নোয়াখালীর জেলার বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা জাহেরা বেগম। প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ স্বামী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে এক সময় খালের পাড়ে বসবাস ছিল তার। বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে কোনওভাবে দিন কাটতো তাদের। শীতের দিনে-তো পরিবারটির কষ্টের কোনো শেষ ছিল না। তাদের না ছিল কোনও সামাজিক স্বীকৃতি না ছিল সুস্থভাবে বেঁচে থাকার কোন উপায়।
গৃহহীন হওয়ায় লোকে তাদের সম্মান তো দূরে থাক, কেবলই দূর ছাই করতো। কিন্তু এখন আর জাহেরা খাতুনের সেই দিন নেই। জাহেরা এখন নিজ বাড়িতে তার পরিবার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের নিজ বাড়ির আঙিনায় হাস-মুরগী পালন, শাকসবজি চাষ ও নকশীকাঁথার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুইশতক জমিসহ ঘর পরিবারটির জীবন বদলে দিয়েছে। জাহেরা বেগম বলেন, গর্ভধারিণী মা আমাদের যা দিতে পারেননি, শেখ হাসিনা মায়ের মতো আমাদের তা দিয়েছেন। এজন্য উনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
আশ্রয়ণের ঘর পাওয়া সুবিধাভোগীদের আরেকজন ভ্যানচালক আবদুর রহিম। চার মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ব্রীজের গোড়ায় ঝুপড়ির মতো ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করতেন তিনি। বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়তো। জীবনে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাওয়ার পর তাদের আর সেই সমস্যা নেই।
রহিম বলেন, আমাদের নিজের কোনো ঘর ছিল না। অর্থের অভাবে মেয়েদের পড়াশোনাও করাতে পারিনি। যা রোজগার করতাম সংসারই ঠিকমতো চলত না। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঘর পেয়ে আমরা খুবই ভালো আছি। এখানে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, পানি, বিদ্যুৎ ও রাস্তাসহ সব ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের জীবন এখন আর আগের মতো নেই, পুরোপুরি বদলে গেছে। লোকে এখন আমাদের সম্মানের চোখে দেখে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামের কৃষক আইয়ুব আলী। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণের ঘরে থেকে নিজের তিন মেয়েকে পড়াচ্ছেন। বড় মেয়েকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অফিসারের কাছে বিয়ে দিয়েছেন। শুনে চোখ কপালে উঠলেও, এটাই বাস্তব। আশ্রয়ণের ঘর এভাবেই তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। অন্যদিকে পাশের গ্রামের বিন্নাকান্দির বাসিন্দাদের একই চিত্র। মাত্র দুই বছর আগেও এখানকার শাহানা বেগম ও শরিফ উদ্দিন আর দশটা হতদরিদ্র পরিবারের মতোই ছিল। আজ তাদের রয়েছে ছয়টি গরু, একটি ছাগল, সঙ্গে একটি মিশুক। দুই ছেলে এখন স্কুলে যায়। স্বামীর পরিশ্রমের অর্ধেক টাকা সঞ্চয় হয় তাদের পরিবারে। তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে আগের থেকে অনেক ভালই আছেন শাহানা বেগম।
তিনি বলেন, বছর দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণের ঘর পাওয়ার আগে আমাদের জীবন এমন ছিল না। আমরা আগে মাটির ঘরে থাকতাম, খুব কষ্ট করে থাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঘর পাওয়ার পর এখন অনেক ভালো আছি। শেখ হাসিনার জন্য এখন আমাদের জীবনে কোনো দুঃখ নেই।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এভাবেই সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে, তৃতীয় লিঙ্গ, জলবায়ু উদ্বাস্তু, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীসহ সকল ভূমিহীন-গৃহহীন জনগোষ্ঠীকে জমিসহ ঘর দিয়ে তাদের সামাজিক মানমর্যাদা উন্নত করা এবং তাদেরকে উন্নয়নের মূলস্রোতে নিয়ে আসছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। উপকারভোগীর সংখ্যা ও পুনর্বাসন পদ্ধতি বিবেচনায় এটি বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচি। এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ ছিন্নমূল মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন। কিছুদিন আগেও যাদের ছিল না কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই, তারা এখন রঙিন টিন আর আধাপাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক কর্মসূচির বদৌলতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে বদলে গেছে দেশের লাখ লাখ পরিবারের জীবনচিত্র। দুই শতক জমিসহ ঘর পাওয়ার পর প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে কৃষি থেকে শুরু করে নানান কাজের মধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন তারা। গৃহহীন এসব হতদরিদ্র মানুষেরা বাড়ির আশ্রয়ণের আঙ্গিনায় শাক-সবজির চাষ করছেন, আবার কেউ কেউ হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, কবুতর লালন পালন করে স্বনির্ভর হয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভূমিহীন পরিবার পুনর্বাসনের মতো উন্নয়নমূলক বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো পুনরায় শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে তিনি কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন এবং একই বছর তিনি সারাদেশের গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’।
এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন করা। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা, আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, ব্যাপকহারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন করা এবং গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।
২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ বলে ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত চারটি ধাপে সারাদেশে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫১টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে গড়ে পাঁচজন করে সদস্য হিসাবে মোট ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫ জন ছিন্নমূল মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছেন। উপকারভোগীর সংখ্যা ও পুনর্বাসন পদ্ধতি বিবেচনায় এটি বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচি। এর মাধ্যমে দেশের ২১টি জেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।) এর মধ্যে মুজিববর্ষে ঘর পেয়েছেন সবচেয়ে বেশী।
যেসব সুবিধা পাচ্ছেন উপকারভোগীরা
আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী যৌথ মালিকানায় বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ ও সুপেয় পানির সুবিধাসহ ২ শতক জমি ও একটি সেমি পাকা ঘরের মালিক হচ্ছেন। এতে রয়েছে গোসলখানা, শৌচালয় ও রান্নাঘর। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো হচ্ছে। প্রতি ১০টি পরিবারের সুপেয় পানির জন্য থাকছে একটি করে নলকূপ। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন সুবিধাভোগীরা। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আশ্রয়ণের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের শরীর গঠন ও বিনোদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় রয়েছে খেলার মাঠ। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রামের সব নাগরিক সুবিধাই থাকছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
অনগ্রসর ও ছিন্নমূল পুনর্বাসিত পরিবারসমূহ বসত ভিটার আঙ্গিনায় সবজি চাষ, পশু পালনসহ প্রকল্পের সংলগ্ন পুকুরে মৎস্য চাষ করছেন। তাদেরকে উৎপাদনমুখী কাজের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যারাকে বসবাসকারী সুবিধাভোগীদের মৎস্য চাষ, পাটি বুনন, নার্সারি, নকশীকাঁথা, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক ওয়ারিং এবং রিকশা-সাইকেল-ভ্যান গাড়ি মেরামতের মতো ৩২টি পেশায় প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের আয়-রোজগারের যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে উপকারভোগীরা সমবায় সমিতি গঠন করে আয়-বর্ধনকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন। পুনর্বাসিত পরিবার প্রতি প্রাথমিকভাবে তিন মাসের ভিজিএফ-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, বিধবা, বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তারা। অর্থাৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে একজন নিঃস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
আশ্রয়ন প্রকল্পের এই ধারা অব্যাহত থাকলে সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন দেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা শূন্যতে নেমে আসবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)