চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

হো চি মিন এর দেশে ৪

হা লং বে (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

(হা লং বে: প্রথম পর্বের পর)

কথা প্রসঙ্গে শিক্ষক হেনরি জানালেন, এর আগে তিনি ভারতে ভ্রমণ করেছেন। ডিসেম্বরের ছুটিতে আবারো যাবেন। আমরা বাংলাদেশি শুনে জানালেন, সময় পেলে চেন্নাই, দিল্লীসহ অন্যান্য শহর ঘুরে বাংলাদেশেও যাবেন।

সজল তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি জানো বাংলাদশ আলাদা একটি দেশ? সে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার ভুল ভাঙ্গাতে বললাম, ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান একটি দেশই ছিল। এখন তিনটি দেশ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন দেশ হয়েছি। আমাদের কথার মধ্যেই শিক্ষক ভদ্রলোক গুগল ম্যাপে গেলেন। ম্যাপে বাংলাদেশের অবস্থান দেখলেন। হাসতে হাসতে বললেন কতকিছু জানা হয়নি এখনো। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস জেনে বিস্মিত হলেন, বললেন সুযোগ হলে বাংলাদেশ সফর করবেন।

কায়াকিং

আমাদের গল্পের মধ্যেই দলের অন্যরা আসলেন, আমরা ছোট নৌকায় চেপে রওনা হলাম। গুহা দেখার পর উত্তেজনাপূর্ণ কায়াকিং এর পালা। হালং বে’র শান্ত জলে নৌকা চালানো। বিশেষ এই নৌকা চালানোকেই বলা হয় কায়াকিং। সাধারণত দুজন চালানোর জন্য এই নৌকা বাননো হয়। তবে তিনজন বা একজনের জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে। খুবই সরু প্লাস্টিকের তৈরি নৌকাগুলো দেখতে খুব আকর্ষণীয়। চালানোও খুব সহজ। মি. টমি আমাদের দলকে ৪০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন কায়াকিং এর জন্য।

বিশেষ ওই নৌকায় আমরা ফুরফুরে মনে ভেসে বেড়ালাম। এর মধ্যেও ফিদেলের তাড়া। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, দেরি করা যাবে না। আমাদের জাহাজে ফিরতে হবে। আবারো একই অবস্থা। আমরা ডেকে বসে আছি, বাকিদের খবর নাই। ১৫-২০ মিনিট পর সবাই ফিরলো, দুজন ছাড়া। অবস্থা বেগতিক দেখে নৌকা নিয়ে ছুটলেন মি. টমি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবাই ফিরলো।

ফিদেলের প্রিয় ডিশ, কোন একটা চিকেন আইটেম

এবার জাহাজে ফেরার পালা। আমাদের আশেপাশে আরো অসংখ্য জাহাজ রাজহাসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকা থেকে ছোট্ট জাহাজে ফিরে আমরা সামান্য ফলাহার করলাম। এখন আমাদের অবসর, সকাল পর্যন্ত। মাঝে সবাই একসঙ্গে হব ডিনারের জন্য। জাহাজে ডিনার টেবিলগুলোর পাশে রয়েছে বসার ব্যবস্থা। জাহাজের ছাদেও আছে দীর্ঘ সময় কাটানোর সুব্যবস্থা।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ডিনার। ঘোষণার সময়েই মি. টমি বলে দিলো ‘বিগ ডিনার’। আসলেই বিগ ছিল। ডিনার পরিববেশনা, মেনু সব দিক দিয়েই ছিল নজরকাড়া। খাবার পরিবেশনা এতো সুন্দর ছিল যে আমরা খাবার খাওয়ার আগে টপাটপ ছবি তুলতে শুরু করলাম।

খাবারের পরিবেশনা দেখে খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে

ডিনারের পর ১৯ জনের দল কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আড্ডা দিল। মার্কিন নাগরিকদের ছোট দলে ফিদেলও যোগ দিল। সে এ পর্যন্ত কোন কোন দেশ সফর করেছে, বড় হয়ে সে কী হবে ইত্যাদি বলতে থাকলো। ফিদেলের কথায় মজা পেয়ে আড্ডার সদস্যরাও নানা প্রশ্ন করতে থাকলো। ফিদেল উৎসাহ পেয়ে জানালো, সাংস্কৃতিক স্কুলে সে নাটকের রিহার্সেল করে। নাটকের বিষয়ও সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বোঝালো। চান্স পেয়ে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেললো, “আই ডোন্ট লাইক ইওর প্রেসিডেন্ট। ওবামা ওয়াজ বেটার। ট্রাম্প সিমস টু বি আ স্টুপিড!” ফিদেলের কথা শুনে বাকিরা হো হো করে হেসে উঠলো। আমি তো পাশে থেকে ভয়ে অস্থির! তারা আবার না রেগে যান।

রাতের হা লং বে

তারা এক পাশে বসে আড্ডায় মত্ত। আমার আরেক পাশে সজল। আমি ভেবে চলেছি কতকিছু। দেশে আর একদিন পর ঈদ উল আজহা। স্বজনরা সবাই ঈদের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আর আমরা সব ধরনের ব্যস্ততার বাইরে। দেশ থেকে কোন দূরে জলের বুকে ভেসে আছি। এমন রাত কাটানো জীবনের এক অধরা স্বপ্ন ছিল। দেশের থাকতে মন চাইলেও ভেবে নিতাম এমন স্বপ্ন বাস্তবে সম্ভব না। নিরাপত্তার সঙ্কটে দেশের কোথাও নদীর বুকে নৌকায় থাকার চিন্তাও করিনি। এরা যে শত শত পর্যটককে নিরাপদে ভ্রমণের সুযোগ করে দিচ্ছে তাতে তাদের অর্থনীতিই লাভবান হচ্ছে। আমরা কেন এমন নিরাপত্তা দিতে পারি না?

আমাদের অক্ষমতার কথা ভাবতে ভাবতেই গুগল ম্যাপে দেখার চেষ্টা করলাম, আমি তখন ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করছিলাম। ম্যাপের একটা স্ক্রিনশটও নিয়ে রাখলাম। আহা জীবন! মানুষের মন তার জীবনকে কখন কোথায় নিয়ে পাড়ি জমায়! বিচিত্র এই মানুষ!

গুগল ম্যাপে আমাদের অবস্থান

রাত দশটা বাজলে আড্ডার মধ্যে থেকে ফিদেলকে নিয়ে উঠলাম, সকাল সকাল নাস্তা করতে হবে তাই আগেভাগে ঘুমাতে চাই। চলে আসার সময় শিক্ষক ভদ্রলোক বললেন, তোমার ছেলে অনেক স্মার্ট! আমি সঙ্গে যোগ করলাম, সে চাপাবাজও বটে। ভদ্রলোক হেসে দিলেন। সান্ধ্যকালীন পুরো আড্ডায় একমাত্র বিরক্তির বিষয় ছিল নিকটবর্তীয় জাহাজে উচ্চস্বরে বাজানো গান।

সকাল সাতটায় নাস্তা করে আবারো যাত্রা শুরু। এবার আমরা সাড়ে চারশ’ সিড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠবো। পুরো হালং বে এক নজরে দেখার উদ্দেশ্যে। খাড়া সিড়ি বেড়ে পাহাড়ের মাথায় উঠতে আমাদের গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু কষ্ট করে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর চোখ জুড়ানো অনাবিল দৃশ্য। কখনো ভোলার নয় সেই সৌন্দর্য। এক নজরে হালং বে দেখা যায় সেই চূড়া থেকে। কিন্তু সেখানেও কিছু সময় তিস্টানোর জো নেই। চূড়ার ছোট্ট জায়গায় পর্যটক গিজ গিজ করছে। সঙ্গে সেই ফিদেলের তাড়া। কারণ আমাদেরকে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই এক ঘণ্টার মধ্যে পাহাড় বেয়ে ওঠানামার পর সমুদ্রে সাঁতার। সাঁতারে নামতেই হবে তা নয়। কিন্তু সাঁতার পুরোপুরি না পারলেও পানি দেখলেই ফিদেলের নামা চাই-ই। তাড়াহুড়া করে পাহাড় থেকে নেমে আসলাম। পোশাক পাল্টে ফিদেল বাপকে নিয়ে পানিতে নেমে পড়লো। আমি আফসোস নিয়ে তাদের সাঁতার শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলাম। কারণ আমি সাঁতারের পোশাক সঙ্গে নেইনি। তাই পানিতে নামা হলো না।

পাহাড়ের চূড়া থেকে হা লং বে

সাঁতার শেষে যার মতো আবার ছোট নৌকায় উঠলো সবাই। মি. টমি নির্দেশনা দিল, সকাল ১১টার মধ্যে যার যার রুম চেক আউট করে সবাই শিপের লিভিং রুমে লাগেজসহ সমবেত হবে। কারণ পরের ট্রিপের লোকজনের জন্য জাহাজের রুমগুলো পরিষ্কার করতে হবে। রুম চেক আউট করে আমরা কী করবো? লিভিং রুমে বসে থাকবো। ১২টায় লাঞ্চ। লাঞ্চ করতে করতে আমরা জেটিতে পৌঁছে যাব।

যেই কথা সেই কাজ। রুমে ফিরে গোসল সেরে আমরা লিভিং রুমে সমবেত হলাম। সবার চোখ শিপের বাইরে হালং বে’র জলে। ফেরার আগে নিজেদের চোখে সৌন্দর্য ধারণ করা। কারো কারো ক্যামেরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কোনো কোনো টেবিলে চললো কার্ড খেলা। কানাডার বান্ধবীরা বই পড়ছেন। কারো চোখ মোবাইল ফোনে। ফিদেল আর তার বাবা ব্যস্ত হিসাব-নিকাষে। হালং বে তে প্রতিদিন কত জাহাজ চলে। সেইসব জাহাজে কত পর্যটক ভ্রমণ করেন। তারা প্রতিদিন কত ডলার খরচ করছেন। সেখান থেকে ভিয়েতনাম কত ডলার আয় করছে ইত্যাদি। হিসাবের অংক এত বড় দাঁড়ালো যে তাদের মাথায় হাত!

হিসাব করতে করতে লাঞ্চের সময় হলো। লাঞ্চ শেষ না করতেই জলের ধারে ভূমির দেখা মিললো। মানে, আমাদের জাহাজ ছেড়ে ফিরতে হবে। আবারো হ্যানয় ফেরার পালা। গুড বাই হালং বে।

চলবে