গল্পটা শুরু করা যাক শন ব্রাউন ও তার ১৩ বছর বয়সী কন্যা লুসির কাহিনী দিয়ে। মাত্র ছয় মাস বয়সেই ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে লুসি। যত বড় হতে লাগল, তার দেহে স্থায়ীভাবে ঠাই করে নিতে লাগল আরও নানান জটিল রোগ। বর্তমানে মস্তিষ্কে পক্ষাঘাত আর মৃগী রোগে আক্রান্ত শনের কন্যা লুসি। মাত্র ৫ বছর বয়সে মেরোবোন ট্রান্সপ্লান্টের জন্য চিকিৎসকের ছুরিকাঁচির নিচ থেকেও ঘুরে আসতে হয়েছে তাকে।
এত অল্প বয়সে নানান জটিলতায় ভুগতে হয়েছে বলে লুসি স্বাভাবিকভাবেই খুব সাহসী এক মেয়ে। এতটাই যে, সাহসিকতার জন্য পৃথিবীতে যদি কেউ ধনী হত লুসি হত তাদের অন্যতম। ছোট দেহে কঠিনসব রোগ নিয়েও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লিভারপুলের কট্টর সমর্থক লুসি ও তার বাবা শন ব্রাউন। সঙ্গে লিভারপুলের মিশরীয় ফরোয়ার্ড মোহামেদ সালাহ যেন লুসির চোখের মনি!
এবার আসা যাক গল্পের নায়ক প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালের মে’র মাঝামাঝি সময়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের প্রস্তুতি সারছেন মোহামেদ সালাহ ও লিভারপুলের অন্য ফুটবলাররা। অনুশীলন শেষে ড্রেসিংরুমে সালাহকে এক ভিডিও দেখালেন সতীর্থ ড্যানি ইং। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হুইলচেয়ারে বসে ছোট্ট এক মেয়ে গাইছে, ‘মো সালাহ, মো সালাহ, মো সালাহ! পাখা ছাড়া উড়ছে সে। সালাহ, সে যে মিশরের রাজা।’
সেই ভিডিওটি টুইটারে দুই হাজার লাইক পেয়েছে। দেখা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ হাজারবার। ইংয়ের কল্যাণে যার জন্য গাওয়া গান সেই সালাহও আছেন এই তালিকায়।
খেলার বাইরে নানা দাতব্য কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ড্যানি ইং। ড্রেসিংরুমে সালাহকে সেই ভিডিও দেখানোর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল যদি কিছু সাহায্য মেলে মেয়েটির জন্য! ভিডিও দেখে এক মুহূর্তও দেরি করেননি সালাহ। সঙ্গে সঙ্গে ইংকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বলো, আমরা সবাই মিলে কী করতে পারি?’
হুইলচেয়ারে বসা সেই মেয়েটার নাম লুসি ব্রাউন। তার জন্য অবশ্য খুব বেশিকিছু করেননি সালাহ ও তার সতীর্থরা। শুধুমাত্র একটি জার্সিতে দলের সবাই মিলে স্বাক্ষর করে উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন লুসির জন্য।
অনেক সময় অনেক দামী উপহারও মানুষকে খুশি করতে পারে না। আবার এর উল্টোটারও নজির কম নাই। সামান্য এক উপহার কারও জীবনে বয়ে আনে সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। লিভারপুলের খেলোয়াড়দের স্বাক্ষরিত জার্সি পেয়ে লুসির জীবনে বয়ে গেল খুশির বন্যা।
কতটা আনন্দিত ছিল ১৩ বছরে লুসি? ‘আমি ওকে সেই জার্সি পরিয়ে একটা ছবি নিয়েছিলাম। সে কিছুতেই সেই জার্সিটা খুলতে চাইছিলো না।’ ছয় মাস পর মেয়ের আনন্দের কথা বলতে গিয়ে নিজেই অশ্রু ঝরান শন।
‘লোকে হয়তো বলবে এটা তো খুব সামান্য উপহার, কিন্তু আমি বলব মোটেও না। এটা বিশাল। অনেকেই বলেন যে, ফুটবলাররা প্রচুর অর্থ কামান। আর এই কারণে তারা তাদের মানবিকতা বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেন। ভক্তদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সালাহ’র মাঝে এখনো মনুষ্যত্ববোধ আছে। এই কারণে সে সময় নিয়ে ভিডিওটি দেখেছে। আমার মেয়ের জন্য জার্সি পাঠিয়েছে।’
‘সালাহর আরও এমন অনেক কীর্তি আছে যা আমাদের চোখে পড়ে না। আমার কাছে সে একজন সত্যিকারের খেলোয়াড়, যে ভক্তদের যত্ন নেয়। বুঝতে চেষ্টা করে ভক্তরা তার প্রতি কতটা আবেগী।’
‘আমার মেয়ে লুসি এখন জানে সালাহ কেমন মানুষ। সে যেখানেই সালাহ’র ছবি দেখে চিৎকার করে বলে দেখ বাবা ওই যে মো সালাহ! আমরা একসঙ্গে বসে খেলা দেখি। সালাহ, সালাহ বলে চিৎকার করি! আমার মেয়ে গান গায়। তার মুখের হাসি দেখে আমার চোখে জল আসে। সেই জল লুকানোর চেষ্টা করি না। সালাহকে নিয়ে বলতে গেলে আমার আর কথা বের হয় না।’ শন বলেন আর হাসেন!
শনের কথাই যেন ঠিক। সালাহর অনেক কীর্তিই আছে যা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা। ২০১৭ সালে ইতালির এএস রোমা থেকে লিভারপুলে এসে মিষ্টি হাসি আর মৃদু স্বরের কথা দিয়ে দলটির সমর্থকদের মন জয় করেছিলেন। এরপর তো এক মৌসুমে ৪৪ গোল করে তাদের মানসপটের উচ্চতর স্থানটুকু যেন নিজের করে নিয়েছেন মিশরীয় ফরোয়ার্ড।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে রোমা সমর্থকদের হাতে আহত এক ভক্তের জন্য জার্সি দান করেন সালাহ। সেই জার্সি বিক্রি করে পাওয়া ১৪০০ পাউন্ড ব্যয় করা হয় ওই ভক্তের জন্য।
কেবল এটিই নয়। মুসলিমদের প্রতি স্থানীয় লন্ডনবাসীর দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন হয়েছে সালাহ’র কল্যাণে। লিভারপুল সতীর্থ সাদিও মানেকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার সালাহ’র জুম্মার নামাজ আদায় করাটা নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে লিভারপুলবাসীর জন্য। সেই সময়টা মসজিদের আশেপাশে নীরব রাখার চেষ্টায় থাকেন তারা।
ইতিবাচক আচরণ আর খেলার মাঠের কীর্তিতে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সালাহ, লিভারপুলের কট্টর মুসলিমবিরোধীও কোনো কথা বলার আগে ভেবে নেন যে সেটি সালাহকে আঘাত করবে নাতো!
লিভারপুল যেন পুরোটাই সালাহময়। সেখানকার আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় সালাহকে নিয়ে দেয়ালে ব্যানার আছে, সাইনবোর্ড আছে। হাসিমুখে সেই সব ছবির পাশে সেলফি তুলছেন মিশরীয় ফরোয়ার্ড। স্বীকৃতি দিচ্ছেন সেসব কীর্তির।
শুধু লিভারপুলই নয়, সালাহ পরিণত হয়েছেন জাতীয় বীরেও। মিশরকে রাশিয়া বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার পেছনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন এ ফরোয়ার্ড। মিশরের শিশুদের জীবনের একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য আছে। ফুটবলার হওয়ার লক্ষ্য। ঠিক সালাহ’র মতো। সালাহ’কে এখন আদর করে দেশে ডাকা হচ্ছে ‘মিশরীয় মেসি’ নামেই।
সালাহ’র সাফল্য মিশর এবং আফ্রিকান শিশুদের জন্য একটি ব্যাপক অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে উঠেছে। সালাহ নিজেও তা স্বীকার করেছেন। জানুয়ারিতে আফ্রিকান সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়ের পর বলেছেন, ‘কখনোই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না, আত্মবিশ্বাসটা আটকে দিও না।’
অনেক সামাজিক কাজে জড়িত আছেন লিভারপুল তারকা। নিজের গড়া দাতব্য সংস্থায় প্রতি মাসে ৫০ হাজার মিশরীয় পাউন্ড দেন তিনি। ওই সংস্থা চালাতে মাসে এটাই খরচ হয়।
ছুটির দিনে বিদেশ নয়, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে নিজ গ্রাম নাগরিগেই ফেরেন সালাহ। মানে শিকড়ের টান ভোলেননি খ্যাতির চূঁড়ায় পৌঁছেও।
শুধু দাতব্য সংস্থাতেই নয়, সালাহ নিয়মিত অনুদান দেন তার গ্রামের বাসুয়ান হাসপাতাল এবং নির্মানাধীন বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও।
তার গ্রামের মানুষজন গর্ব করেই বলেন, ‘আট বছর বয়সী সালাহ আর বর্তমান সালাহ একই রকম বিনয়ী।’ আর এসব কারণেই সালাহ হয়েছেন নিজ দেশ ও লিভারপুলবাসীর ‘রাজা’; যার কোনো মুকুট নেই। আসলে ভালোবাসার সিংহাসনে চড়তে যে মুকুট লাগে না।
গোলডটকম থেকে নীল জোন্সের লেখা অবলম্বনে