ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী আফিফা হোসেন। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে গতবছর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে মারা যান তার মা। সে এবং তার পিতা আমিরুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নেন মরদেহ দাফন করবেন আজিপুর কবরস্থানে। কারণ তারা তিন ভাই বোনই ঢাকায় বসবাস করছেন। কিন্তু যখন জানতে পারলেন আজিপুরে সাধারণ কবর বেশি দিন রাখা সম্ভব না। আর সংরক্ষণ করতে গেলে গুণতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। তখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দেশের বাড়ি যশোরে নিয়ে মায়ের মরদেহ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয় আফিফার পরিবার।
বলা হয়ে থাকে: স্বপ্নের নগরী ঢাকায় আপনি আপনার উপার্জন দিয়ে ১টা, ১০টা কিংবা তারও বেশি ফ্লাট কিনতে পারবেন। জমি কিনে স্থায়ী বসতি গড়তে পারবেন। যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেন। কিন্তু জীবনকাল শেষে স্থায়ী ঠিকানার সুযোগ নেই এ শহরে। তাই এখন অনেকের মৃত্যুর পর তাদের স্বজনেরা মরদেহ দাফনের জন্য ছুটছেন ঢাকার বাইরে। যেন প্রিয়জনের স্মৃতিটা কিছুদিন ধরে রাখা যায়।
ঢাকায় কবর দেওয়ার জায়গার সঙ্কট বেশ বহুদিন থেকেই ছিলো আলোচনায়। এমন পরিস্থিতিতে, ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত ঢাকায় স্থায়ীভাবে কবর কিনে রাখার ব্যবস্থা ছিলো। ঐ বছর ঢাকায় কবর সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তার পর থেকে দু’বছর ২০০৭ পর্যন্ত সব রকমের সংরক্ষণ বন্ধ ছিলো। ২০০৭’র পর থেকে মেয়াদি সংরক্ষণের সুযোগ দেয় সিটি করপোরেশন। তবে স্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। তাই এখন আর কেউ চাইলেই সারাজীবনের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে আবার কবর সংরক্ষণ ব্যয় কোটি টাকারও বেশি।
এসকল বিষয়টি মাথায় রেখে ঢাকায় কবর দেওয়ার প্রবণতা কমেছে আগের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি। আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন তিনটি কবরস্থানের তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রতিবছর ঢাকায় দাফনের সংখ্যা কমেছে।এর মধ্যে ২০২১ সালে ঢাকা দক্ষিণ ও ২০২২ সালে উত্তর সিটি করপোরেশনে কবরের খরচ বাড়ায়। যার প্রভাবও পড়েছে এখানে।
কথা হচ্ছিলো আফিফার সঙ্গে তিনি আমাদের জানালেন: মায়ের চলে যাওয়া নিশ্চিত এমন পরিস্থিতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই মায়ের দাফন করবো আজিমপুর কবরস্থানে। এখানে মা থাকলে অনেক মানুষের দোয়া পাবে। তাছাড়া, আমরা তিন ভাই বোনও ঢাকায় বসবাস করছি। তাই আজিমপুরে দাফন করতে চাইছিলাম। কিন্তু যখন আজিমপুরে গেলাম তখন বুঝতে পারলাম এখানে দাফন করলে আমার মায়ে স্মৃতি ৬ মাসের মধ্যে মুছে যাবে। না হয় প্রতি মাসে ওখানকার লোকদের টাকা দিয়ে দিয়ে কবর টিকিয়ে রাখতে হবে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আবার মেয়াদি সংরক্ষণে যে খরচ সেটাও বহণ করার সমর্থ আমার পরিবারের ছিলো না তাই শেষ মেষ মায়ের মরদেহ নিজ ভিটায় নিয়ে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছেন ২৫০০ জন মানুষ। যার মধ্যে ৬৫ শতাংশ মারা যান অসংক্রামক ব্যধির কারণে, ২৪ শতাংশ মারা যান বার্ধক্যজনিত কারণে। বাকিরা মারা যাচ্ছেন বিভিন্ন দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য কারণে। যার একটি বড় অংশের মৃত্যু হচ্ছে ঢাকায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শেষ পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান বলছে প্রতিবছর ঢাকায় লোক এবং মৃত্যু বাড়লেও দাফন কমছে ঢাকায়। এই মরদেহ গুলোর স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকার বাইরে সুবিধাজনক জায়গায়।
পরিসংখ্যান বলছে: আজিমপুর কবরস্থানে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে যথাক্রমে দাফন হয়েছে ৯৫৬৫, ৮২৪৫, ৭৬৬২, ৭৮৮৮ ও ৫৭১৬টি (২০২৩-২৪ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত) মরদেহ।
জুরাইন কবরস্থানে (ধলপুর কবরস্থান ও মুরাদপুর কবরস্থানসহ) পাঁচ বছরে দাফন হয়েছে ৪০৬৮, ৩৫০৫, ৩৪৭৬, ৩২৫৬ ও ২২৪১টি (২০২৩-২৪ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত) মরদেহ।
খিলগাঁও কবরস্থানে ২০১৯-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে দাফন হয়েছে ০৯, ৬৫৭, ৬৮৫, ৫৬৭ ও ৪০৮টি (২০২৩-২৪ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত) মরদেহ।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে: জায়গার অভাবে কবর সংরক্ষণ ব্যবস্থা সীমিত করা হয়েছে। এখন সিটি করপোরেশনের হাতে যতগুলো কবর আছে, তার সঙ্গে নতুন করে কবর যোগ হওয়ার সুযোগ নাই। তাই যে কেউ চাইলেই কবর সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সুপারিশে কখনও কখনও কবর সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া কোন মুক্তিযোদ্ধার দাফনের পর ১০ বছর পর্যন্ত তার কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
আজিমপুর কবরস্থানের প্রধান গোর খোদক মোহাম্মদ ফরুক এ পেশায় আছেন ৪০ বছর হলো। তার বাবা দাদাও এখানে গোর খোদক হিসেবে কাজ করতেন। একসময় বাবার সঙ্গে আসতে আসতে এ পেশায় ঢুকে যান ফারুক। আগে ভয় লাগলেও এখন ভয় লাগে না বলে জানান তিনি। মরদেহ দাফনের পাশাপাশি নানা সময় আইনী জটিলতায় যেসকল মরদেহ পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য তোলা হয় সেগুলোও তারাই করে থাকেন বলে আমাদের জানান তিনি।
ফারুক বলেন: আগে এক সময় এখানে প্রতিদিন ৭০টার মতো মরদেহ প্রতিদিন দাফন করা হতো। এখন প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি মরদেহ দাফন করা হয়। আমরা আগে থেকে কিছু কবর খুঁড়ে রাখি। যেনো মরদেহ আসার সঙ্গে সঙ্গে দাফন করা যায়।
প্রতিদিন দুই শিফটে ৪৬জন গোর খোদক এবং কবর পরিচর্যাকারী আজিমপুর কবরস্থানে কাজ করেন বলে জানান ফারুক। সাংবাদিক দম্পতি পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য দাফনের ৩ মাস পর তিনিই নিজ হাতে কবর খুঁড়ে তুলেছিলেন তিনি।
আজিমপুর কবরস্থানের ইনচার্জ মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান: আজিমপুর কবর স্থানে ৩৫ একর জায়গায় প্রায় ৩০ হাজারের মতো কবর রয়েছে। মরদেহ দাফনের সকল সুব্যবস্থা রয়েছে এখানে। এখনও মানুষ মৃত্যুর প্রিয়জনের কাছে আজিমপুরে দাফনের ইচ্ছে পোষণ করে যায়। কারণ এখানে অনেক সিারাদিনই দোয়ার ব্যবস্থা থাকে। আজিমপুর কবরস্থানের আকর্ষণ কোন অংশে কমে যায়নি বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেইলি রোডে কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। কিছু মরদেহ আজিমপুরে আসবে এমন চিন্তা থেকে কিছু কবর প্রস্তুত করে রাখা হলেও সেই দুর্ঘটনায় নিহত কারও মরদেহ আজিমপুরে দাফন হয়নি বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান মোহাম্মদ হাফিজুর।
ভিডিও চিত্র:
এদিকে যারা সাধারণ কবরের জন্য আজিমপুর আজিমপুরে আসেন, তাদের স্বজনরা না ধরনের হয়রানির অভিযোগ করে থাকেন। যেমন: কোন মরদেহ দাফনের জন্য দক্ষিণে ১০০০ ও উত্তরে ৫০০ টাকা চার্জ ধার্য আছে। সঙ্গে যোগ হয় বাঁশ চাটাইয়ের খরচ। কিন্তু মরদেহ কবরস্থানে আসার সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে যায় দালাল চক্র। কবরে জন্য ভালো জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়ার নামে দাবি করা হয় টাকা। আবার কবর দিয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্বজনদের নিদৃষ্ট পরিচর্যাকারীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। সেই পরিচর্যাকারীকে প্রতিমাস এবং ঈদে খুশি রাখতে পারলেই ঠিকে থাকে কবর নইলে। কিছুদিন পর স্বজনদের এসে দেখতে হয় তার আত্মীয়ের জায়গায় নতুন করে আরেকটি কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এমনই অবস্থার শিকার লালবাগের মনির হোসেন। আজিমপুরে বাধাই করা একটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। তার কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন: এই জায়গায় আমার বাবার কবর ছিলো। ২০০৪ সালে এক সকালে এসে দেখি বাবার কবরের ওপর আরেকটি কবর হয়ে গেছে। আর সেটি সিমেন্ট দিয়ে বাধাই করে ফেলা হয়েছে। বাবার শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। চ্যানেল আই অনলাইনের এ প্রতিবেদকে কাছে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন মনির।
এখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ঢাকায় কবর দেওয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহীত করা হচ্ছে। ঢাকায় কবর দেওয়অর জায়গা কমে যাওয়ায় সম্ভব হলে ঢাকা বাইরে নিজ জেলায় নিয়ে কবর দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহীত করা হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম বলেছেন: আমাদের ধর্মের যে পবিত্র স্থানগুলো আছে- মক্কা শরীফ, জান্নাতুল বাকী; কোন স্থানে কোথাও কেউ একটি ইটের গাথুনি দিতে পারে না। সবই অস্থায়ী, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে সবাই কেন জানি স্থায়ী স্থায়ী চায়। স্থায়ীকে ডিজকারেজ করার জন্য এতো দাম আমরা করেছি। অনেকে দেখা গেছে সাধারণ কবরে কবর দিয়েছে। পরে তারা বলে আমরা এই কবরটা সংরক্ষণ করতে চাই! তখন আমরা তার কাছ থেকে তিনগুণ টাকা চার্জ করছি।
লাখ থেকে কোটি টাকা লাগে কবর সংরক্ষণে:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট চারটি কবরস্থান রয়েছে। এগুলো হলো: আজিমপুর কবরস্থান, জুরাইন কবরস্থান, মুরাদপুর কবরস্থান ও খিলগাঁও কবরস্থান। এ চারটি ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে খরচ করতে হবে যথাক্রমে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ লাখ টাকা। আবার এ কবরগুলোয় যদি পুনঃদাফন করা হয় তাহলে খরচ করতে হবে আরও ৫০ হাজার টাকা। তবে এ সংরক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছ আবেদন করতে হয়। সেই আবেদন গৃহীত হলে তবেই কবর সংরক্ষণ করা যায়।
এটা হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চিত্র। এবার চোখ ঘোরানো যাক উত্তর সিটি করপোরেশনের দিকে। সেখানে এলাকা ভেদে কবর সংরক্ষণের জন্য গুণতে হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। ভিন্ন ভিন্ন জায়গার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের টাকা। উত্তর সিটি করপোরেশনে কবর রয়েছে ৬টি। এগুলো হলো: বনানী কবরস্থান, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার কবরস্থান, উত্তরা ৪ নং সেক্টর কবরস্থান, উত্তরা ১২ নং সেক্টর কবরস্থান ও উত্তরা ১৪ নং সেক্টর কবরস্থান। এ কবর স্থান গুলোতে ১৫ ও ২৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে।
এরমধ্যে বনানী কবরস্থানে ১৫ ও ২৫ বছরে জন্য কবর সংরক্ষণের জন্য গুণতে হয় যথাক্রমে ১ কোটি ও দেড় কোটি টাকা। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এ খরচ ২০ ও ৩০ লাখ টাকা। রায়ের বাজার কবরস্থানে এ খরচ ১০ ও ১৫ লাখ টাকা। উত্তরা ৪ নং সেক্টর কবরস্থানে এই খরচ ৭৫ লাখ ও ১ কোটি টাকা। উত্তরা ১২ নং সেক্টর কবরস্থানে সেই খরচ ৫০ লাখ ও ৭৫ লাখ টাকা। উত্তরা ১৪ নং সেক্টর কবরস্থানে খরচ ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকা।
আর সংরক্ষিত কবরস্থান গুলোতে পুনঃকবর দেওয়া হলে বনানীতে গুণতে হবে ৫০ হাজার টাকা। অন্য পাঁচটি কবরস্থানে সেই খরচ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা।
দুই সিটি করপোরেশনেই পুনঃ কবরের ক্ষেত্রে স্বামী, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছাড়া অন্য কারও কবর দেওয়ার অনুমতি নেই। এছাড়া যারা কবর সংরক্ষণ করতে চান না বা সংরক্ষণের সক্ষমতা নেই তারা ঢাকা উত্তরে ৫০০ দক্ষিণে ১০০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে মরদেহ দাফন করতে পারবেন। সঙ্গে যোগ হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া বাঁশ ও চাটাইয়ের দাম।
(ঢাকার কবরস্থান নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন)