চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

হেফাজতকে প্রশ্রয় দেয়ার ফল যা হতে পারে

এ বছরের নববর্ষ উদযাপন খানিকটা ভিন্নভাবে হয়েছে। এদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা ভারাক্রান্ত মনে পালন করেছে নতুন বছরের প্রথম দিন। নববর্ষের ঠিক আগের দিন গেজেট প্রকাশ করে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষাস্তর দাওরা-ই হাদিসকে স্নাতকোত্তরের সম্মান। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট থেকে ন্যায় বিচারের প্রতীক থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়ার জন্য হেফাজতে ইসলামের দাবীর প্রতি নমনীয় বক্তব্য রেখে প্রধানমন্ত্রী তার দলের গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে আপোষ করেছেন বলে আলোড়ন উঠেছে রাজনৈতিক এবং সামাজিক আলোচনায়।

অবশ্য এরপর হেফাজত শুধু সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত সকল ভাস্কর্য অপসারণ করার আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, নববর্ষ উদযাপন ইসলাম সম্মত নয়। ২০১২ সালের শেষের দিক থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য বিএনপি’র মদদে জামায়াতে ইসলামী দেশব্যাপী শত শত মানুষকে হত্যা করে; ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট, যানবাহন ধ্বংস করে ব্যাপক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করে।

এর এক পর্যায়ে এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবী নিয়ে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। এই ঘটনার আগে হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না দেশবাসীর। এরা কারা বা কি উদ্ধেশ্যে সংগঠিত তা শুধু ইসলামী রাজনীতি এবং সংগঠনগুলো সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারাই জানতেন।

মতিঝিল ঘেরাও করার পর সাধারণ মানুষ জানতে পারল যে দেশের বেশিরভাগ কওমি মাদ্রাসাগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে হেফাজতে ইসলামের। এদের নেতা আল্লামা শফি’র ডাকে কয়েক হাজার মাদ্রাসা থেকে বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র- শিক্ষক মিলে লাখ পঞ্চাশেক মানুষ পথে নেমে পড়তে পারে। হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচয় দিলেও মূলত তারা শরিয়া আইন তথা ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ।

হেফাজত সম্পর্কে যারা ১৩ সালের আগে থেকে জানতেন তারা একই উদ্দেশ্যে, একই মঞ্চে জামায়াত এবং হেফাজতকে দেখে যার পর নাই বিস্মিত হয়েছেন। কওমী ভিত্তিক হেফাজত সর্বদা জামায়াত বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালালেও সেই হেফাজত কি করে জামায়াতের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য মতিঝিল ঘেরাও করে তা বিশ্লেষকদের বিস্ময়াবিভূত করে। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ‘ইসলাম বিরোধী’ আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার কাজে তারা একই মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

জামায়াত উগ্র ইসলামী ঘরানা এবং ওয়াহাবীজমের ধারক-বাহক। অন্যদিকে হেফাজত সুফিবাদী। এই দুই ধারার মধ্যে ইসলামী দুনিয়ায় বিরাট ব্যবধান থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় এদের কিছুটা নিকটে এনে দিয়েছে পেট্রো ডলার এবং সৌদি রাজনীতির নিরাপত্তা রক্ষক, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সৌদি রাজশক্তি ওয়াহাবিজমের পৃষ্ঠপোষক। তাদের পৃষ্ঠপোষকতার কিছু অংশ পায় হেফাজতের তীর্থ, দেওবন্দ মাদ্রাসা। দেওবন্দ উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোন মাদ্রাসাগুলোর অন্যতম। এরা উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখে। সুফিজমের সঙ্গে অধুনা তারা ওয়াহাবিজমের চর্চাও শুরু করেছে। এদের অনুসারী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে কাজ করে।

ধর্মীয় দর্শনে সংগঠন দুটির মধ্যে বিস্তার ফারাক থাকলেও জামায়াত এবং হেফাজতের মধ্যে কতগুলো মিল রয়েছে। এই দুই ধারাই পাকিস্তানপন্থী। এরা একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতা করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে অনেকে এসেছে নেজামে ইসলাম থেকে; অনেকে এখনো নেজামে ইসলামের সঙ্গে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। নেজামে ইসলামের সদস্যদের অনেকেই কুখ্যাত শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। হেফাজতের প্রাণকেন্দ্র হাটহাজারী মাদ্রাসা একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প হিসেবে কাজ করেছে। এখনকার হেফাজতের লোকেরা মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের ধরে এনে হত্যা, নির্যাতন ধর্ষণ করেছে।

নারী স্বাধীনতার বিরোধী হেফাজত নেতা আল্লামা শফি বিভিন্ন বক্তৃতায় নারীদের নিয়ে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার থেকে মন্তব্য করেছেন। এরকম একটি বক্তব্য ১৩ সালে ছড়িয়ে পরে সামাজিক মাধ্যমে।

তিনি নারীদের চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে বলেছেন, রোজগার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন মেয়েদের ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করলে চলবে। তাতে তারা স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব করতে পারবে, নারীর জন্য অতটুকু শিক্ষাই যথেষ্ট।

তিনি নারী-পুরুষের সামাজিক মেলামেশার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সামাজিক মেলামেশা সমাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরী করে। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেন, অধিক সন্তান উৎপাদনের জন্য তাগিদ দেন এবং পুরুষদের বহু বিবাহে উৎসাহী করেন।

এতকিছুর পর হেফাজতের সঙ্গে  মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্য হয় কি করে? এই সমঝোতার ভিত্তি কি হতে পারে? এর পরিণতিই বা কি হবে? এমন বহু প্রশ্ন দানা বেঁধেছে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মনে। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে না – এভাবেই ভাবতে শিখেছে সাধারণ মানুষ। তাই গণভবনে হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের বৈঠক প্রগতিশীল মানুষদের বিস্মিত করেছে।

হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার দুটি কারণ হতে পারে। এক. হেফাজত নেতার জঙ্গিবাদ বিরোধী বক্তব্য এবং দুই. ধর্মীয় রাজনীতির ধারায় জামায়াতের বিপক্ষে শক্তিশালী আরেকটি পক্ষ দাঁড় করা।

জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক আছে বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়। এর পক্ষে কিছু প্রমাণাদীও রয়েছে। জামায়াতের ভেতর দিয়ে বের হয়ে জঙ্গিবাদী সংগঠন জেএমবি সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জেএমবি’র পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত সংশ্লিষ্টদের যোগসাজোশ পাওয়া গিয়েছে। ১৩ সালে হেফাজত সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নিলেও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার কোন প্রমাণ গণমাধ্যমে আসেনি। তদুপরি হেফাজত নেতার জঙ্গি বিরোধী বক্তব্যের কারণে তাদের জঙ্গি বিরোধী শিবিরে পাওয়ার আশা করছে সরকার। হেফাজতের নেতা-কর্মীদের জঙ্গি বিরোধী অভিযানে কাজে লাগাতে পারলে সরকার তথা দেশবাসী উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে।

অন্যদিকে এরা শক্তিশালী হলে সর্বোচ্চ আদালত ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতের প্রতি সাধারণ ধার্মিক মানুষদের যে আনুগত্য আছে হেফাজত শক্তিশালী হলে তা জামায়াতের প্রতিকুলে চলে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। অন্য কথায়, হেফাজতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ধর্মীয় কারণে যারা ইসলামী সংগঠনে ভোট দেয় তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি সম্ভব হবে বলে আশা করছে সরকারী দল, আওয়ামী লীগ। তাদের এই প্রত্যাশা সঠিক হলে জামায়াতে ইসলাম দুর্বল হবে। জামায়াত দুর্বল হলে দুর্বল হয়ে পড়বে প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি। এক কথায় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র।

আওয়ামী লীগ যে কারণেই হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে থাকুক না কেন তা মেনে নিচ্ছে না তার প্রগতিশীল সমর্থকেরা। না মানার প্রধান কারণ – হেফাজত সাম্প্রদায়িক সংগঠন, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধ্বজাধারী। এ সমঝোতার প্রতিবাদ করেছে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত অন্যান্য দলগুলোও। প্রতিবাদ এসেছে জোটের বাইরে থাকা অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন থেকেও। সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রগতিশীলরাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত সমর্থক। এদের সংখ্যা যাই হোক না কেন, এরা সঙ্গে না থাকলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সমর্থকদের মধ্যে আদর্শগত কোন পার্থক্য থাকে না। এই পার্থক্য না থাকলে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকে না।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ফলে হেফাজত দিন দিন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এ শক্তিসমূহ ভবিষ্যতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে তারা একদিকে এমপি, মন্ত্রী হয়েছে অন্যদিকে সত্তর হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশকে ধর্মান্ধে পরিণত করেছে। দেশকে পাকিস্তানের মত জঙ্গিবাদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু হওয়ার পর থেকে তারা দুর্বল হয়েছে। এখনো নির্মুল হয়নি। কিন্তু তাদের দুর্বলতার সময়ে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মান্ধ হেফাজত শক্তিশালী হয়ে আরেক উগ্রবাদের জন্ম দেবে এমন ধারণা অমূলক নয়।

হেফাজতকে এখন বেড়ে ওঠার সুযোগ দিলে আবারও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই অনিবার্য হয়ে উঠবে। শুরু করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় পর্ব।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)