৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরেই দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৭৪ সালে। কিন্তু এর পটভূমি তৈরি হয়েছে তার দেড়শতাধিক বছর আগে। যুগে-যুগে নারীরা সংগ্রাম করেছে নিজেদের অধিকারের জন্য, নিজেদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে। তবে এই সংগ্রাম কোনও অযৌক্তিক ভিতের ওপরে নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, নারী তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে আসছে।
প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত, সমাজের সকল স্তরে নারীরা নিজেদের মেধা, যোগ্যতা, শ্রম দিয়ে স্থান করে নিয়েছে। যখনই নারী অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা হয় বা লেখালেখি হয়, তখনই, আমরা একটি মনভাঙা চিত্র দেখতে পাই। আমি মানি, নারীদের যেটুকু প্রাপ্য, তা হয়ত সম্পূর্ণভাবে এখনও অর্জন করতে পারিনি। তবে আমরা এসেছি অনেকটা পথ, যেতে হবে আরও বহুদূর, স্বপ্ন আমাদের সুদূরপ্রসারী, লক্ষ্যে আমরা পৌঁছবই।
এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পরিবর্তনের জন্য সাহসী হতে হয়’ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি দেশ, একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারে বহুদূর।
আমরা, আমাদের দেশ- বাংলাদেশকেই দেখি। দেশের জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের নারীরা তাদের জীবন বাজি রেখে, নিজের সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে, স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। একদিকে যেমন তারামন বিবি, করুণা বেগম, গীতা কর-এর মতো হাজার নাম জানা বা না জানা নারী মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি সিতারা বেগম, আর্জাতুন্নেসারা সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে পরম স্নেহে সেবা করেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের।
একজন নয়, লাখো জাহানারা ইমাম দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন তার আদরের সন্তানকে। শুধু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি নারীর ভূমিকা। একজন মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। সেই নিজেকেও উৎসর্গ করেছেন লক্ষ-লক্ষ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীরা।
নয় মাসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যুদ্ধ করেছেন; অস্ত্র দিয়ে নয়, নিজেকে দিয়ে, নিজের প্রতিটি সত্ত্বা দিয়ে। নয় মাস পর যুদ্ধ শেষ হলো। অর্জন একটি নতুন স্বাধীন দেশ। আবারও হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, পুরুষদের পাশে কাজ করেছে এদেশের নারীরা। যদিও এই সময়ে তাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা সীমিত, তবে তার প্রভাব ছিল সুদূর বিস্তৃত। দেশ গড়ার প্রয়োজনে যখন পুরুষরা কাজ করেছে কল-কারখানায়, তখন নারীরা গুছিয়েছে সংসার, মিটিয়েছে সংসারের প্রয়োজনগুলো। ঘরের মধ্যে ও এর আশে-পাশে কাজ করে, নিজস্ব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সংসারে এনেছে আর্থিক সচ্ছলতা।
এভাবে তাদের নেওয়া ছোট-ছোট উদ্যোগ পরবর্তী সময়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে সাহায্য করেছে। প্রত্যেক নারীর জীবনে তিনটি ‘স’ খুবই গুরত্বপূর্ণ। স্বামী, সন্তান ও সংসার। আশির দশকে নারীরা দেশের জন্যে কাজ করেছে নিভৃতে। স্বামীর সঙ্গে গড়ে তুলেছে নিবিড় পারিবারিক বন্ধন, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তৈরি করেছে শক্ত ভিত, সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে।
সময় এগিয়ে গেছে। সরকার ৬ থেকে ১০ বছরের সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কারণেই আজ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতায় বাংলাদেশ প্রথম। নিজেদের শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে নারীরা আজ আত্মনিয়োগ করেছে জাতীয় অর্থনীতিতে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে এদেশের নারী শ্রমশক্তির হার বেড়েছে প্রায় দিগুণ। সত্তর দশকের শেষ দিকে ৮২% নারীই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতেন যার মধ্যে ৭০% গ্রামীণ নারী কাজ করতেন কৃষি জমিতে, হাঁস-মুরগি প্রতিপালনে। ৮০’র শুরু থেকেই নারীরা ক্রমাগত ঘরের বাইরে, দেশের অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে শুরু করে। এই সময়ে নারী শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ তৈরি পোশাক শিল্পে নিজেদের নিয়োজিত করে। বর্তমানে প্রায় ৫৬০০ গার্মেন্টসে চার মিলিয়নের বেশি নারী পুরুষ যুক্ত, যার মধ্যে ৮০% ওপরে নারী। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে পোশাক শিল্প থেকে। গত অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৪.৪৯ বিলিয়ন ইউ এস ডলার।
অনায়াসেই বলতে পারি, অক্লান্ত শ্রম দিয়ে নারী দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে, রাখছে সাফল্যের স্বাক্ষর। শ্রমবাজারে আসি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী,তখন দেশে এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে ছিলেন । ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে প্রায় ৪৯ লাখ নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছেন। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে।
শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আট লাখ ৪৯ হাজার নারী দিনমজুর রয়েছেন, যারা মূলত নির্মাণশ্রমিক। পুরুষদের মধ্যে যেখানে বেকারত্বের হার বাড়ছে, সেখানে নারীদের বেকারত্বের হার কমেছে। ২০০৬ সালে যেখানে নারী বেকারের হার ছিল ৭ শতাংশ, ২০১০ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। আর পুরুষের ক্ষেত্রে দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। আবার যুবশক্তিতে তরুণীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৬ লাখ তরুণী শ্রমবাজারে ছিলেন। আর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখে। আলোচ্য সময়ে তরুণীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে তরুণ-তরুণী মিলিয়ে মোট যুবশক্তিতে রয়েছেন দুই কোটি বিশ লাখের কাছাকাছি । সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরাই তরুণ প্রজন্ম।
খ্যাতনামা ব্রিটিশ জার্নাল ল্যানসেট বলে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ল্যানসেট-এর তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘ আয়ু, সর্বনিম্ন মোট প্রজনন হার এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সকল দেশ থেকে সর্বনিম্নে ও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
‘হেলথ ট্রাসেন্ড্স প্রোভার্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে গবেষকরা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে একটি প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭৬ সালের পর গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য সেবায় মাঠ পর্যায়ে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। ফলে আজ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ পৌঁছে যেতে পেরেছে তার মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-এ। সামরিক বাহিনীতে এক সময় কেবলই পুরুষ ছিল। এই চিত্র এখন বদলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী এবং বিচক্ষণ চিন্তার ফসল, সেনা ,নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ।
সেনাবাহিনীতে নারীরা শুধু দেশে নয়, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষায় ও সম্মানজনক একটি স্থানে নিজেদের নিয়ে গেছে। ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এদেশের ৮০০’র বেশি নারী সৈনিক শান্তিরক্ষায় বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত। বিমান বাহিনীতে সম্প্রতি দুজন নারী হেলিকপ্টার বৈমানিক যুক্ত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর এই সব নারী সৈনিকরা শুধু পেশাদারিত্ব নয়, তাদের ব্যক্তিত্ব, তাদের কর্মদক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে। সেনাবাহিনী ছাড়াও পুলিশ,আনসার, কমিউনিটি পুলিশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এন জি ও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয়ও এদেশের নারীরা তাদের যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করছে। দেশের আইটি সেক্টরে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে নারীরা এগিয়ে আছে সামনের সারিতে। খেলাধুলায়ও নারীরা পিছিয়ে নেই। সরকারি চাকুরিতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে আলাদা কোটা। সংসদেও নারী আসন ৫০ থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে এই সরকারের আমলে।
স্থানীয় ও উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ পর্যায়েও নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী। বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসের একটি প্রধান মাইলস্টোন ১৯৯৭ সালে জারি করা দ্বিতীয় সংশোধন, যার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) পর্যায়ের নির্বাচনে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে সরাসরি নির্বাচনের আইন জারি করা হয়েছিল।
বর্তমান সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০১১-২০১৫) মাধ্যমে ২০২১ সালের (ভিশন ২০২১) মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সকল কর্মকান্ডে নারীর প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করে, নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার নারীর ক্ষমতা ও লিঙ্গ সমতার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন এমজিডি ২০১৫ অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ, তেমনি সকল প্রকার নারী বৈষম্য দূরীকরণ ও বেইজিং প্লাটফর্ম কনভেনশন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষকে সমান অধিকার দিয়েছেন। ইউএনডিপি এর অভিমত, ‘বাংলাদেশ নারী লিঙ্গ সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত উদ্দেশ্য উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।’
বর্তমান সরকার নারীকে মূলধারার আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম এ সমান এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ আশ্বস্ত করার লক্ষ্যে এবং তাদের ক্ষমতায়ন করার জন্য সব বাঁধা অপসারণ করে নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গাপ রিপোর্ট ২০১২’ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার এর এই নারীবান্ধব নীতির কারণেই নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের স্থান ৮ম। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে, লিঙ্গ সম্পর্কিত উন্নয়ন সূচক (এউও) রেকর্ড এ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, নারীর সরব উপস্থিতি বেগম রোকেয়ার দিন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, আজকের শাহবাগ আন্দোলনের সকল স্তরে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বই বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বলে বিবেচিত হতে পারে। লিঙ্গ সমতার কারণে অর্জিত নারীর ক্ষমতায়নই সেই শুভ পূর্বাভাস, যা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে। আমরা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, সেই একই লক্ষ্যে, একই স্বপ্নে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। জয় আমাদের হবেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)