সমকালীন বিশ্বে সরকার পরিচালিনার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। রাজনৈতিক সরকারের ও সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার অভূতপূর্ব। কয়েক বছর আগেও আগের সংবাদ কর্মীদের কাছে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য, প্রেস রিলিজ, প্রেস নোট, ডোর স্টেপ ইনটিরভিউ ছিল গুরুত্বপূর্ণ, এখন তাদের সোশ্যাল একাউন্টের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হয়।
কিন্তু একজন সরকার প্রধান, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিভাবে তাদের একাউন্টগুলো পরিচালনা করেন, তারা কি প্রটোকল এর ভিতর দিয়ে যান এবং তাদের লক্ষ্যে পোঁছানোর কৌশলগুলো কী হতে পারে? কারা- কিভাবে এই কৌশল নির্ধারণ করেন? আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আমলা ও প্রশাসন যন্ত্র কি এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন? তারা কী কোনো প্রটোকল অনুসরণ করেন? এক্ষেত্রে প্রটোকলের প্ৰয়োজনীয়তা কতখানি? এসব প্রশ্ন হরহামেশাই সামনে চলে আসছে, সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে আলোচনার আগে বলে নেওয়া ভালো আমাদের দেশে প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ দ্বারা ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। সুতারং পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সামগ্রিক আইন এর কাঠামোগত বিবরণ পাবেন, কিন্তু সরকারের একজন মন্ত্রী বা সচিব, বা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা কিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করবেন তার গাইড লাইন নয়। সরকার সিভিল সার্ভিসের জন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়া গাইড-লাইন প্রকাশ করেছে কী না আমার জানা নাই। অন্ততঃ প্রশাসনএ নিয়োজিত ব্যক্তিদের সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দেখে তা মনে হয় না।
এ বছরের ২২ জানুয়ারি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এর ফেসবুক স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়, সেখানে তিনি লেখেন, ‘সহকর্মীদের সাথে প্রবাস হতে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম তাদের বেশিরভাগই অপরিচিত কল ধরেন না, মেসেজ পড়ে দেখেন না বা উত্তর দেন না। আমরা কি এ সংস্কৃতি হতে বের হতে পারি না?’ এর পর তিনি পর ‘ফোন না ধরার সংস্কৃতি’ শিরোনামে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। এখানে মূলত তিনি আগের স্ট্যাটাসের বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন। গত ১১ মার্চ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ফেসবুকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে একটি স্ট্যাটাস এ প্রশ্ন করেন, ‘সততা, নিষ্ঠা আর শত চ্যালেঞ্জকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করা কি ক্ষমতার অপব্যবহার?’
অতি সম্প্রতি গত ২৫ মার্চ, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ায় দুইজন শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন, যারা শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পাশাপাশি মাস্ক না পরায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরে দাঁড়করিয়ে শাস্তিদান এবং সে দৃশ্য নিজের মোবাইলে করায় যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসি, ভূমি) সাইয়েমা হাসানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে সেই এসিল্যান্ডের পক্ষে একই দিন রেল মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন ‘আমি অনুতপ্ত, লজ্জিত এবং ক্ষমা প্রার্থী। এ দায় আমার’। তার এ ধরনের স্ট্যাটাস আরেক দফা আলোচনা, সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এসব ঘটনা ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে এদের কেউই কিন্তু সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধান লঙ্ঘন করেন নাই। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তারা যদি আইনের বিধান না ভাঙেন, তা হলে সমস্যা কোথায়? আপাদত দৃষ্টিতে কোন সমস্যা নাই, কিন্তু গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর মাধ্যমে জনপ্রশাসনের শিষ্ঠাচার বিনষ্ট হবার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তাদের এ ধরণের মন্তব্য রাষ্ট্রের এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণকে আস্থাহীন করে তুলতে পারে।
এই সব ফেসবুক স্ট্যাটাসের পেছনের কার্যকারণ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কি ভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই বিষয়ে নীতিমালা ও স্বচ্ছ ধারণা না থাকার বিষয়টা বেরিয়ে আসছে। একটু খুলে বলি,সিভিল সার্ভিস চলবে তার ‘রুলস অব বিজনেস’ এর মাধ্যমে, সেখানে আবেগের বিন্দুমাত্র স্থান নাই, অভিমান দেখানোর কোনো সুযোগ নাই. ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজ থেকে জনগণের মতামত নেয়া বা জনগণকে বিচারের ভার দেয়া প্রশাসনের বা সিভিল সার্ভিসের এর কাজ নয়। সিভিল সার্ভিসে সেলিব্রেটি ইমেজ বা তারকা ব্যক্তিত্বের স্থান নাই, আজ আপনি একটি দায়িত্বের কারণেই মিডিয়ার খবরে পরিণত হচ্ছেন, আগামী কাল আপনার স্থলে আরেকজন আসবেন, তিনিও একই কাজ করবেন।
আমি মনে করি শিক্ষা প্রশাসন বা জন প্রশাসনের এই গুণী কর্মকর্তারা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই কাজ করেন নাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করাটাকে আমরা সহজ ভাবে নিয়ে থাকি, হতে পারে এটা আমাদের সংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ্য। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কত ভয়াবহ হতে পারে তার একটা উদহারণ হিসেবে রামু, নাসরীন নগর বা ভোলার ঘটনাগুলো আমাদের সামনে রয়েছে। এটা আশা করার দরকার নাই যে জিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবকিছু বলে দিবে, আমাদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার শিখতে হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এর ভালো খারাপ উভয় প্রভাব সম্পর্কে জানতে হবে।
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমাদের দূরে সরে যাবার সুযোগ নাই বললেই চলে। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান সবার আলাদা আলাদা সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট আছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতার তুলনায় প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের স্বাধীনতা খানিকটা সীমিত। কারণ আপনি যদি কোন প্রতিষ্ঠানকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাহলে আপনার বক্তব্য প্রতিষ্ঠানের মনোভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা টুইট আমাদেরকে আমেরিকার সরকারি নীতি বা অবস্থান বুঝতে সহায়তা করে।
দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কমিউনিকেশন নিয়ে এ কাজের সুবাদে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ও কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আমাকে কাজ করতে হয়েছে, বলতে দ্বিধা নাই, আমাদের সিভিল সার্ভিস এর কর্মকর্তাগণ এই বিষয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছেন, এবং এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অথচ, বাংলাদেশেই কাজ করছে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা শব্দ, একটা বাক্য অথবা একটা ছবি শেয়ার করতে গেলে বিশাল প্রটোকল মানতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অফিস ও এর কর্মকর্তাদের সোশ্যাল ও ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারের নিয়ম কানুন দেখলেই আপনার চক্ষু চড়ক গাছ হবার জোগাড় হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোটোকল আসলে কি জিনিস? ধরুন, সরকারের একটা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা তথ্য ও ছবি শেয়ার করবেন, সেখানে সংশ্লিষ্ঠদের জানতে হবে, কে সেটা তৈরী করবেন, কয় ধাপে সেটা রিভিউ হবে, কে সেই পোস্ট আপলোড করবেন, কি ধরণের ফিডব্যাক দিবেন, কে সেই ফিডব্যাক দিবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মার্কিন স্টেট্ ডিপার্টমেন্ট এর ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যানুয়ালে তাদের কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের বিস্তারিত নিয়মকানুন দেয়া আছে, শুধু তাই নয় তারা তাদের কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকেন।
সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়া প্রোটোকল এর মধ্যে থাকে সেই প্রতিষ্ঠানের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ, কর্মচারীদের দায়িত্ব; কার্যক্রমের উপর বিধিনিষেধ; কর্মচারী এবং পরিবারের সদস্যদের ক্রিয়াকলাপ; সামাজিক মাধ্যমে কথা বলার, লেখার এবং শিক্ষার ট্রেনিং বা সরকারী ছাড়পত্র; গোপনীয়তা আইনের প্রয়োজনীয়তা; কপিরাইটযুক্ত উপাদানের ব্যবহার; রেকর্ডস সংরক্ষণ ও পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দরকারি তথ্য সমূহ সন্নেবেশিত থাকে।
মনে রাখা ভালো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিরুৎসাহিত করা প্রোটোকল এর উদ্দেশ্য নয়, বরং সরকারের সিভিল সার্ভিস যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর দায়িত্বশীল ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিতে পারে সেজন্য এই সব ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন ধরুন, আপনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, এবং সরকারি ইমেইল আইডি ব্যবহার করেন, সেই ইমেইল আইডি বা সরকারি ফোন নম্বর দিয়ে আপনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া এক্যাউন্ট খুলতে পারবেন কি না, সেখানে আপনি যে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত তার লোগো ব্যবহার করতে পারবেন কি না। আপনার ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, রাজনৈতিক মতামত, অন্য রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মতামত, বিচারাধীন বিষয়ের সম্পর্কে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে কি নিয়মাবলী অনুসরণ করতে হবে তা জানা উচিত।
গ্লোবাল কমিউনিকেশন এক্সপার্টদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনেকরি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোটোকল অনুসরণ করা নিঃসন্দেহে বাধ্যতামূলক করা উচিত। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ তাদের সরকারী ক্ষমতার পরিধি অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবদান রাখতে পারেন, জনগণ তাতে উপকৃত হবে। সেক্ষেত্রে জনসাধারণের সাথে মতবিনিময় শুরু করার আগে উক্ত বিভাগের কর্মীদের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়াটা প্রাতিষ্ঠানিক কাজের অংশ হতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠান কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, সেই প্রযুক্তির সুরক্ষা কাঠামো কি হবে, কে বা কারা অ্যাক্সেস পাবেন তা নির্ধারণ করা উচিত। যদি “সরকারী উদ্বেগের বিষয়” হয় তবে কর্মচারীদের জনসাধারণের তথ্য প্রচারের ছাড়পত্রের প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় একজনের নামে একটির বেশি অ্যাকাউন্ট করা যায় না, তাই আপনার যে কোন মতামত যে কোন মুহূর্তেই কোড হয়ে যেতে পারে। সেজন্য সিভিল সার্ভিসের সবস্তরের কর্মকর্তাকেই ব্যক্তিগত মত প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত সুরক্ষা ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সরকারের উচিত হবে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে রোল মডেল হিসেবে নিয়ে তাদের দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম এবং জনপ্রশাসন বিশেজ্ঞদের সাথে নিয়ে অনতিবিলম্বে সিভিল সার্ভিসের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্রোটোকল চালু করা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)