সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি সংবাদের লিঙ্ক শেয়ারের কারণে একজন সাংসদের দায়ের করা এক মামলার আসামি হওয়ার পর হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে পাওয়া গেল ৫৩ দিন পর। যদিও বিজিবি-পুলিশ বলছে ভারত থেকে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবু এখানে তাকে ফেরত পাওয়াটা অন্তত সৌভাগ্য বলতে হচ্ছে, কারণ পৌনে দুই মাস নিখোঁজ হয়ে থাকা কাজলের চির-নিখোঁজের শঙ্কাপর্বের সমাপ্তি হয়েছে। এই গ্রেপ্তার নাটকের মধ্য দিয়ে অন্তত তার বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তার সমাপ্ত হলো। হুট করে ❛নাই❜ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা ভর করেছিল এতদিন তার সমাপ্তিতে এখানে আপাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ এলো।
গত ক❜বছরের আলোচিত ঘটনা রাতের আঁধারে হঠাৎই ❛নাই❜ হয়ে যাওয়া। এই ❛নাই❜ হয়ে যাওয়াকে ❛গুম❜ বলা হয়ে আসছে, তবে যাদের বিরুদ্ধে এই গুমের অভিযোগ করা হয় তারা কেউ এটা স্বীকার করেনি। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিক-ব্যবসায়ী অনেকেই এই গুমের শিকার হয়েছেন। এদের কেউ কেউ ফিরে এসেছেন, কেউবা হারিয়ে গেছেন চিরতরে এই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের মৃত্যুর তথ্যের সত্যতাও ঘোষণা করেনি কেউ। যারা ফিরে এসেছেন তাদেরকে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যেভাবে উদ্ধারের দাবি করে তার সবটাই মানুষ বিশ্বাস করেছে এমনটা ভাবার কারণ নাই। বাহিনীগুলোর দাবিগুলো মানুষ যতটা বিশ্বাস করেছে, তারচেয়ে বেশি অবিশ্বাস করে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ফিরে পাওয়ার কাহিনী মিলিয়ে নিয়ে অভিযুক্তের নাম বিষয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্তগুলো ব্যক্তিক তবু সিদ্ধান্তের অনেকটাই বন্দুকযুদ্ধে নিহতের কাহিনীগুলোর সঙ্গে মিলে যায়।
গুমের ঘটনাগুলো দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় বিবৃতিও দিয়েছে। সচেতন মানুষের এই গুমবিরোধি প্রচারণাসহ নানা কারণে এই বছর দেশে গুমের ঘটনা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। বলা যায়, শূন্য ছিল সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের নিখোঁজের ঘটনার আগ পর্যন্ত। এই ঘটনাকে বিজিবি ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময়ে গ্রেপ্তার বলে দাবি করলেও এটা যে গুমের ঘটনা ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সাংবাদিক কাজলের পরিবার শুরু থেকেই বলছিল নিখোঁজ হওয়ার দিনও তিনি অফিস করছিলেন এবং সন্ধ্যায় পৌনে সাতটার দিকে অফিস থেকে বের হয়েছিলেন, যে দৃশ্য ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় সংরক্ষিত ছিল। তার পরিবার থানা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পায়নি। এইধরনের ঘটনাগুলো তার নিখোঁজ হওয়াকে মামলার পর ❛আত্মগোপনে❜ চলে যাওয়ার প্রমাণ করে না। এটাকে পূর্বের আরও অনেক গুমের ঘটনার ধারাবাহিকতারই ইঙ্গিত দেয়।
শফিকুল ইসলাম কাজলের নিখোঁজের পর যে মামলার খবর প্রকাশ হয়েছিল সেটা ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এই মামলা করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর। তিনি মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য। আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছের লোক বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা প্রচারণাও আছে। এই প্রচারণা এবং একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার পর তার হুট করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদনাম হয়েছিল। এখানে কিছু না করেই বদনামের ভাগীদার হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কারণ এই এমপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস বলে প্রচারিত। তার সাবেক এই পরিচিতি আরও বেশি করে আলোচনায় এসেছে সাংবাদিক কাজলের নিখোঁজের পর থেকেই।
জানা যাচ্ছে, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক (গ্রেপ্তারের পর বহিস্কার) শামিমা নুর পাপিয়ার গ্রেপ্তারের পর তার মুখে অনেকের নাম প্রকাশ হয়েছে- এমন এক সংবাদ প্রকাশ করেছিল দৈনিক মানবজমিন পত্রিকা। প্রতিবেদনটিতে সাইফুজ্জামান শিখরের নাম সরাসরি ছিল না, তবে ওখানে কয়েকজন সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আমলাসহ আরও অনেকের নাম পাপিয়ার মুখ থেকে এসেছে এমন তথ্য দেওয়া হয়।
লক্ষণীয় যে, প্রতিবেদনে মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখরের নাম উল্লেখ ছিল না। এমনও না যে মাগুরায় জাতীয় সংসদের একটিমাত্র আসন। এই জেলায় দুইটি আসন রয়েছে যার মধ্যে মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর, এবং মাগুরা-২ আসনের এমপি বীরেন শিকদার। কিন্তু এখানে আর কারও অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি, এই ইঙ্গিতে আর কেউ সংক্ষুব্ধ হয়নি; সংক্ষুব্ধ হননি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুষ্টিয়া, রংপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনার কোন সাংসদ; হয়েছেন কেবল একজনই, তিনি মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেন মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক এবং ফেসবুকে তালিকাগুলো প্রকাশ ও শেয়ারকারী ৩০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এই মামলায় যে ৩২ জনকে আসামি করা হয় তাতে সংবাদ শেয়ারকারী হিসেবে আসামি হয়ে যান ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ❛পক্ষকাল❜ নামের পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তিনি দৈনিক সমকাল ও বণিকবার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। পেশাদার ফটো সাংবাদিক হিসেবে তার পরিচিতি ও যুব মহিলা লীগের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে তিনি যুব মহিলা লীগের অনেক অনুষ্ঠানে যেতেন। তাদের ছবি তুলে দিতেন। যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামিমা নুর পাপিয়ার গ্রেপ্তারের পর তিনি পাপিয়াসহ যুব মহিলা লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেন। এই ছবি শেয়ার দেওয়াতেই কাল হলো তার। কারণ এর মাধ্যমে অনেকের ছবি প্রকাশ্যে চলে আসতে যাচ্ছিল।
শামিমা নুর পাপিয়া তার ব্যবসার সঙ্গী হিসেবে কাদের নাম উচ্চারণ করেছিলেন সেটা জানেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সাধারণত এই ধরনের তথ্য মাঝপথে গণমাধ্যমে দেননা বলে আমাদের জানার সুযোগ এখানে কম। তবে অনেক সময় দেখা যায় যেকোনো আলোচিত ঘটনার পর কিছু গণমাধ্যম ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংবাদের নামে গল্প লেখার চর্চা করে থাকে। পাপিয়ার গ্রেপ্তারের পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে অনেক মিডিয়া। মানবজমিন ‘পাপিয়ার মুখে আমলা, এমপি, ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও ওখানে অনেকেরই নাম ছিল না, ছিল ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতে তবু সংক্ষুব্ধ হয়েছেন মাগুরার এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তিনি কেন এখানে সংক্ষুব্ধ হলেন এ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ এই মাগুরা জেলায় তিনিই একমাত্র এমপি নন। জাতীয় সংসদে মাগুরা জেলার দুইটি আসন রয়েছে। অন্য আসনের এমপি এখানে সংক্ষুব্ধ হননি, মামলা করেননি। সংক্ষুব্ধ হননি আরও অনেক জেলার নাম উল্লেখ থাকলেও সেসব জায়গার কোনো আসনের কোন এমপি।
এখানে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এই মামলার আসামি করা হয়েছে পত্রিকার সম্পাদক, প্রতিবেদকসহ যারা ফেসবুকে এই নিউজ শেয়ার দিয়েছেন, লাইক দিয়েছেন এমন অনেককে। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এখানে কাগজেকলমে সংবাদের শেয়ারদাতা হিসেবে আসামি হলেও ফটো সাংবাদিক হিসেবে তার কাছে যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়ার সঙ্গে অন্যদের ছবি থাকার প্রসঙ্গও জড়িত থাকতে পারে। এই ছবিগুলো কাজল যখন প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন তখন অনেকের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল বলে প্রথমেই তাকে ওঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার কাছে থাকা ছবিগুলো তাকে নিরাপত্তাহীন বানিয়ে দিয়েছে। এই ছবিগুলো আবার অনেকের মুখোশ উন্মোচনের পথ নির্দেশ করছিল। এরপর জানা যাচ্ছে, নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর তার ফেসবুক আইডি থেকে অনেক কিছুই মুছে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে স্রেফ একটা সংবাদের লিঙ্ক শেয়ার দান তার একমাত্র অপরাধ ছিল না, অপরাধ ছিল তার কাছে থাকা ছবি এবং সেগুলো প্রকাশের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া।
শামিমা নুর পাপিয়ার গ্রেপ্তারের পর তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন নামের অনেক উড়ো তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হয়েছে। অনেক অনলাইন মিডিয়ায় সেইসব তালিকা ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। ওইসব অনলাইনের বেশিরভাগই মৌসুমি। সারাবছর এদের খোঁজ থাকে না কিন্তু যখনই দেশে বড় কোন ঘটনা ঘটে তখনই তারা নানাধরনের গুজবের ফিরিস্তি নিয়ে হাজির হয়। এর কয়েকটা আওয়ামী লীগের পক্ষের, আর কয়েকটা আওয়ামী লীগের বিরোধিপক্ষের। আজব ব্যাপার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন বলে দাবি করা অনেকেই এসব মিডিয়ার লিঙ্ক শেয়ার করেন এবং সেইসব প্রচারও করেন। এইসব মিডিয়ার বাইরে মানবজমিন যে সংবাদ প্রকাশ করেছে সেগুলো নামগোত্রহীন মিডিয়ার মত ছিল না। মানবজমিনের প্রতিবেদনে এমপি-মন্ত্রী-আমলা-ব্যবসায়ীদের নাম বলেছেন পাপিয়া এমন বলা হলেও ওখানে সুস্পষ্ট নাম ছিল না। এই সংবাদ শেয়ারকারী হিসেবে শফিকুল ইসলাম কাজলের আসামি হয়ে যাওয়া একমাত্র কারণ ভাবছি না, ভাবছি ফটো সাংবাদিক হিসেবে তার কাছ থেকে অনেকেরই ছবি থাকার সম্ভাবনাকেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইফুজ্জামান শিখর এমপির প্রথম মামলার পর উসমিন আরা বেলি নামের এক আওয়ামী লীগ নেত্রীর আরেকটা মামলা কিন্তু সে সম্ভাবনারই কথা বলে।
যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ডেরায় কারা যেতেন, কাদের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক, কারা ছিল তার অপরাধজগতের সহযোগী- এসব এখানে আলোচ্য নয়। এটা তদন্তাধীন বিষয়, তদন্ত শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক এটাই চাইব আমরা। এই সম্পর্ক সূত্রের ইঙ্গিতবাহী সংবাদে নাম উল্লেখ না থাকার পরেও কেউ যখন নিজেকে ওই জায়গায় আবিস্কার করে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে যায় তখন সন্দেহের তীর আপনা থেকেই তার দিকে ধাবিত হয়। এটা বলে দিতে হয়না, আপনা থেকেই যায়।
সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে ফেরত পাওয়া গেছে- এটা আপাত স্বস্তি। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কিংবা পুলিশ বলছে বলুক ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন কাজল, ওটা থাকুক তাদের বক্তব্য হয়েই। তার হারিয়ে যাওয়া, দীর্ঘদিন খবর না থাকা, এরআগে ফেসবুকে পাপিয়ার সঙ্গে অনেকের ছবি প্রকাশের ধারাবাহিকতা, নিখোঁজের পর ফেসবুক টাইমলাইনের অনেক কিছু মুছে যাওয়া, ক্ষমতাসীন দলের একজন সাংসদের মামলা, একজন আওয়ামী লীগ নেত্রীর মামলা, তার পরিবারকে পুলিশের অসহযোগিতাসহ যতকিছুই থাকুক তিনি একেবারে ❛নাই❜ হয়ে যাননি এটাই সান্ত্বনা। মামলা-হয়রানি-কষ্টের পৌনে দুইমাসের অধ্যায়কে পাশ কাটিয়ে আপাত তাই তাকে সৌভাগ্যবানই বলতেই হচ্ছে! বেঁচে থাকলে যুদ্ধ করা যায়। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল বেঁচে গেছেন; এবার তার যুদ্ধ শুরু হোক, নিজেকে প্রমাণের যুদ্ধ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)