টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সবাই যখন জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা, তখনই জানা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক তান্ডবের খবর। ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে শত শত মানুষ দল বেধে প্রকাশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ভেঙ্গেছে। ভাংচুর-লুটপাট হয়েছে হিন্দুদের শতাধিক ঘর। অনেককে নির্মমভাবে প্রহারও করা হয়েছে। খবরটি তেমন আলোড়ন ফেলতে পারেনি। কয়েকটি মূর্তি ভাঙ্গা, কিছু মানুষের (হিন্দু!) বিশ্বাসে আঘাত করা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, মারধর করা এ আর তেমন কি! এগুলো তো মানুষ নয়, হিন্দু। বাংলাদেশে হিন্দুদের আবার অধিকার কী!
না, আমরা বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। আমরা এই খবরটাকে পাশে ফেলে রেখে যে যার মত ক্রিকেট আনন্দে মত্ত হয়েছি। মনুষ্যত্বের জয়গান গাওয়ার খেলায় আমরা শোচনীয় ব্যর্থতার পর তথাকথিত উন্নয়ন আর ক্রিকেট খেলা নিয়ে মত্ত হয়েছি, যেন আমাদের জীবনে এই দুই-ই সত্য, আসল, আর সব অপ্রয়োজনীয়, বাতিল।
কোথাকার চন্দনাইশে এক সংখ্যালঘু স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ, সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মারধর, বরখাস্ত, এলাকা ত্যাগের নির্দেশ-এসব খবর আমাদের আর বিচলিত করে না। এই বয়সে ওই স্কুলশিক্ষক চাকরি না করে সংসার কী করে চালাবেন, তা নিয়ে কারও আগ্রহ নেই। পরিবার-পরিজনসহ এই শিক্ষককে কোথায় একটু আশ্রয় দেয়া যাবে-তা নিয়ে কারও কোনো ভাবনা নেই। দেশজুড়ে এমন কতসংখ্যক সংখ্যালঘু স্কুলশিক্ষককে যে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে, কারও সেই খবর জানার তাগিদ নেই। অথচ আমরা গলা ফাটিয়ে বলি, আমরা হলাম ধর্মনিরপেক্ষ। এদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ভালোমানুষের দেশ। সাম্প্রদায়িকতা আছে ভারতে, পাকিস্তানে। এখানে যারা ওই জিনিস খোঁজে তারাই আসলে সাম্প্রদায়িক!
মূর্তি ভাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নিয়মতিই ঘটছে, প্রতিকার ও প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদহীন ভাবেই ঘটছে। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তার, তদন্ত, কিংবা শাস্তি হওয়ার দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই। এই বিচারহীনতা আরও উস্কে দিচ্ছে এসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীকে। মুখে মুখে শুধু ধর্মীয় সহাবস্থান আর সম্প্রীতির ভুয়া বুলি তুললেও কোনো রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা নেই এই সমস্যা সমাধানের। হয়নি কোনো সুস্পষ্ট আইন। হয়নি কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত।
গত কয়েক বছর ধরে ধর্মানুভূতি শব্দটি বাংলাদেশে মুখরোচক শব্দ হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতি নিয়ে কারো কোনো অনুভূতি নেই। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জানে যে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক শুধুই একটি বিশেষে দলের জন্য, সুতরাং এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যথার কারণ নেই। অন্যদিকে প্রগতিশীল স্যেকুলার ধ্বজাধারীরা ভাবছে আমাদের ভোট না দিয়ে এরা যাবে কোথায়! কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের চটানো যাবে না! সুবিধামত সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে! এভাবে গোলেমালে দিন পার করে দিতে হবে!
যারা হিন্দুদের আক্রমণ করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর, তাদের তো চিনতে কষ্ট হওয়ার কারণ নেই। তারা তো এ দেশেরই মানুষ। তাদের চিহ্নিত করে অপরাধের শাস্তি দেয়া কি একেবারেই অসম্ভব? বাংলাদেশে এখন এটাই সবচেয়ে অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ধর্মের জিগির তুলে এক শ্রেণির মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকার পরিণত হয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষক অথবা অনুগামী।
এই সাম্প্রদায়িক শক্তি যে খুব বড়-তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারা কোনো রকম বাধা না পেয়ে দুঃসাহসী হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, গুটিকতক নরপশু নানা রকম ছুতোয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হিংস্র শ্বাপদের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে, দেশের অসাম্প্রদায়িক অস্তিত্বকে নষ্ট করে দেবে, আর আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে- এটাই কি আমাদের নিয়তি? মানুষ হয়ে আমরা মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারব না-এমন সমাজই কি আমাদের জন্য অনিবার্য?
আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ব্যাপারে ইন্ধন যোগানো এবং হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে যদি বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতকে দায়ী করা হয়, তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা, ক্ষমতায় থেকেও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করা এবং উপরন্তু এই বিষয়টাকে ব্যবহার করে নোংরা রাজনীতির জন্য আওয়ামী লীগও কি দায় এড়াতে পারে? সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে জীবন দিয়ে, মার খেয়ে, বিশ্বাসের প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাস্তচ্যূত হয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের দায় শোধ করতে হবে?
সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে আমরা এদেশের মানুষ সামষ্টিক ভাবে গর্জে উঠব কবে? আর কত মূর্তি ধ্বংস হলে? আর কত আক্রমণ-নির্যাতন হলে? নাকি এদেশে শেষ সংখ্যালঘুটি বাস্তুচ্যূত না হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের হামলা-নির্যাতন চলতেই থাকবে?
সরকার যেহেতু মূর্তিভাঙ্গা ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি হামলা-নির্যাতন বন্ধ করতে পারছে না, আগ্রহও খুব একটা দেখাচ্ছে না, কাজেই সরকারের কাছে অনুরোধ বাংলাদেশের সকলের জন্য একটি ‘সার্বজনীন মুর্তিভাঙ্গা উৎসব’-এর আয়োজন করা হোক।
বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে নিয়ম করে মন্দিরে-মন্দিরে মূর্তি দল বেধে মূর্তি ভাঙ্গা হোক। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এই উৎসবে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারলে, মূর্তি ও হিন্দুদের প্রতি ক্ষোভ কিছুটা কমবে বলেই আশা করা যায়।
মূর্তিভাঙ্গার বিষয়ে প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভুমিকার জন্য সরকার বাহাদুরকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে করজোড়ে বলতে চাই, আপনাদের এই ভুমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এখন সরকার যদি ‘সার্বজনীন মুর্তিভাঙ্গা উৎসব’কে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে প্রচার ও প্রসারের সুযোগ করে দেয়, তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়!
সোনার বাংলা গড়তে এর চেয়ে ভালো উদ্যোগ আর কী হতে পারে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)