চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সাউথ আফ্রিকার সর্বনাশের নাম ‘কলপ্যাক চুক্তি’

শুরুটা হয়েছিল ক্লাউডে হ্যান্ডারসনকে দিয়ে, ২০০৪ সালে। কলপ্যাক চুক্তির ৪৩তম ক্রিকেটার হিসেবে সবশেষ দেশকে পর করে দিয়েছেন সাউথ আফ্রিকান পেসার ডুয়ানে অলিভিয়ের। এই এক চুক্তি যেভাবে প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের দেশ থেকে বিমুখ করছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই জাগছে শঙ্কা, নিকট ভবিষ্যতে প্রোটিয়াদের পথ দেখানোর মতো ক্রিকেটার অবশিষ্ট থাকবে তো!

শেষ কয়েকবছর ধরে কলপ্যাক চুক্তির কারণে টালমাতাল সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট। প্রতিবছর এ চুক্তির আওতায় দেশকে বিদায় দিয়ে ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে চলে যাচ্ছেন একাধিক প্রোটিয়া ক্রিকেটার। কেবল ২০১৭ সালেই কলপ্যাকের কারণে ৫ জন ক্রিকেটারকে হারিয়েছে সাউথ আফ্রিকা, ২০১৮ সালে যার সংখ্যাটা ৩।

যারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই আবার জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। অফফর্মের খেলোয়াড়ও যেমন আছেন, তেমনি জাতীয় দল মাতানো ক্রিকেটারও আছেন তালিকায়। শন পোলক, আন্দ্রে অ্যাডামস, জাস্টিন ক্যাম্প, আন্দ্রে নেইলদের মতো ক্রিকেটাররাও কলপ্যাকের আওতায় কাউন্টিতে খেলেছেন।

যদিও পোলক-অ্যাডামস জাতীয় দলের হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে তবেই দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু রাইলি রুশো, কলিন ইনগ্রাম, রিচার্ড লেভি, কাইল অ্যাবটদের মতো তরুণদের যখন এই সর্বনাশা চুক্তির কারণে হারাতে হয়, তখন আর কিইবা করার থাকে। ডুয়ানে অলিভিয়েরের কথাই যেমন আলোচনায় এখন!

চূড়ান্ত ফর্মে থাকা রুশোকে কলপ্যাকের কারণে হারিয়েছে সাউথ আফ্রিকা। তবে অলিভিয়েরকে নিয়ে হইচই একটু বেশিই হওয়ার কারণ এ পেসারের ফর্ম। প্রোটিয়াদের হয়ে ১০ টেস্টেই নিজের জাত চেনান অলিভিয়ের। মোট ৪৮ উইকেট নিয়েছেন সাউথ আফ্রিকার হয়ে সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে। তিনবার ৫ উইকেট নেয়াসহ এক টেস্টে ১০ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে ২৭ বছর বয়সী এ পেসারের।

চূড়ান্ত ফর্মে থাকা রুশোকে কলপ্যাকের কারণে হারিয়েছে সাউথ আফ্রিকা

এমন দারুণ যার ফর্ম, সেই ক্রিকেটার কেন জাতীয় দল ছেড়ে কাউন্টি খেলতে চলে যাবেন? এ প্রশ্নের জবাবে সাউথ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা জানলেই চলবে। ইংল্যান্ড যেখানে বিশ্বের সেরা উন্নত দেশগুলোর একটি, সাউথ আফ্রিকা সেখানে আফ্রিকা মহাদেশের ধনী দেশগুলোর একটি হলেও পেছনে লেগে আছে উন্নয়নশীল দেশের তকমা। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ অস্থিতিশীল। সন্ত্রাসীদের হাতে প্রতিনিয়ত নিহত হন সাধারণ জনগণ।

উন্নত দেশ হওয়ায় ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ সুবিধা বেশি। সহায়ক হওয়ায় ক্রিকেটাররা সেই সুযোগটাই দুহাতে লুফে নেন। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার দারুণ সম্ভাবনা তো থাকছেই, নির্দিষ্ট সময় পর থাকছে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগও। ফর্ম থাকলে খুলতে পারে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের দরজাও।

কেবল সাউথ আফ্রিকা নয়, জিম্বাবুয়ে-নিউজিল্যান্ড-ক্যারিবীয় অঞ্চলের একাধিক ক্রিকেটার কলপ্যাক সুবিধা নিয়ে ছেড়েছেন দেশ। গ্র্যান্ট ইলিয়ট, টিনো বেস্ট, ব্রেন্ডন টেলর আছেন তালিকায়। টেলর অবশ্য মাতৃভূমি জিম্বাবুয়ের টানে আবারও দেশে ফিরেছেন।

এভাবে খেলোয়াড় হারাতে হচ্ছে, সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট কতটা তৎপর তাদের প্রতিভা চুরি ঠেকাতে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসবে বাস্তবতা। আসল সত্যিটা হচ্ছে, কলপ্যাকের কাছে সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট বড় অসহায়! ২০১৬ সালে বোর্ডের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী হারুন লরগাত সত্যটা মেনে নিতে অনুরোধ করেছিলেন।

‘আমরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারি না। বিশ্বায়নের প্রভাবে অন্যসব দেশ আর সব পেশার মতো সাউথ আফ্রিকার নাগরিকরা কর্মসংস্থানের জন্য শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে যাবার সুযোগ নেবে। এটাই স্বাভাবিক। এই সুযোগ সব পেশাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কাউন্টি খেলতে যাওয়া খেলোয়াড়রা ভিন্ন কেউ নন। আর কলপ্যাককে বাধা দেবার আইনত সুযোগও নেই আমাদের।’

মরনে মরকেল নিজেও কলপ্যাক চুক্তির আওতাধীন

সুযোগ নেই বলে তো আর প্রতিভা চুরিকে চলতে দেয়া চলে না। অলিভিয়ের কাণ্ডের পর সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটকে কোমর সোজা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন কলপ্যাক চুক্তিতেই কাউন্টি দল সারেতে নাম লেখানো মরনে মরকেল, ‘তাদের (কর্মকর্তাদের) একসঙ্গে বসে খেলোয়াড়দের যাওয়া ঠেকানোর একটা উপায় বের করতে হবে। ভবিষ্যতে আরও অনেক খেলোয়াড়কে হারাতে হবে। এদেরকে দেশে রাখার জন্য তো উপায় বের করতে হবে।’

খেলোয়াড়দের দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে বোর্ডের কর্মকর্তাদের দায় দেখছেন সাউথ আফ্রিকার হয়ে ৮৬ টেস্ট, ১১৭ ওয়ানডে ও ৪৪ টি-টুয়েন্টি খেলা পেসার মরকেল। ক্রিকেট ছাড়ার পর ক্রিকেটাররা আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বলেই দেশ ছাড়েন বলে দাবি তার।

‘আপনারা কী চুক্তির অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে পারেন না? একজন ক্রিকেটার অবসর নেয়ার পর কী নিরাপত্তাটা পান? আপনারা বলছেন বিনিয়োগ হচ্ছে, কিন্তু অবসরের পর একজন ক্রিকেটারকে দূরে ছুঁড়ে ফেলা হয়। আমি একাধিক ক্রিকেটারের নাম বলতে পারি যাদের পেছনে অনেক বিনিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কই, তাদের তো আমরা কোচিংয়ে আসতে দেখছি না। এমনকি এদের ক্রিকেট একাডেমিতেও দেখা যায় না।’

‘সেইসব ক্রিকেটাররা খুবই দুর্ভাগা যারা একবার দল থেকে বাদ পড়ে যায়। আর দলীয় ভাবে যদি যোগাযোগ সঠিকভাবে না করা হয় তাহলে আপনি কীভাবে জানবেন যে খেলার জন্য ফিট আছেন কিনা? যেকোনো কাজের জন্য যোগাযোগটা হল মূল চাবি-কাঠি। এখানে (সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটে) এটা কোনো কালেই ছিল না। এ কারণে সাউথ আফ্রিকার খারাপ ছবিটা সবার সামনে ফুটে ওঠে। দুর্ভাগ্য হল সাউথ আফ্রিকায় আমাদের সংগ্রাম করতেই হবে আর এটা আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে!’

কলপ্যাক চুক্তি কী?
ইইউভুক্ত (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) যেকোনো দেশের নাগরিকরা অন্য ইইউ যেকোনো দেশে গিয়ে খেলতে পারে। এই কলপ্যাক চুক্তিতে ইইউ দেশের নাগরিকরা আরেক ইইউ দেশে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য বা সবক্ষেত্রে একজন নাগরিকের সমান সুযোগ সুবিধা পান।

সাউথ আফ্রিকানরা কী কলপ্যাক চুক্তির আওতাধীন?
সাউথ আফ্রিকা ‘কতনু’ নামক এক চুক্তির মাধ্যমে ইইউর সাথে সম্পর্কযুক্ত। জিম্বাবুয়ে ও কিছু ক্যারিবিয়ান দেশও এই চুক্তির আওতাধীন। এ কারণে এ দেশগুলো কলপ্যাক চুক্তির সুবিধা নিতে পারে।

কলপ্যাক চুক্তিতে খেলোয়াড়রা কী দেশে খেলতে পারেন?
না। একজন খেলোয়াড়কে তার দেশের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইইউভুক্ত দেশে অবস্থান করতে হয়ে। এসময় দেশে ফেরত গেলে কলপ্যাকের সমস্ত সুবিধা বাতিল হয়ে যায়।