আর কদিন পরেই ৭ই নভেম্বর। এ দেশের ইতিহাসের কলঙ্কজনক একটি দিন। বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে সেদিন নির্মমভাবে নিহত হত মুক্তিযুদ্ধের তিন কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা। “কে” ফোর্সের খালেদ মোশাররফ, ক্র্যাক প্লাটুনের স্বপ্নদ্রষ্টা মেজর হায়দার, আর আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী কর্নেল হুদা। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুজন কোম্পনি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল। যারা ছিলো কর্নেল তাহেরের “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা” র সদস্য। শুধু এই তিনজনকেই নয়, সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস এ ব্যাপারে তাঁর “বাংলাদেশ, এ লিগ্যাসি অফ ব্লাড” গ্রন্থে লিখেছেন ‘এ ছাড়াও এদিন উচ্ছৃংখল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তার (ক্যাপ্টেন হামিদা) সহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়।’
ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্রের মতো ভাগ্য আরো একবার সহায় হলো তার। কিছু মানুষ আসলেই চরম সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম নেন পৃথিবীতে। জিয়া তাদেরই একজন অনস্বীকার্যভাবেই। কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র যেভাবে একাত্তরে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সুযোগ এনে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই কর্নেল তাহেরের জাসদ আর তার “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ” কথিত সিপাহী জনতার বিপ্লবের নামে একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করে তাকে বসিয়ে দেয় ক্ষমতার মসনদে। আর তিনি স্বগর্বে শুরু করেন, “Money is no problem” এর শতরঞ্জির খেল।
৭৫ এর ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ভেঙে পরে সামরিক বাহিনীর চেইন অফ কমান্ড। খুনী নিম্নপদস্থ অফিসারদের দম্ভে তীব্র আক্রোশে ফুসতে থাকেন উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা। মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম বিভেদ। এমতাবস্থায় ৩ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে। ক্ষমতাচ্যুত হয় মোশতাক চক্র। ঠিক এই সময় রাজনীতিতে নতুন পদক্ষেপ নেয় জাসদ।
রাতারাতি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর এই দলটি দীর্ঘদিন ধরেই সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ” নামের এক অতিবিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলে কর্নেল তাহেরের মাধ্যমে। ‘সমাজতন্ত্রের’ স্বপ্নে বিভোর তাহের, জলিল, জিয়াউদ্দিন দের মত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার হয়ে জড়িয়ে পড়েন এর সঙ্গে। ৭ই নভেম্বরে জাসদ গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা মিলে সংঘটিত করে পাল্টা অভ্যুত্থান।
“সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই ,
অফিসারের রক্ত চাই ”
স্লোগান দিতে দিতে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে খালেদ, হায়দার, হুদাকে। তাহের মুক্ত করেন জিয়াকে। বসান ক্ষমতার মসনদে।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জিয়া ক্ষমতা পেয়েই চরম দমন নীতি চালান জাসদের উপর। ৭ নভেম্বরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্নেল তাহের সহ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে জড়িত অধিকাংশ অফিসার ও জওয়ানকে কোর্ট মার্শালের প্রহসনে রাতের অন্ধকারে ফাঁসি দেয়া হয়। চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয় জাসদকে। সেই যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তারা, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি অদ্যবধি। “লক্ষ্য শূন্য লক্ষ বাসনা” থাকার নাটকের এপিটাফ যে ট্র্যাজেডি, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাসদ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পরবর্তীকালে আসম রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, মইনুদ্দীন খান বাদলদের রাজনৈতিক অবস্থান তারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে অদ্যাবধি। আর যার অঙ্গুলি হেলনে রাতারাতি লাল পতাকার নেশায় মেতে উঠেছিলেন তারা, বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ খ্যাত সেই সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা দেশের প্রতিটি রাজনীতি সচেতন মানুষেরই তো জানা আছে।
কর্নেল তাহের তাঁর আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দিতে নিজেই বলেছেন, “৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর ভোররাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে বলে ঠিক হয়। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল: ১. খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, ২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, ৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, ৪. দল-মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দান, ৫. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন করা। সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়।
ভোর রাতে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আমি ভোর তিনটার দিকে সেনানিবাসে যাই। সঙ্গে ছিল ট্রাকভর্তি সেনাদল। জিয়াকে আমি তাঁর নৈশ পোশাকে পেলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকতসহ আরও কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক ছিল। জিয়া আমাকে আর আমার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। জলভরা চোখে তিনি আমাদের তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁর জীবন রক্ষার জন্য জাসদ যা করেছে, তার জন্য জিয়া আমার প্রতি ও জাসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আমরা যা বলব, তিনি তা-ই করবেন। আমরা তখন পরবর্তী করণীয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি। তখন ভোর চারটা। আমরা একসঙ্গে বেতার ভবনে পৌঁছাই।
পথে আমরা তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি। এর মধ্যে বেতার থেকে সিপাহি অভ্যুত্থানের ঘোষণা করা হয়। জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দেওয়া হয়। বেতার ভবনে যাওয়ার পথে জিয়া শহীদ মিনারে একটা জনসমাবেশে ভাষণ দিতে রাজি হয়েছিলেন। তাই কথামতো আমি শহীদ মিনারে সমবেত হতে সিপাহিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম। ঠিক হয়, সেখানে আমি ও জিয়া সমাবেশে ভাষণ দেব। তাহলে অফিসারদের ছাড়াই যে বিপ্লবী সৈনিকেরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে, সেই সৈনিকদের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার থেকে কেউ পিছু হটাতে পারবে না।”
পৃথিবীর যেকোনো আধুনিক সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক সংশ্রব সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সেই জায়গায় সেই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা”র এহেন কর্মকান্ড ছিলো সম্পূর্ণ ভাবে আইনের পরিপন্থী। যার কারণে তাদের ফাসিঁতে ঝুলিয়ে ক্ষমতায় বসানোর ঋণ শোধ করতে বেশী বেগ পেতে হয়নি জিয়ার। শত্রু মিত্র চিনতে পারার ব্যর্থতার মূল্য তাই কড়া দামেই শোধ করতে হয়েছিল কর্নেল তাহেরদের।
আর এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিবিজড়িত দিনিটিকে বিএনপি পালন করে “ জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস” হিসেবে, আর জাসদ পালন করে “ সিপাহী জনতার বিপ্লব” হিসেবে! কীসের বিপ্লব? কীসের সংহতি? ঐদিন কার সঙ্গে কার সংহতি হয়েছিল? বিএনপি দিবসটি উদযাপন করে কারণ দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট জিয়া হতে পেরেছিলেন এই দিনটির কল্যাণেই। এই দিনটি না আসলে যেটি কোনদিনই স্বপ্নেও ভাবতে পারতেননা তাঁরা। তাই এই দিনটিকে ঘিরে তাঁদের উৎসাহ থাকাটা যথেষ্ট স্বাভাবিক। কিন্তু সেদিনের এই তথাকথিত বিপ্লবের সাথে জেনারেল জিয়ার সংশ্লিষ্টতা ইতিহাসের পাতায় মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়না। এই তথাকথিত বিপ্লবের ভূমি বা চাষী কোনটিই ছিলেননা তিনি। ছিলেন তার ফল মাত্র। সেদিনের এই হত্যা উৎসবের মূল কুশীলব ছিলো জাসদ গণবাহিনী আর তাঁদের নেতা “ক্রাচের কর্নেল” খ্যাত কর্নেল তাহের। মুক্তিযোদ্ধার হাত রঞ্জিত হলো মুক্তিযোদ্ধাদেরই রক্তে। আর এই রক্তস্নানের নাম দিয়েছেন তাঁরা “বিপ্লব”!! ধরণী দ্বিধা হও…।
এখানে জাসদ আর কর্নেল তাহের প্রসঙ্গে কটি কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতার অনেক আগেই “ভবিষ্যতের স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা নিয়ে ছাত্রলীগে বিভাজনের শুরু। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন অংশটির নেতৃত্বে ছিলেন রহস্যমানব খ্যাত সিরাজুল আলম খান। আর জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অংশটির নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। শহীদ স্বপন চৌধুরী স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তাব ও করে ফেলেছিলেন। বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের দুই নেতা সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাকের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের একাংশের মধ্যে ‘অতিবাম’ প্রবণতা লক্ষ করে করে রাজ্জাক উদ্বিগ্ন হন। … ‘লাল সালাম’ স্লোগানে তার ঘোর আপত্তি ছিল। … অথচ, একাত্তর সালের অক্টোবরে বিএলএফ-এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিরাজুল আলম খান প্রথম ‘মুজিববাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। রাজ্জাক এটা সমর্থন করেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরই ছাত্রলীগের মধ্যে ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ- মুজিববাদ মুজিববাদ’ – এই স্লোগান চালু হয়ে যায়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই সিরাজপন্থীরা এই স্লোগান বন্ধ করে দেয়। তবে বাহাত্তরের জানুয়ারিতেই জাতীয় শ্রমিক লীগের ব্যানারে ‘লাল বাহিনী’ তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়। (পৃষ্ঠা-৭৩) {জাসদের উত্থান পতন; অস্থির সময়ের রাজনীতি}
১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাহের সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। দীর্ঘ পদত্যাগপত্রে এর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এক স্থানে লিখেন: ‘‘আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। যারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল।’’ শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের জন্য তাহেরের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি তার ক্ষোভ ছিল অপরিসীম। তাহের মনে করতেন, ‘মুজিব সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়নে চরম অবহেলা দেখিয়েছে এবং রক্ষী বাহিনীর মত একটা কুখ্যাত আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে। তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাহের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেননি। তবে ওইদিনই অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাহের মেজর রশীদের অনুরোধে সকাল নটায় ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যান। তার পরামর্শে ডালিমরা সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে আসেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য।
দুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি আঁচ করতে। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ‘ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে এ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখনতো সেখানে মাজার হবে। উচিৎ ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলা দেওয়া। (’মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি।)
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তাহের বছর তিনেক সেনাবাহিনীর বাইরে থেকে সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে ‘সৈনিক সংস্থা’ গঠন করেন, যা ছিল কার্যত জাসদ-এর অঙ্গ সংগঠন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “জিয়াকে নিয়ে তাহের যে জুয়া খেলেছিলেন, তার মূল্য যে শুধু তিনি দিয়েছেন, তা নয়। মূল্য দিতে হয়েছে পুরো দলকে, জাসদের হাজার হাজার কর্মীকে। অনেককে পলাতক জীবন বেছে নিতে হয়। কিছু কিছু ষড়যন্ত্রও হয়। চক্রান্ত করে সিরাজুল আলম খানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ঢাকা নগর জাসদের কোষাধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে। ঢাকা নগর গণবাহিনীর হাইকমান্ড তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। ছিয়াত্তরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশ দিয়ে রিকশায় চড়ে যাওয়ার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।” (পৃষ্ঠা : ২২৩) মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি
ঢাকার পূর্ব পাশে বেরাইদ গ্রামে ঢাকা নগর গণবাহিনীর একটা জরুরি সভায় আনোয়ার হোসেন এই ঘটনার সব দায় স্বীকার করেন। সভায় শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অধিকাংশ সদস্য আনোয়ারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর দাবি জানান। শেষে তাঁকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। তাঁকে নগর গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। (পৃষ্ঠা : ২১১) মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি
১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর খালেদ মোশাররফসহ সকল দেশপ্রেমিক অভ্যত্থানকারীদের ‘ভারতীয় চর’ বলে লিফলেট ছড়ায় কর্ণেল তাহেরের জাসদের সহযোগী সংগঠন গণবাহিনী (বিবিসি বাংলা, ৫-১১-২০১৫)।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী বরখাস্ত বর্বর মেজর ডালিম তার বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ এ ৭ নভেম্বর খালেদ ও তার অনুসারীদের হত্যার পর কথিত সিপাহী জনতার স্লোগান লিখেছেন। তার কয়েকটি-
-খন্দোকার মোশতাক জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
-মেজর ডালিম জিন্দবাদ
কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ
-ডালিম তাহের ভাই ভাই
বাকশালীদের রক্ষা নাই
-সিপাহী জনতা ভাই ভাই
খালেদ চক্রের রক্ত চাই
[৭ নভেম্বর….জনতার অভ্যুত্থান]
এ দিকে খালেদ তার অনুগত সেনাবাহিনী নিয়ে ৩ নভেম্বরই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের প্রতিষ্ঠিত খন্দকার মোশতাকের সরকারকে ‘রক্তপাতহীন’ সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উৎখাত করেন। সেদিনেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৪ নভেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত খালেদ মোশাররফ ও তার অনুসারীগণ জানতেন না জেল হত্যাকাণ্ডের খবর। তিনি চেয়েছিলেন ১৫ আগস্টের দুষ্কৃতকারীদের হটিয়ে ’৭১-এর মূল চেতনায় পুনরায় দেশকে একত্রিত করতে। তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু তার স্থিতি ছিল মাত্র ৩ দিন।রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান করার উদ্দেশ্যে জিয়াকে খালেদের নির্দেশে তার বাসভবনে বন্দি করে রাখেন ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। জিয়ার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু হাফিজুল্লাহ ভুলে যান অথবা তার জানা ছিল না বেডরুমেও একটি টেলিফোন আছে।
যুদ্ধাহত পঙ্গু বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) আবু তাহেরের (বীরউত্তম) সঙ্গে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সুসম্পর্ক ছিল। তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। জিয়া বেডরুম থেকে ফোন করে তাহের বলেন, ‘তাহের সেভ মাই লাইফ।’
তাহের জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকাতে তার অনুগত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হন। এ সময় তার সঙ্গে ছিল জাসদ কর্মীরা।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে লিখেছেন-
‘১৯৭৫ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে ছড়ানো হলো হাজার হাজার প্রচারপত্র। এ কাজগুলো করলো বামপন্থী জাসদ। এ সময় রাজনৈতিক দল জাসদ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরা কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর আবরণে।তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় ৭ নভেম্বর। তাহের জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানই খালেদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রক্তপাত হলে সমসাময়িক সময়েই আরব্য রজনীর গল্পের মতো বদলে যেতো ইতিহাস। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাত আর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড শুরু হলো। এ দিনেই, জিয়া ও তাহেরের নির্দেশে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বীর সেনানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, কর্নেল এটিএম হায়দার বীরউত্তম ও কর্নেল নাজমুল হুদা বীরবিক্রম, সেনা অফিসার, সিপাহীসহ আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে। জাসদের গণবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একের পর এক সামরিক অফিসারদের নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে। ”
লেখক গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কর্নেল শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেয়েও থেকে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু যখন বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। এতে তার পা ভেঙ্গে যায় এবং পরে ধরা পড়েন। তার জায়গা হয় সামরিক হাসপাতালে। অবশ্য তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
এর আগে ৬ নভেম্বর ভোর রাতে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবু রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার অন্যতম ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিলোএই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর আর্টিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে।”
গোলাম মুরশিদ আরো বলেন,” মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহামস্মদ সায়েমের অনুমতি ব্যতিরেকে বেতারে ভাষণ দিতে চলে যান। ’৭১-এর ২৭ মার্চের মতোই সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দাবি করেন। পরে অবশ্য পদবী বদলিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন।”
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা ওই সময়ের কিছু গোপন দলিল ও নথিপত্রের দেখা যায় যে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ৭ নভেম্বররের সিপাহী বিদ্রোহকে মূলত সিপাহীদের রুটি-রুজির প্রশ্নে অসন্তোষের ফল হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। মার্কিন দূতাবাসের উপপ্রধান ছিলেন আরভিং জি. চেসল। তিনিও বিষয়টি সেভাবেই দেখেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে, জেনারেল জিয়াকে সামনে রেখে যে “বিপ্লবের রঙিন ফানুস” স্বপ্নে দেখেছিলো জাসদ কর্মীরা, তা যে এক মর্মান্তিক বিভ্রান্তিই ছিলো, কোন বিপ্লব ছিলোনা, ফাঁসির মঞ্চে বিদায়ের কবিতা পড়ে আরেক বীর উত্তম “ক্রাচের কর্নেল” নিজেই তা প্রমাণ করে গেলেন।
তথ্যসূত্রঃ
১। অসমাপ্ত একাত্তর মুক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্জায়”, শেখ বাতেন।
২। “অসমাপ্ত বিপ্লব তাহেরের শেষ কথা,” লরেন্স লিফশুলৎস।
৩। “আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম”, হুমায়ুন আজাদ।
৪। পঁচাত্তরের নভেম্বরঃ কর্নেল তাহের:এক অমীমাংসিত চরিত্র”, এম.শাহাদুজ্জামান।
৫ । “সশস্ত্র বাহিনীতে গনহত্যাঃ (১৯৭৫-১৯৮১), প্রামাণ্যচিত্রের গ্রন্থরূপ, আনোয়ার কবির।
৬ । “ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর”, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮।
৭। “নভেম্বর ৩-৭ , ১৯৭৫”, নুরুজ্জামান মানিক।
৮। মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র”, সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
১০। “সংগ্রামের তিন দশক”, খোকা রায়।
১১। “১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানসমূহ”, উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া।
১২। মহিউদ্দিন আহমদ, জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি,
১৩। ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ মেজর ডালিম
১৪। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গোলাম মুরশিদ
১৫। ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)