১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তৎকালীন বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে বন্দুকের মুখে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সামরিক শাসন জারি করেন। তাকে যে বন্দুকের মুখে যে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল; এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় কোন এক প্রকাশ্য জনসভায় বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। আমি সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলাম। সেই থেকে শুরু এরশাদের ৯ বৎসরের স্বৈরাচারী রাজনৈতিক আমল ।
১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ হয়। গঠিত হয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বিএনপির ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত হতে না পারলেও আলাদাভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের উপর সামরিক বাহিনীর ট্রাক তুলে দেয়া হয়। নিহত হয় সেলিম-দেলোয়ার, আরও বহু ছাত্র-ছাত্রী পঙ্গু হয়ে যায়। আজও তারা পঙ্গু জীবন যাপন করছে ।
১৯৮৪ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আবারও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিবাদ মিছিলে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় জাফর-জয়নাল-কাঞ্চন-দীপালিসহ অনেক নাম না জানা তরুণ-তরুণীকে, যাদের লাশ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই সময় রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও নির্বাচনের দাবিতে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। এইভাবে এই দেশের মানুষ স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দেয়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় ১৫ দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭ দলীয় ঐক্য জোট। ছাত্র অঙ্গনে আগেই গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি যৌথ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি শুরু হয়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ ভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। কখনও তীব্র, কখনও মাঝারি, কখনও শুধু রুটিন কর্মসূচী ইত্যাদির মাধ্যমে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন অব্যহত থাকে।
এরই মধ্যে স্বৈরাচার এরশাদ নির্বাচনের আভাস দিলে ১৯৮৫ সালে দুই জোট ১৫ দল ও ৭ দল এর এর মধ্যে একটি লিয়াজো কমিটি গড়ে উঠে। তৎকালীন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা ও ৭ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া ১৫০-১৫০ আসনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে এরশাদ সরকার একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি ৫টির বেশি আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না এমন বিধি নিষেধ আরোপ করে। সেই বিধি এখনও কার্যকর। এরপর শুরু হয় সংলাপ।
একটি স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। কিছুদিন আগে প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ ছিলেন ৭ দলীয় জোটের নেতা। হঠাৎ একরাতে তিনি এরশাদের মন্ত্রী পরিষদে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর বিএনপি’র সাথে সংলাপের দিন কাজী জাফর আহমেদ সরকারের পক্ষে সংলাপে উপস্থিত হন।
কাজী জাফরের উপস্থিতিতে বিএনপি সেই সংলাপ বর্জন করে। এই ভাবে আন্দোলনের রাজপথ থেকে অনেকেই এরশাদের মন্ত্রী পরিষদে যোগ দেন। এর মধ্যে বামপন্থী শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম খান, আনোয়ার জাহিদ, মওদুদ আহমেদ, মাইদুল ইসলাম, ছাত্রনেতা ও ডাকসু জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু উল্লেখযোগ্য।
১৯৮৬ সালে ৭ দল ও ১৫ দলীয় জোটের লিয়াজো কমিটির ডাকে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। সেই আন্দোলনের তীব্রতা এতই ভয়াবহ ছিল যে সকলে ধরে নিয়েছিল যে স্বৈরাচারের পতন শুধু সময়ের ব্যপার মাত্র। কিন্তু হঠাৎ এরশাদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ১৫ দলীয় জোট সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে ঘোষণা দেয়। আন্দোলন সেখানে থেমে যায়।
১৫ দলীয় জোটের বামপন্থী শরীকরা ৫ দল নামে আলাদা জোট গঠন করে। ফলে ১৫ দল ভেঙ্গে ৮ দল ও ৫ দল নামে ২টি জোট গঠিত হয়। ৮ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তৎকালীন ফ্রিডম পার্টি, জাসদ রব ইত্যাদি দল ওই সালের নির্বাচনে অংশ নেয়।
৮ দলীয় জোটের নেত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী হন। ৭ দলীয় জোট ও ৫ দলীয় জোট বাইরে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভেঙ্গে যায় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে নির্বাচন এ অংশগ্রহণকারী দল বিতাড়িত হয়। ঠিক এই সময়টায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে ছাত্র অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে।
১৯৮৭ সালে আবারও স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যগ এর দাবীতে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলীয় লিয়াজো কমিটি গড়ে উঠে। ছাত্র অঙ্গনে প্রথমবারের মত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ সকল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ২২টি ছাত্র সংগঠনের জোট গড়ে উঠে।
আন্দোলনের তীব্রতায় ৮ দলীয় জোট সংসদ থেকে পদত্যগ করে রাজপথের আন্দোলনে যোগ দেয়। সেই সময় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালিত হয়। “গণতন্ত্র মুক্তি পাক” বুকে পিঠে লেখা এই স্লোগান নিয়ে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নামে সেই ঐতিহাসিক যুবক শহীদ হন। সারাদেশে কারফিউ জারির পাশাপাশি রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় ।
১৯৮৮ সালে পুনরায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কাগুজে সর্বস্ব দল নিয়ে আ স ম রবকে বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়ে একটি লোক দেখানো কাগজে কলমে সংসদ বানানো হয়। এই সংসদ থাকা অবস্থায় ১৯৮৯ সালে স্বাধীনতা উত্তর ১৭ বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর প্যানেল সুলতান-মুস্তাক যথাক্রমে ডাকসু ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়। এর পরের বছর পুনরায় ডাকসু নির্বাচন হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ভেঙে গেলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এর প্যানেল আমান-খোকন যথাক্রমে ডাকসু ভিপি-জিএস নির্বাচিত হন। এই সময় রাজনীতি মূলত ছাত্র সংগঠন কেন্দ্রিক আবর্তিত হতে থাকে ।
এরই মধ্যে ১০ই অক্টোবর ১৯৯০ সালে বিরোধী দল সমূহের একটি রুটিন কর্মসূচীতে পুলিশ গুলি করলে জেহাদ নামে তেজগাঁও পলিটেকনিকের একজন ছাত্র নিহত হন। সেই জেহাদের লাশ পুলিশের সাথে মারামারি করে বিকেলে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে সকল ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা জেহাদের লাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত হয়। কোন ধরনের পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গড়ে উঠে ঐতিহাসিক “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য”।
তৎকালীন ডাকসু ভিপি আমান উল্লাহ এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত শপথ বাক্য পাঠ করা হয়- “স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না”। শুরু হয় এবার ছাত্রদের নেতৃত্বে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন।
যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মত ছাত্রদের সাথে নির্বাচন সংক্রান্ত কোন আলোচনার সুযোগ নেই, কাজেই শুধুমাত্র স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যগের দাবীতে “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য” এর নেতৃত্বে সারা দেশের ছাত্র সমাজ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে ।
“সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য” এর আন্দোলনের কর্মসূচীর মধ্যে সবচেয়ে তীব্র কর্মসূচী ছিল ১৭ই নভেম্বর মন্ত্রী পাড়া ঘেরাও। সেদিন ছিল মূলত স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর সবচেয়ে বড় আঘাত। সেই আঘাতের পর দেশের সাধারণ জনতাও স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে যোগ দেয়। রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলিতে অনেকেই নিহত হন। দেশ কার্যত অচল হয়ে পরে।
ফলে ৪ঠা ডিসেম্বরের আজকের এই দিনে ৯ বৎসরের স্বৈরশাসক তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। বিবিসি থেকে সারা দেশবাসী এরশাদের এই পদত্যাগের ঘোষণা শুনে আনন্দে রাস্তায় বের আসে। সারারাত সারাদেশের মানুষ সুদীর্ঘ ৯ বৎসরের আন্দোলনের ফসল হিসেবে আনন্দ উৎসব করে ।
১৯৮৩ সালে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে, ৯ বৎসর পর ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সেই আন্দোলনের শেষ হয়েছিল আবারও ছাত্রদের রক্তের বিনিময়েই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)