করতে পারি না যে একটা মেয়ে প্রশিক্ষণ নেবে, জুডোতে যাবে, কারাতে শিখবে, আত্মরক্ষার কৌশল শিখবে?’
‘কিন্তু দেখা যায় ঢাকায় এবং আমাদের গ্রামগঞ্জে তো আরও বেশি একটা মেয়ে সামান্য যদি ফ্রেন্ড সার্কেলের সঙ্গে বাইরেও ঘুরতে যায়, রেস্টুরেন্টেও যেতে চায়, এখানেও তার পরিবার থেকে অনেক বাধা আসে। কেন যাচ্ছ, কেন যাবে, এসব প্রশ্ন আসে। সেক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নেয়া সেটা তো অনেকদূরের ব্যাপার। আমিও যখন শুরু করেছি, তখন আমার পরিবারের বাধা ছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে এসেছি। কিন্তু দেখা যায়, সবার সেই সাহস আর মন মানসিকতাটা থাকে না যে, আমি নিজে একা যুদ্ধ করে পরিবারের বিপক্ষে চলে আসব। এভাবে এসে নিজে প্রশিক্ষণ নিবো কিংবা অন্যকে প্রশিক্ষণ দিবো।’
‘আমি মনে করি পরিবারকে অনেক সচেতন ও সাপোর্টিভ হতে হবে। পরিবার থেকে আমাদের প্রতিটা দিন-প্রতিটা সময় একের পর এক বাধা আসে। অভিভাবকদের এটা বোঝা উচিৎ একটা মেয়ে যদি প্রশিক্ষণ নেয়, যেকোনো ফাইট শিখলে তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। নিজেকে রক্ষা করতে জানবে। একজনকে অনুপ্রাণিত করতে শিখবে। একটা দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার সাহস ও মনমানসিকতা সেটা তার ভেতর তৈরি হবে। ভালো কাজে পরিবারকে অবশ্যই উৎসাহ প্রদান করতে হবে। মেয়েদের পরিবারের সমর্থনটা দরকার, যেটা বাংলাদেশে সাধারণত নেই। অভিভাবকদের এটাই অনুরোধ করব, মেয়েদের উৎসাহিত করুন। একটা মেয়েকে খাঁচায় বন্দি করে রাখবেন না।’
আশেপাশের দেশে ও ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আত্মরক্ষার কৌশলগুলো শেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা করানো হয়। এ দেশে এসব কর্মকাণ্ড একেবারেই কম হচ্ছে। অথচ সামাজিক বাস্তবতায় আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ইনস্টিটিউট পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকাটা হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি।
তারকা বক্সার তামান্নার মতে ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়লে শুধুমাত্র আত্মরক্ষার কৌশল শেখাই নয়, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও সৃষ্টি হবে। বললেন, ‘প্রতিটা জায়গায় একটা করে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ইনস্টিটিউট থাকলে একজন করে ইন্সট্রাক্টর থাকবে। শুধু ঢাকাতেও আমরা যদি ২০০-৩০০টি স্কুল দিয়েও শুরুটা করি, তাহলে শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ও কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে। সেখানে এসে অনেকেই শিখবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।’
‘একজন ট্রেইনার পুরুষ-নারী যেকেউই হতে পারে। মেয়েরা যারা আত্মরক্ষার কৌশল শেখাচ্ছে, তারাও (সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে) বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। যখন সারাদেশে শেখানোর ব্যবস্থাটা ছড়িয়ে যাবে, তখন আর এগুলো থাকবে না। আত্মরক্ষার কৌশল শেখা মেয়েদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি সেটা প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করাটাই একটা ভালো চিন্তাধারা হবে।’
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ব্যবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশ্বাস তামান্নার। এ ব্যাপারে খোলামেলা আলাপের মাঝেই জানালেন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী।
‘বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ আয়োজন করে থাকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের ৬৪ জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অংশ নেয়। যারা ৬৪ জেলায় ফুটবল নিয়ে কাজ করে, আমি মনে করি তারা বাংলাদেশে মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে পারে। এটা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যেতে পারে।’
‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মদের নিয়ে যারা কাজ করছে, আরও ভালো উদ্যোগ হবে, যদি তরুণদের নিয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর কাজ করানো যায়। সবাই এগিয়ে এসে এই কাজটায় যদি হাত দেয়, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। যেন এই জিনিসগুলোকে নিয়ে আমরা সবাইমিলে এগিয়ে যেতে পারি। শেখাটা প্রতিটা জায়গায় কন্টিনিউ হয়ে গেলে যে, একজন-দুইজন ইভটিজিং ও বুলিংয়ের শিকার হয়, তখন সেগুলো কমে যাবে।’
ক্রিকেট, ফুটবল, আর্চারি, ভারোত্তোলন, শ্যুটিং এসবে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও অনেক ভালো করছে। বক্সিংয়েও সেই উন্নতির ছোঁয়া লাগবে, তা নিয়ে তামান্না হকের আশা, এ খেলাতেও উঠে আসবে অনেক খেলোয়াড়। বৈশ্বিক আসরে তারা বয়ে আনবে সাফল্য। তার মতে, বক্সিং নিয়ে করতে হবে গঠনমূলক পরিকল্পনা।
‘ফেডারেশনকে প্রতিবছর যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়, এখানে হয়তো আরেকটু মোডিফাই করতে হবে। ব্যবস্থাপনায়, টিচিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু মোডিফাইয়ের ব্যাপার আছে। এ জিনিসগুলোকে যদি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়, তাহলে বক্সিং-কুংফু এ জায়গাগুলোতে মেয়েরা অনেক উন্নতি করতে পারবে। শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও উন্নতি করতে পারবে। এজন্য আমাদের সবচেয়ে যে জিনিসগুলো বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে, ফোকাস রাখা। উদ্দেশ্য থাকতে হবে যে বক্সিংকে অন্যান্য দেশের মতো এগিয়ে নিয়ে যাবো। এতে করে একজন খেলোয়াড় বক্সিংয়ে এসে কখনো নিরাশ যেন না হয়ে যায়, যার যে স্বপ্ন সেটার বাস্তবায়ন যেন করতে পারবে। অন্যান্য খেলাধুলাতে মেয়েরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, আমি আশাবাদী বক্সিংয়েও এই উন্নতিটা দ্রুত চলে আসবে।’