সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হলে এবং তার বয়স পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে তিনি সংসদ সদস্য হতে পারেন। তবে শর্ত হলো, কোনো উপযুক্ত আদালত যদি তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন; যদি তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করেন; তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়; যদি তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যেকোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দেখা যাচ্ছে, এতসব শর্তের মধ্যে কোথাও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি উল্লেখ নেই। অর্থাৎ কোনোদিন স্কুলের বারান্দায় হাঁটেননি, এমন লোকও যেকোনো পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি এমনকি আইনপ্রণেতাও (সংসদ সদস্য) হতে পারবেন। যদিও আইন প্রণয়ন শিক্ষিত মানুষেরই কাজ। অশিক্ষিত লোকেরা সংসদে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ফলে তারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কতুটুক ভূমিকা রাখতে পারেন বা এই ইস্যুতে তাদের কেবল ‘হ্যাঁ না’ বলা ছাড়া কিছু করার থাকে কিনা, সেটি অনেক পুরনো তর্ক।
প্রশ্নটা আরও সরল যে, যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতেই কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা না লাগে, তাহলে সিটি করপোরেশনের মেয়র হতে কেন লাগবে? সংবিধান অনুযায়ী মেয়র হতে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি না পেরোলেও চলে। যে কারণে আমরা দেখছি, আগামী ৩০ জুলাই হতে যাওয়া রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বড় দুই দলের ৬ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে দুজনই নির্বাচনি হলফনামায় নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা লিখেছেন ‘স্বশিক্ষিত’।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও হলফনামায় নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেন। যদিও সবাই জানে যে, তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। তার দলের একজন সিনিয়র এবং বিতর্কিত নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর) যথেষ্ট শিক্ষিত হওয়ার পরও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা তার মনোনয়নপত্র বৈধতার আপিল শুনানিতে মি. চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কেন হলফনামায় ‘স্বশিক্ষিত’ উল্লেখ করেছেন? ওই শুনানিতে সাংবাদিক হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু সাকা চৌধুরী ঠিক কী জবাব দিয়েছিলেন তা মনে করতে পারছি না। তবে বিষয়টি নিয়ে তখন বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে আমরা ধারণা করেছি যে, সাকা চৌধুরী দুই কারণে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা আড়াল করে ‘স্বশিক্ষিত’ উল্লেখ করতে পারেন; ১. স্যাটায়ার করা; ২. যেহেতু দলের প্রধান ‘স্বশিক্ষিত’ লেখেন, তাই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
আসন্ন তিন সিটির নির্বাচনে প্রার্থীরা যে হলফনামা দিয়েছেন, সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বরিশালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহ নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছেন। সাদিক আব্দুল্লাহ অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং দেশের একটি বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তার বাবা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ ছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। ওই চুক্তিতে সরকারের পক্ষে তিনিই সাক্ষর করেন। তার বাবা অর্থাৎ সাদিক আব্দুল্লার দাদা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপা। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও নিহত হন। এরকম একটি পরিবারের সন্তান হয়েও সাদিক আব্দুল্লাহ পড়ালেখা করেননি, এটি খুব বিস্ময়কর। প্রশ্ন হলো তিনি কি আদৌ পড়ালেখা করেননি নাকি তিনি সামান্য পড়ালেখা করেছেন (যেমন খালেদা জিয়া) বলে সেটি আড়াল করার জন্য ‘স্বশিক্ষিত’ লিখেছেন? এ বিষয়ে সাদিক আব্দুল্লাহর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের একজন নেতা এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো বিষয় নয়; বরং জনগণ তাকে কতটা পছন্দ করে, জনগণের প্রতি তার কমিটমেন্ট কতটা, নির্বাচনে সেটিই বিবেচ্য।
বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার শিক্ষিত। হলফনামায় তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন এলএলবি।
সিলেট সিটিতে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীও হলফনামায় নিজেকে স্বশিক্ষিত উল্লেখ করেছেন। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামরান লিখেছেন, তিনি এইচএসি পাস। বরিশালের সাদিক আব্দুল্লাহর মতো আরিফুল হক চৌধুরীর বেলায়ও সেই একই প্রশ্ন খাটে যে, তিনি কি কোনো পড়ালেখা করেননি নাকি তিনিও তার দলের নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বা তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলফনামায় নিজেকে স্বশিক্ষিত উল্লেখ করেছেন? নাকি তারও পড়াশোনা সামান্য বলে তিনি সেটি মানুষকে জানাতে চান না? তিনি দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যই শুধু নন, তিনি সিটি কর্পোরেশনের নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন। এখানে আওয়ামী লীগের বদরুদ্দিন কামরানের সৎ সাহস প্রশংসনীয় যে, তিনি এইচএসসি পাসের কথা গোপন করেননি।
তবে ব্যতিক্রম রাজশাহী। এবার সেখানে মেয়র পদে বড় দুই দলের যে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারা দুজনই উচ্চশিক্ষিত। আওয়ামী লীগের এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন তার হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ অনার্স, এলএলবি। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের শিক্ষাগত যোগ্যতাও এমএসএস, এলএলবি। যদিও তার মূল পেশা ব্যবসা।
প্রশ্ন হলো, শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে এই যে এতসব কথাবার্তা, ভোটের মাঠে বা ব্যালট বাক্সে তার কি কোনো প্রতিফলন ঘটে? যদি ঘটতো, তাহলে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত লোকেরা জনপ্রতিনিধি হতে পারতেন না। যদি ঘটতো তাহলে শুধু উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ রুচির লোকেরাই সংসদে, সিটি করপোরেশনে, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হতেন। তা তো হয় না। বরং ঘটনাগুলো উল্টো ঘটে। অর্থাৎ শিক্ষিত-সজ্জন লোকেরা ভোট কম পান। শিক্ষিত এবং উন্নত রুচির লোকেরা ভোটের নোংরা রাজনীতিতে পরাজিত হন। যেখানে অশিক্ষিত-আধাশিক্ষিত লোকেরা ভোটের রাজনীতিতে অনেক কিছুই নির্দ্বিধায় করতে পারেন।
যেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান সব নাগরিককে অভিন্ন মর্যাদা দিয়েছে, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত দিয়ে কোনো ধরনের বৈষম্য আরোপ করেনি, তারপরও শিক্ষাদীক্ষা না থাকলে জনপ্রতিনিধিত্ব করা, বিশেষ করে আইন প্রণয়নের মতো অতি জটিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজকর্ম করা, স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশি-বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা, অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে সই করার মতো পরিস্থিতিতে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে হলফনামায় একজন প্রার্থী তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী লিখলেন–আপাতদৃষ্টিতে ভোটাররা সেটি আমলে না নিলেও বা তারা কেবল মার্কা দেখে ভোট দিলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সংবিধান সংশোধন করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধান করা হবে–এমন প্রত্যাশা করাই যায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)