রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা এনাম হোসেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দীর্ঘ চাকরী জীবন শেষ করে অবসরে যান ২০১২ সালে। এককালীন পেনশনের ২০ লাখ টাকা পেয়ে ওই সময় ১২ শতাংশ সুদ হারে আমানত রাখেন একটি ব্যাংকে। তিন মাস মেয়াদি আমানত হিসাবের সুদ থেকে কর ও বিভিন্ন চার্জ কাটার পর প্রথম দুই বছরে প্রতি মাসে গড়ে পেতেন ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এসময় তার বাসা ভাড়া দিতেন ১০ হাজার টাকা। অার বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল মিলে খরচ হতো ১২ থেকে ১৪শ টাকা।
কিন্তু ৫ বছরের ব্যবধানে আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসায় এনাম সাহেব তার একমাত্র সঞ্চয় থেকে এখন মাসে পাচ্ছেন ৮ হাজার ৩শ টাকা। অথচ এই সময়ে তার বাসা ভাড়া ৫ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। আর গ্যাস-বিদ্যুতের বিলও প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়াও প্রতিবছর জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৭ শতাংশ।
সার্বিক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, ৫ বছর আগে এনাম হোসেন তার আমানত থেকে যে সুদ পেতেন তা এখন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। পক্ষান্তরে তার পারিবারিক ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এরফলে ব্যাংকের মুনাফায় চলা সংসার এখন আর চলছে না। এমতাবস্থায় পরিবার নিয়ে তিনি পড়ছেন বিপাকে। তাই কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
এমন চিত্র শুধু এনাম হোসেনের ক্ষেত্রেই নয়, অনেক সরকারি চাকুরিজীবী এবং প্রবাসীদের পরিবারও আমানত রেখেছেন ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার আশায়।তাদের কেউ সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ আবার মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু সেই আমানত এখন পড়েছে হুমকির মুখে।
বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানতের সুদহার শুধু নিচেই নামেনি, মূল্যস্ফীতির হার থেকেও নিচে নেমে গেছে; যা খুবই বিপজ্জনক। এতে আমানতকারীরা একদিকে ব্যাংকে আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিমুখ হবেন। অন্যদিকে অনেকে আবার অর্থ পাচারে জড়িয়ে পড়বেন। যা ব্যাংকিং খাতের জন্য দু:সংবাদ বয়ে আনবে। এছাড়াও মানুষের হাতে পুঁজি আটকে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকে আমানত হিসাবের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। এসব হিসাবের বিপরীতে আমানতের পরিমাণ ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যার অর্ধেকের বেশি মেয়াদি আমানত। অার সঞ্চয়ী আমানত রয়েছে ২০ শতাংশের একটু বেশি। মোট আমানতের মধ্যে বেসরকারি খাতের অংশ ৮৩ শতাংশের ওপরে। বাকিটা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের।
এই ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২৫টির আমানতের সুদহার বর্তমানে ৫ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক, ৮টি বিদেশি ব্যাংক এবং ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রয়েছে। বাকী ব্যাংগুলোর অধিকাংশের সুদ হারও ৫ শতাংশের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের (২০১৬-১৭) মে মাস শেষে আমানতের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকে আমানতের সুদহার গড়ে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকের সুদহার অবশ্য ৫ শতাংশের উপরে রয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার ৫ দশমিক ২১ শতাংশ।
আমানতের উপর ৫ শতাংশের কম সুদ দেওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে-অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও সোনালী ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, হাবিব ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, উরি ব্যাংক, এইচএসবিসি এবং ব্যাংক আলফালাহ লিমিটেড। আর বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, পূবালী, উত্তরা, ইস্টার্ণ, প্রাইম, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ-বাংলা, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট, ব্র্যাক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।
গত পাঁচ বছরে আমানতের সুদহার কমেছে ৮ শতাংশের ওপরে। ২০১২ সালে সুদ ছিল সাড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশের নিচে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নেমে আসায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তা রোধ করতে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু সেই নির্দেশ মানছে না কোন ব্যাংকই।
আমানতে সুদ কমে যাওয়ায় বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। যা সরকারের ঋণ গ্রহণের অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। গত অর্থবছরের ১১ মাসেই প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়েও ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ওই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় উদ্বেগজনক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। ইতিমধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। কারণ সরকারকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হচ্ছে।
আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় অর্থ পাচারের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমানতের সুদহার কমে যাওয়া খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। কারণ সুদ হার কমে যাওয়া মানে প্রকৃত অর্থে গ্রাহকের মূলধন কমে যাওয়া। এর ফলে মানুষ আমানত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। বড় বড় আমানতকারীরা অর্থ পাচারের দিকে ঝুঁকবে। অন্যদিকে কেউ কেউ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াবে। আর এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ সরকারকেই সঞ্চয়পত্রের সুদ দিতে হবে।
এর ফলে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্থ হবে মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমানত কমে গেলে তারল্য সংকট দেখা দিবে ব্যাংকগুলোতে। বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিতে হোঁচট খাবে তারা। এতে দেশে বিনিয়োগও কমে যেতে পারে।