বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল ঘোষণার পর ইমরুল কায়েসকে না রাখা নিয়ে সমালোচনার একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। কিন্তু নিজেদের ইতিহাসের সেরা দলটাই বিশ্বকাপে যাচ্ছে, এমন একটা যুক্তির কাছে ইমরুল-বিতর্ক চাপা পড়ে যায় দ্রুতই। টাইগারদের বিশ্বকাপ জার্সি উন্মুক্ত করার পর আর চাপা পড়ার বিষয়টি থাকছে না, হচ্ছে বিস্তর সমালোচনা। লাল-সবুজের আবেগ কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্ক কেবল দল নির্বাচন প্রসঙ্গই নয়, ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব আলোচনা-সমালোচনার মাত্রাই! তার সঙ্গে সাকিব আল হাসানের জার্সি উন্মোচন ও অফিসিয়াল ফটোসেশনের আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যাওয়া বিতর্কে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
বিশ্বকাপ ও আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য দেশ ছাড়ার আগে বাংলাদেশ দল শেষ অনুশীলন সেশন করেছে সোমবার। তারপর পুরো দল আর বিসিবি কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশ্ব আসরের জন্য টাইগারদের নতুন ডিজাইনের জার্সি উন্মুক্ত করেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। নতুন সেই জার্সির ছবি টর্নেডোর বেগে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সঙ্গে চড়তে থাকে সমালোচনার পারদ।
মাশরাফী-তামিমদের জার্সি নিয়ে সমালোচনা-বিতর্ক মাথাচাড়া দেয় মূলত এর রং ঘিরে। আসছে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে দুই ধরনের জার্সি পরে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। যার অন্যতমটি সবুজ রংয়ের। এটি মুশফিক-মিরাজদের হোম জার্সি বলে বিবেচিত হবে। অন্যটি লাল রংয়ের, যেটি অ্যাওয়ে জার্সি। এই লাল-সবুজ নং নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু যখন দেখা গেল সবুজ জার্সিটির মাঝে কোনো লালের রেশ নেই, আবার লাল জার্সিতে একদমই নেই কোনো সবুজের অস্তিত্ব, তখনই আবেগের ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন সমর্থকরা।
বিতর্ক তোলা ক্রিকেটপ্রেমীদের আপত্তির জায়গা মূলত সবুজের মাঝে কোনো লালের অস্তিত্ব না থাকা, আর সবুজটাও ঠিক বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সবুজের মতো না হওয়া। সীমাহীন গর্বের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা যেমন মাথা উঁচু করে দেয় বাংলাদেশিদের, দেশের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার প্রতিজ্ঞা বাড়ায়, সেই লাল-সবুজের মিশ্রণে টাইগারদের জার্সির প্রচলিত যে একটা চল ছিল, সেটি দেখতে না পেরেই প্রচণ্ড ধাক্কা খান সমর্থকরা। নতুন জার্সির সবুজ রংটা আবার পতাকার সবুজের সঙ্গে মানানসই নয় যখন, সবমিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত বাংলাদেশে সবুজ জমিনে লাল রক্তিম সূর্যটার অর্থবহ আবেগের প্রতি অসম্মান-অবমাননা ও টাইগার দলের জার্সি-ঐতিহ্যের প্রতি খামখেয়ালির গুরুতর অভিযোগ তুলে বিতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়েন ক্রীড়ামোদীরা।
বাংলাদেশের নতুন জার্সির সবুজ রংটার সঙ্গে আবার পাকিস্তানের পতাকা ও তাদের ক্রিকেট দলের জার্সির রংয়ের মিলও খুঁজে পান কেউ কেউ। তাতে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কয়েকগুণ। কেউ আবার এটিকে আয়ারল্যান্ডের জার্সি বলেও কটাক্ষ করতে থাকেন। সবমিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোমবার দুপুরের পর থেকে আলোচনার কেন্দ্রে ব্যাপকভাবে চলে আসে সাকিব-মোস্তাফিজদের বিশ্বকাপ জার্সি।
ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশিরভাগই নতুন জার্সির বিপরীতে অবস্থান নেন। তীব্র হতাশা প্রকাশ করতে থাকেন লেখায়-কথায়। স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনার তীর ছুঁটে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তথা বিসিবির ভূমিকার দিকে। নতুন ডিজাইন নির্বাচন, বিসিবির তাতে অনুমোদন, লাল-সবুজের আবেগকে পাত্তা না দিয়ে বোর্ডের উল্টো পথে যাত্রা কিনা, অর্বাচীন ভূমিকা কিনা, সেসব নিয়ে একর পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে থাকেন টাইগারপ্রেমীরা।
অনেকে ফেসবুকে লিখতে থাকেন, প্রিয় দলের একটি জার্সি কিনে বিশ্বকাপ উপভোগ করতে চেয়েছিলাম, সেটি আর হচ্ছে না। অথচ এবারই প্রথম অফিসিয়াল জার্সির রেপ্লিকা মহা ধুমধামে সাধারণ মানুষের জন্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছে বিসিবি।
দেশের জন্য নানা সময়ে সীমাহীন গর্ব বয়ে আনা ক্রিকেটাররা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে এমন সবুজ পরে বিশ্বকাপে যেন না খেলেন, সেটি পুনর্বিবেচনার দাবিও ওঠে ভক্তদের লেখায়। সমর্থকরা ক্ষোভের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, জার্সিতে বড় অক্ষরে বাংলাদেশ লেখাটা ছাড়া আর কোথাও দেশের চিহ্নই নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধীরা এমন ধরনের সবুজের ধৃষ্টতা বহন করেছে, এমন ক্ষোভ ছুঁড়ে এই জার্সি ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি অবমাননা বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের জার্সিতে সবুজ জমিনে লাল কেনো বাদ, বিসিবি জবাব দাও, এমন স্লোগানও ওঠে! ফয়সাল নামের একজন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, একজন বাংলাদেশি হিসেবে এই জার্সি আমার পছন্দ হয় নাই। লাল-সবুজের এই পতাকা, এই জার্সি শুধু নিছক লাল আর সবুজ রংকে উপস্থাপন করে না। আমাদের কাছে সবুজের মাঝে লালের অর্থ আরও অনেক গভীর, আরও অনেক ব্যাপক। সবুজের মধ্যে একটু ফোঁটা লাল আমাদেরকে অনেক শক্তি দেয়। অনেক সাহস যোগায়। এই সবুজ জার্সি নির্বাচনের আগে কর্তৃপক্ষেরও এভাবে ভাবা উচিত ছিল। সবুজের বুকে লাল আমাদের প্রেরণা, এখনও কি একবার ভেবে দেখা যায় না? বিশ্বকাপ তো একমাস বাদে।
নিশি নামের একজন লিখেছেন, বাংলাদেশ লেখাটা না থাকলে বুঝতেই পারতাম না এটা আমাদের জার্সি। কিরণ নামের একজন লেখেন, এই জার্সি স্কোয়াডের ১৫ জন পরতে বাধ্য হবে। আমার মনে হয় ক্রিকেটারদেরও পছন্দ হয়নি জার্সিটা। তবু তাদের পরতে হবে। আমার মনে হয় তারা ছাড়া আর কেউ এই জার্সি পরবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে জার্সি কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন রেখে যান কেউ কেউ।
বিরুদ্ধ মতও যে নেই তা নয়। নতুন ডিজাইনের এই জার্সিতে ভালোলাগার কথাও লিখেছেন কিছুসংখ্যক সমর্থক। কেউ কেউ আবার যুক্তি তুলে ধরেছেন, জার্সি নয় মাঠের খেলাটাই আসল। টাইগারপ্রেমীদের যেমনই লাগুক, বিসিবি যে ভেবেচিন্তেই এই জার্সি নির্বাচন করেছে সেটি পরিষ্কার হওয়া গেছে সোমবারই। আনুষ্ঠানিক উন্মোচনের পর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান জানিয়ে দেন, জার্সিটা বেশ ভালো লেগেছে তার। বোর্ড সভাপতি বলেন, ‘আজই প্রথম দেখলাম। জানা মতে, জার্সিটা খেলোয়াড়দের মতামত নিয়েই করা হয় প্রতিবার। ওরা যখন খুশি, আমিও খুশি।’
খেলোয়াড়দের মনের অবস্থা সাধারণের জানার সুযোগ নেই। জার্সি নিয়ে কোনো মন্তব্য আসেনি বিশ্বকাপের টাইগার-স্কোয়াডের দিক থেকে। তুমুল বিতর্কের পর বিসিবির জার্সি ভাবনায় নতুন কোনো চমক থাকছে কিনা সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে এই জার্সি বিতর্কই আবার সময়ের ফেড়ে অনেকটা দৃষ্টির আড়ালে ঠেলে দিয়েছে সাকিব আল হাসানের বোর্ডকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর বিষয়টি!
জার্সি বিতর্ক আলোচনার কেন্দ্রে না থাকলে হয়ত এসময় সমালোচনার একেবারে কেন্দ্রে থাকতেন টাইগারদের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। কারণ দলের সহ-অধিনায়ক যে জার্সি উন্মোচন ও বিশ্বকাপ স্কোয়াডের আনুষ্ঠানিক ফটোসেশনেই থাকেননি। এমনকি সোমবার মিরপুরে এসেছিলেনও, কিন্তু বোর্ডের আনুষ্ঠানিকতার আগে চলে যান অনেকটা বিসিবিকে পাত্তা না দিয়েই। বোর্ড সভাপতি পরে নিজে সাকিবকে ফোন করে কোনো সাড়া পাননি বলে প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করেন সংবাদ মাধ্যমের সামনে।
আইপিএল খেলে রোববার ঢাকায় ফিরে সোমবার শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে আসলেও সাকিব অনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে চলে যান। অনেকটা কাউকে কিছু না জানিয়েই! কেননা সাকিব কেনো নেই বিসিবির কোনো কর্মকর্তাই সেটার উত্তর দিতে পারেননি। একশব্দে মিসিং বলে হতাশা-বিরক্তি গোপন করেননি দায়িত্বশীলরা।
পরে সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের পিঠে বেরিয়ে আসে সাকিবের এমন আচরণে বোর্ড সভাপতির অসহায়ত্বের ছাপ। নাজমুল হাসানের কথায়, ‘দুঃখজনক, আর কী বলবো! এটা দুঃখজনক, যেহেতু টিম ফটোসেশন ছিল। আমি এসেই জিজ্ঞেস করেছি। এমন কী আমি এখানে যখন ঢুকি তখন তাকে ফোন করেছিলাম। কোথায় তুমি? বলল, আমি তো চলে এসেছি। ও যে এসেছে আমি জানিও না, পত্রিকায় পড়েছি। সাকিব বলল, আপনার বাসায় আসব রাতে। আমি বলেছি, এখন একটু দেখা হোক। বলল, আমি তো বেরিয়ে গেছি।’
‘এখানে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সাকিবকে আগেই বলা হয়েছে ফটোসেশন আছে। জাতীয় দল যাচ্ছে একসাথে, ফটোসেশনে একসাথে থাকবে। এমনিতেই তো প্র্যাকটিসে ছিল না। এটা আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু সাকিব তো নেই, এটাই বাস্তবতা।’ বিসিবি বা সভাপতি সাকিবের খামখেয়ালির কাজে কতটা অসহায়-বিব্রত, সেটিই যেন ফুটে উঠেছে এভাবে।
দেড় বছর ধরে সাকিবকে মাঠে নিয়মিত পাচ্ছে না বাংলাদেশ। গত বছর সাউথ আফ্রিকা সফরে টেস্ট সিরিজের দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। চোটের কারণে বেশ কয়েকটি সিরিজ খেলতে পারেননি। সবশেষ বিপিএলের ফাইনালে পাওয়া আঙুলের চোট কাটিয়ে উঠতেই সাকিব ভারত চলে যান আইপিএল খেলতে। মাঝে তাকে ছাড়াই নিউজিল্যান্ডে খাবি খেয়েছে দল। আয়ারল্যান্ড সফর ও বিশ্বকাপের আগে দেশের ক্যাম্পে আসেননি আইপিএলে ম্যাচ অনুশীলনের কথা বলে। অথচ ভারতে ১১ ম্যাচের টানা আটটি তাকে বসিয়ে রাখে সানরাইজার্সরা। সাকিব দলের সহ-অধিনায়ক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন। ব্যাটে-বলে তার উপর ভরসা রাখতে হয় দলকে। তার এমন হঠকারী আচরণ দলের মেলবন্ধনে প্রভাব ফেলে কিনা সেটি নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
দেশের মাটিতে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শেষ। মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজে যাবে ক্রিকেটাররা। বাড়ি ফিরে খানিক গোছগাছের সময়-সুযোগ মিলবে তাদের। কেননা বুধবারই আয়ারল্যান্ডগামী বিমানে চেপে বসতে হবে। সেখানে স্বাগতিকরা ছাড়াও আরেক প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে ত্রিদেশীয় লড়াই। বলতে গেলে বিশ্বকাপের আগে নিজেদের পারফরম্যান্স, শক্তি-দুর্বলতার ফাঁক-ফোঁকরগুলো খুঁজে মেরামত করার শেষ সুযোগ। তারপর সেখান থেকেই ইংল্যান্ডে যেতে হবে। সেখানে ভারত-পাকিস্তানের সাথে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে নেমে পড়তে হবে শিরোপাযুদ্ধে।
তার আগে সাকিবের এমন খামখেয়ালি বা জার্সি কেন্দ্র করে মাথাচাড়া দেয়া বিতর্ক, দলের মনোযোগের জন্যও খানিকটা বিব্রতকর নিশ্চয়। সাকিবের জন্য তো একটু বেশি করেই তেমনটা! দল বিশ্বকাপে যেমনই করুক, এই যে বিশ্বকাপ স্কোয়াডের আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন, সেখানে সাকিবের না থাকা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস নিয়ে যতদিন নাড়াচাড়া হবে, এই মিসিং-সাকিব ছবিটাই সামনে আসবে বারবার। আর বারবার তাকে ক্যাপশন হতে হবে বোর্ডকে তোয়াক্কা না করে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি।
বিশ্বসেরা একজন ক্রিকেটার নেতিবাচকতার কারণে শিরোনাম হবেন, এটা সাকিবভক্তদের তথা ক্রিকেটপ্রেমীদেরও নিশ্চয় ভালো লাগার কথা নয়। ২০১৯ বিশ্বকাপের গ্রুপ ছবি যখনই ব্যবহৃত হবে, সেখানে সাকিব নেই, এটা সাকিবেরও নিশ্চয় মন্দই লাগবে! অথচ তিনি চাইলেই এই পরিস্থিতিটা নিশ্চিতভাবেই এড়াতে পারতেন। দিনশেষে, এসবকে সঙ্গী করেই বিশ্বকাপের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ মিশনে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। হয়ত মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েই সব বিতর্ক দূরে ঠেলে দেবে মাশরাফীর দল!