চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

১৫ আগস্ট রথী-মহারথীদের অসহায় আত্মসমর্পণ

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ৪৬ ব্রিগেডের অবস্থা দেখে হতভম্ব অবস্থায় সশস্ত্র মেজর রশিদের চাপের মুখে রেডিও স্টেশনে যেতে রাজি হন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ। ‘আমি একা যাবো না। এয়ার এবং নেভাল চীফের সঙ্গে কথা বলি,’ বলার পর তাদের খবর দেওয়া হয়, তারাও সেখানে আসেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

তার দাবি, কোনো কাউন্টার অ্যাকশনে রক্তপাত ও সিভিল ওয়ার হতে পারে ধারণা করে তিনি মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমের অস্ত্রের মুখে রেডিও স্টেশনে যেতে বাধ্য হন। এই সময়ের মধ্যে এয়ার এবং নেভি চীফও সেখানে পৌঁছে যান। ডলিম এবং অস্ত্রধারীরা তাদের স্কট করে।

শফিউল্লাহ জানান, রেডিও সেন্টারে ঢুকেই তিনি খন্দকার মুশতাককে বসা অবস্থায় দেখেন। তার ডান পাশে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দাঁড়ানো। খন্দকার মুশতাক তখন সাদা প্রিন্সকোট, মাথায় টুপি এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি ও মাথায় সাদা কিস্তি টুপি ছিলো।

রুমে ঢোকার পর খন্দকার মুশতাক তাকে বলে: কনগ্র্যাচুলেশন্স। ইওর ট্রুপস হ্যাভ ডান এন এক্সিলেন্ট জব। নাউ ডু দ্যা রেস্ট। শফিউল্লাহ তখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, হোয়াট দ্যা রেস্ট? খন্দকার মুশতাক বলে, ইউ শুড নো ইট বেটার।

‘ইন দ্যাট কেস লিভ ইট টু মি,’ বলে তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসছিলেন দাবি করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে মে. জে. (অব.) শফিউল্লাহ বলেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর তখন মুশতাককে বলে, স্যার, উনাকে থামান। উনার আরো দরকার আছে।

ঠাকুরের এ কথার সঙ্গে সঙ্গে ডালিম, রশিদ এবং অপর একজন, সম্ভবতঃ মোসলেম, তাকে আটকে ভিন্ন রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে তাকে আনুগত্য স্বীকারের একটি খসড়া লিখে দেয় এবং তা শফিউল্লাহর কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়।

সেনাপ্রধানের পাশাপাশি বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানও সেদিন আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।

মামলার ৪৮ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ১৫ আগস্ট ভোরবেলা জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে ফোন করে বলেন, শুনেছেন বঙ্গবন্ধু অ্যাসাসিনেটেড হয়েছেন? তিনি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, আর ইউ শিওর? উত্তরে শফিউল্লাহ বলেন, হ্যাঁ।

এরপর শুধু প্যান্ট-শার্ট পরে পায়ে হেঁটে তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর বাসায় গিয়ে জেনারেল জিয়াকে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখেন। দুয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ খন্দকারের মতোই ক্যাজুয়াল ড্রেস পরে সেখানে উপস্থিত হন। তাৎক্ষণিক আলোচনায় তারা বুঝতে পারেন, মাত্র কয়েকটি আর্মি অফিসার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

পরে তিনি বাসায় গিয়ে ইউনিফর্ম পরে এয়ার হেডকোয়ার্টারে আসেন এবং সিনিয়র অফিসারদের ডেকে এয়ারফোর্সে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা বজার রাখার নির্দেশ দেন। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ শফিউল্লাহর টেলিফোন পেয়ে তিনি ৪৬ ব্রিগেডের একটি অফিসে যান জানিয়ে এ কে খন্দকার বলেন, সেখানে মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ সম্পূর্ণ সশস্ত্র অবস্থায় ছিলো। তাদের সঙ্গে কালো এবং খাকি পোষাক পরা কিছু সৈনিকও ছিলো। সেখানকার অবস্থা ছিলো পুরোপুরি বিশৃঙ্খল।

এ কে খন্দকার জানান, নেভি চীফও সেখানে ছিলেন। আর এর আগেই জেনারেল শফিউল্লাহকে রেডিও সেন্টারে যেতে রাজি করানো হয়েছিলো।

খন্দকারের দাবি: যে কয়েকটি আর্মি অফিসার সশস্ত্র অবস্থায় ছিলো তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই ‘অয়্যার অন দ্যা এজ অফ ইরেশনালিটি এন্ড টেনশন। সামান্যতম কনফ্রন্টেশন বা ডিসএগ্রিমেন্ট কুড হ্যাভ লিড টু স্প্রি অব কিলিং। আন্ডার দ্যা সারকামস্টেন্সেস, আই ওয়াজ ফোর্সড টু গো টু রেডিও স্টেশন এন্ড সো ওয়াজ এডিমরাল খান (নেভি চীফ)।’

তাদেরকেও শফিউল্লাহর মতো এস্কট করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয় জানিয়ে আনুগত্যের ঘোষণা পাঠ করতে বাধ্য হওয়ার বিষয়ে তার বক্তব্যও শফিউল্লাহর মতোই। পরের বর্ণনাও তাই। তাদেরকে এস্কট করে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে খন্দকার মুশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং অন্য কয়েকজন মন্ত্রি হিসেবে শপথ নেয়।

রেডিও স্টেশনের মতো শপথ অনুষ্ঠানেও জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফসহ অন্য সিনিয়র অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডিমরাল এম এইচ খানও শফিউল্লাহ এবং এ কে খন্দকারের মতো অসহায় আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য যে শফিউল্লাহ এবং খন্দকার মুক্তিযোদ্ধা, আর এম এইচ খান ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত।

তিনি জানান: ১৫ অাগস্ট ফজর নামাজের পর তার বাসার দক্ষিণ রাস্তার ওপারে সার্কিট হাউসের একটি বাসায় রেডিওর আওয়াজ থেকে একটি ঘোষণা শুনেন: আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, আর্মি ক্ষমতা দখল করেছে।

এ খবর শোনার পর জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করে না পেয়ে ইউনিফর্ম পরে তিনি এ কে খন্দকারের বাসায় যান। খন্দকার তখন নাইট ড্রেসে ছিলেন। খানকে খন্দকার বলেন, আপনি শফিউল্লাহর বাসায় যান, আমি আসছি। শফিউল্লাহর বাসায় গিয়ে নৌবাহিনী প্রধান একজন জওয়ান ছাড়া আর কোনো আর্মি দেখেন নি বলে এম এইচ খান জানান। তিনি শফিউল্লাহকে ডেকে দিতে বলে বৈঠকখানায় বসেন। তখন জেনারেল জিয়াকে বাগানে ফুল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখেন। একটু পর খালেদ মোশাররফ সেখানে আসেন।

জেনারেল শফিউল্লাহ প্রেসাডেন্টের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তেমন কিছু জানেন না জানিয়ে তাকে নেভাল বেস, হাজী মুহসীনে যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর তিনি আর শফিউল্লাহর অবস্থান জানতেন না। পরে অনেককে জিজ্ঞেস করে তিনি ৪৬ ব্রিগেডে পৌঁছে সেখানে খুব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখেন।

নৌবাহিনী প্রধানের পরের বর্ণনাও সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধানের মতো। তিনিও আনুগত্য ঘোষণার একইরকম প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে জানান, তার কণ্ঠেও আনুগত্য ঘোষণাপত্র রেকর্ড করা হয়।

তিনবাহিনী প্রধানের মতো পুলিশ ও বিডিআর প্রধান এবং রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানের আনুগত্যের ঘোষণা রেকর্ড করে প্রচার করা হয়।

সেসময়ের বিডিআর প্রধান মে. জে. (অব.) খলিলুর রহমান ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জানান: সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আর্মির একজন ক্যাপ্টেন এসে জানায়, মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুকের একটি বার্তা আছে। বার্তাটি ছিলো: আমরা জুনিয়ররা যা করার করেছি। আপনারা সিনিয়ররা এসে পরিস্থিতি সামলান, দেশটাকে বাঁচান। অন্য সিনিয়র অফিসাররা রেডিও স্টেশনে আছেন। আপনারাও সত্ত্ববর চলে আসুন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করুন।

এরপর জেনারেল খলিল তার অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করে সবাই একমত হন, যেহেতু তিন বাহিনী প্রধান অানুগত্য স্বীকার করেছেন, এই অবস্থায় তিন বাহিনীর বিপক্ষে অন্যকিছু করা গৃহযুদ্ধের সামিল হবে।

খলিলুর রহমান পরে সকাল সাড়ে ১০টা/ ১১টার দিকে রেডিও সেন্টারে গেলে খন্দকার মুশতাক তাকে বলে, ঘটনা যা হবার হয়ে গেছে, এখন আপনারা পরিস্থিতি সামলান, দেশকে বাঁচান।

জবাবে অন্য অফিসারদের মতো জেনারেল খলিলুর রহমানও বলেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’ এরকম বলে তিনিও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

(আগামীকাল দশম কিস্তি: ১৫ আগস্ট কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রিগেড কমান্ডার)