ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়াতে এখন বসন্ত। বছরের এই সময়টাতে অস্ট্রেলিয়ানদের নজর থাকে রাজধানী ক্যানবেরার দিকে। তারা দলে দলে ভীড় জমান ক্যানবেরার কমনওয়েলথ পার্কে। অজিরা বিশ্ব্স করে বসন্তের সৈীন্দর্যে অবগাহন করার শ্রেষ্ঠ স্থান ক্যানবেরার ’টিউলিপ শো’। এই শো-কে তারা বর্ণনা করে ’অস্ট্রেলিয়া’স বিগেস্ট সেলিব্রেশন অফ স্পিং’ হিসেবে। প্রতিবছর ‘টিউলিপ শো’ অনুষ্ঠিত হয় ক্যানবেরার কমনওয়েলথ পার্কে, এবারও হচ্ছে। ২০২২ সালের টিউলিপ শো’র মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘The Sounds of Spring’. এই শো শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। টিউলিপ শো’র শুরুটা হয়েছিল বসন্ত উদযাপনের অংশ হিসেবে। এটি এখন অস্ট্রেলিয়ানদের বসন্ত উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্যানবেরা টিউলিপ শো’র স্থানীয় নাম ফ্লোরাইড (Floriade)।
পারফেক্ট লাভ প্রকাশ করে যে ফুল তার নাম টিউলিপ। পথিবীজুড়ে মানুষের অন্যতম পছন্দের ফুল টিউলিপ। প্রায় একশো বছর আগে তুর্কিস্থানে টিউলিপ ফুলের চাষ শুরু হয়। এই ফুল সেময়কার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলে। সপ্তদশ শতকে নেদারল্যান্ডে টিউলিপের ব্যাবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। প্রকৃত ভালবাসা প্রকাশে লাল টিউলিপ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রঙ ও গোত্রের টিউলিপের চাষ হচ্ছে। কেউ কেউ একে ডাচ ফ্লাওয়ার বলে ভুল করে থাকেন।
গত কয়েকবছর অতিমারীর জন্যে টিউলিপ শো দেখা সম্ভব হয়নি। এখন যেহেতু করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। আমাদের একমাত্র পুত্র রিতাজের স্কুল হলিডে চলছে। তাই তিন অক্টোবর, সোমবার পাবলিক হলিডে হওয়ায় ক্যানবেরার টিউলিপ শো দেখার উদ্দেশ্যে বেরেয়ে পড়লাম আমরা। আমরা মানে, আমি, আমাদের ছেলে রিতাজ, গিন্নি রিনা, জিয়া ভাই ও ইমি ভাবী। ইমি ভাবী ঢাকা থেকে সিডনি এসেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো।
সকাল দশটায় রওনা দিলাম। পথে থেমে থেমে যাওয়াতে প্রায় ৪ ঘন্টা পর সরাসরি ক্যানবেরার কমনওয়েলথ এভিনিউ এর কমনওয়েলথ পার্কে পৌঁছালাম। প্রচন্ড ভীড়। কাছাকাছি কোনো পার্কিং স্পট পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে টিউলিপের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলো। ক্যানবেরা শহরের সিটি সেন্টার থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাাঁটার দূরত্বে অবস্থিত এই কমনওয়েলথ পার্ক। কমনওয়েলথ পার্কেও মধ্যেই প্রতিবছর টিউলিপ শো হয়। একটি দু’টি নয় এক মিলিয়নেরও বেশি টিউলিপ ফোটে এসময়। চারিদিকে শুধু নানা রঙের, রঙ বাহারী টিউলিপ! দূর থেকে মনে হয় যেন প্লাস্টিকের ফুল। কাছে গেলে ভুল ভাঙে! বোঝা যায় ফুলগুলো প্লাস্টিকের নয়। একেবারে আসল। এবছর ক্যানবেরা টিউলিপ শো শুরু হয়েছে ১৭ সেপ্টেম্বর। চলবে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত। চার সপ্তাহের এই শো দেখতে, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে মানুষেরা আসে। ফুলের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায়। ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে ধারণ করে নিয়ে যায় ছবি। রাশি রাশি টিউলিপের ছবি। নির্মল, সুন্দর, পুত-পবিত্র ফুলের ছবি।
ফুলের রাজ্যের প্রতিটি শহরে ঢুঁ দিলাম। পরিচিতি আরো কয়েকটা ফ্যামিলির সাথে দেখা হয়ে গেল। ইচ্ছেমতো ঘুরে, আড্ডা দিয়ে, ছবি তুলে কাটিয়ে দিলাম পুরোটা সময়। কখন যে তিন ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল কেউই তা টের পায়নি! ক্ষিদেই পেট চো চো করছিল। সিডনিতে সবকিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ক্যানবেরাতে সবই দূরে দূরে! গুগলে সার্চ দিয়ে খাবার হোটেল খুঁজে বের করে, হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ক্যানবেরার লোকসংখ্যা অনেক কম। একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, ক্যানবেরা শহরটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা একটা শহর। সাধারণত কোনো অ লে মানুষ গিয়ে বসতি স্থাপন করে। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। প্রথমে ক্যানবেরা শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে। তারপর সেখানে মানুষ গিয়েছে, বসবাস শুরু করেছে। তাই পৃথিবীর যেকোনো শহরের চেয়ে ক্যানবেরা শহরটি অনেক অনেক সুপরিকল্পিত, সুবিন্যাস্ত, পরিপাটি একটি শহর। রাস্তায় ভীড়-ভাট্টাও কম। প্রশস্ত রাস্তা। মূল শহরটা খুব ছোটই বলা যায়।
রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় সন্ধ্যা। থাকার হোটেল আগেই বুকিং দেয়া ছিল। আমাদের হোটেলের নাম আইবিস। হোটেলটার অবস্থান ক্যানবেরা এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের বর্ডারে। প্রায় বিশ মিনিট ড্রাইভ করে হোটেলে পৌঁছালাম। সবাই কমবেশি টায়ার্ড। রুমে ঢুকে ঘণ্টাখানেক রেস্ট নিয়ে নিলাম। রাতে আমাদের সবার ডিনারের দাওয়াত। অথইদের বাসায়। সস্প্রতি অথই ঢাকা থেকে সিডনি হয়ে ওর হাসবেন্ড জয়ের সাথে ক্যানবেরাতে সেটেল করেছে। আমার লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল দৈনিক আজকের কাগজের ছোটদের পাতায় লেখালেখির মাধ্যমে। তখন ‘আজকের শিশু আজকের কিশোর’ পাতার সম্পাদক ছিলেন গল্পকার, সাংবাদিক মাহবুব রেজা। মাহবুব রেজার একমাত্র মেয়ে অথই। অথইয়ের রান্না করা মজার মজার খাবার খেয়ে। জমিয়ে আড্ডা দিয়ে যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় বারোটা! যে যার মতো রুমে ঢুকে দিলাম ঘুম।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে আরও একবার টিউলিপের রাজ্যে ঢুঁ দিলাম। আরও কিছু ছবি তোলা হল। ক্যানবেরা মানেই শীত শীত, ঠান্ডা! কখনও কখনও তাপমাত্রা মাইনাসে চলে যায়! আকাশ মেঘলা থাকে। আমাদের ক্যানবেরা ভ্রমণকালীন সময়ে আবহাওয়া খুবই ভালো ছিল। এবার সিডনি ফেরার পালা।
টিউলিপ শো চলে সোমবার থেকে শুক্রবার প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। উইকএন্ড এবং পাবলিক হলিডেতে খোলা থাকে সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। টিউলিপের রাজ্যে প্রবেশের জন্য কোনো টিকেট লাগে না। একদম ফ্রি। তবে শো শেষ হবার কমপক্ষে ১৫মিনিট আগে প্রবেশ করতে হয়। রাতেও বিশেষ শো, নাইট ফেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। নাইটফেস্টের জন্যে গেট খুলে দেয়া হয় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। গেট বন্ধ করা হয় সাড়ে দশটায়। এবারের নাইট ফেস্ট ২৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলেছিল ২ অক্টোবর পর্যন্ত। তাই আমরা ’নাইট ফেস্ট’ দেখতে পারি নাই। কমনওয়েলথ পার্কেও টিউলিপ শো’তে স্থানীয় পারফর্মারদেও নানা ধরণের শারীরিক কসরতও দেখানো হয়। শিশুদের জন্যে থাকে বিশেষ আয়োজন। তবে সবার, সব আকর্ষণ থাকে টিউলিপ ফুলকে ঘিরেই।