চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সন্ত্রাসবাদের হেমলক সোসাইটি

অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর প্রাথমিকভাবে ধর্মভিত্তিক কট্টরপন্থায় যুক্ত হবার কারণ কট্টরপন্থার সংগঠকরা সবসময় তাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে এবং ধীরে ধীরে তাদের একটা মানসিক আশ্রয় হয়ে ওঠে। ফলে একপর্যায়ে ঐ তরুণ-তরুণীদের সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনায় ব্যবহার করা সহজ হয় সন্ত্রাসবাদের হোতাদের।

অন্যদিকে সেক্যুলার বাতিঘরেরা সেলিব্রেটি হবার নেশায় এতোই মাতোয়ারা থাকেন যে; তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে একটু মনোযোগ দিয়ে কথা বলার সময় থাকে না তাদের। আর সময় দিলেও প্রতিভার ঠেলায় ‘অমুক বই পড়েছো’ ‘তমুক বই পড়েছো’ ‘তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’ টাইপের আচরণ করে বসেন। ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক অসাম্প্রদায়িকতার ঐক্যটি গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।

আমরা সৌভাগ্যবান; আমাদের সময়ের উদারপন্থার বাতিঘরেরা অত সেলিব্রেটি ভাবতেন না নিজেদের। দেখা হলে খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতেন; সাহজিকভাবে প্রজ্ঞা বিনিময় করতেন। বর্তমান প্রজন্মের দুর্ভাগ্য তারা এমন আন্তরিক মানুষগুলোকে পেলো না। পেলো কিছু শশব্যস্ত বড় ভাই যারা সেলফি তোলার বেশি সময় দিতে পারেন না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, অবহেলিত তারুণ্য ঝুঁকে পড়েছে মিষ্টভাষী-মনোযোগ দেয়া কট্টরপন্থী খুনের সওদাগর সংগঠকদের ভ্রান্ত চিন্তা ও আত্মঘাতী দর্শনের দিকে।

আমাদের প্রজন্মের বড় ভাইয়েরা একটু মনে করে দেখুন, আমাদের অগ্রজপ্রতিম বা পিতৃপ্রতিম মানুষেরা কতো সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন; কতো মানবিক ছিল তাদের জীবনাচার। তারা আমাদের স্যুটের বাহার দেখাননি; বড় গাড়ি দেখাননি; ভঙ্গুর সাফল্যের কোনো ভুল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে তুলে ধরেননি। গল্পে গল্পে তুলে ধরেছেন একটি বুক শেলফ; আলোকায়নের জানালা খুলে দিতে চেষ্টা করেছেন পরম যত্নে। আর একালের বড় ভাই বা পিতৃপ্রতিমেরা বিজ্ঞাপনের ইলিউশানে ঝকমারি জীবন সাজালো। ছদ্ম এলিটিজম দেখিয়ে পরের প্রজন্মকে মোহরমুখী করে তুললো। ফলে একদল তরুণ বড় ভাইদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে একটা ছদ্ম এলিট জীবন অর্জনের সন্ত্রাস শিখলো। যা অতর্কিতে ভেঙ্গে দিলো সামাজিক সাম্যভাবনার ন্যূনতম সম্ভাবনা।

আরেকদল তরুণ দূর থেকে বড় ভাইদের বিরাট এলিট হয়ে ওঠার গজদন্তের মিনার দেখে কাছে আসতেই ভয় পেলো। তখন তারা চলে গেলো অত্যন্ত কৌশলী ধর্মের সাইনবোর্ড নিয়ে বসে থাকা বড় হুজুরদের কাছে। তারা মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের বঞ্চিতের বেদনায় টোকা দিলো; নানা-অনুভূতির টোটকা খাওয়ালো; বুঝিয়ে দিলো, যতই চেষ্টা করো এলিটেরা তোমাদের পাতে নেবে না; এসো এক পাতে ভাত খাই।

এরপর অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে-মেয়েরাও আকৃষ্ট হলো পশ্চিমা শিক্ষিত বড় হুজুরদের মোটিভেশনাল বক্তব্যে। পশ্চিম ফেরত বড় হুজুর বোঝালো, এই যে যারা দেশপ্রেম করে, রবীন্দ্র সংগীত করে; তারা তোমাদের পাতে নেবে না। এসো এক পাতে খিলাফতের সংস্কৃতি করি; ঐ যে পশ্চিমের উঁচু দালানঘর এগুলোর ওপর অধিকার তোমাদের; শুধু যুদ্ধ করে জিতে নিতে হবে; আর পশ্চিমের ধবল নারীরা হবে তোমাদের যুদ্ধে জেতার উপহার। আধা যুদ্ধ জয়ের কল্পনা-আধা লিবিডোর সংমিশ্রণের এই বক্তব্যের মাদকতায় মুগ্ধ তরুণেরা বেছে নিলো আত্মঘাতী পথ।

অথচ সব তরুণ-তরুণীই সম্ভাবনাময়; তাদের কারোরই জীবন ঘাতী এই খেলায় জীবন দেবার কথা ছিলো না। শুধু মনোযোগের অভাবে; সামাজিক যত্নের অভাবে; সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্বের অভাবে তারা মানবিক জীবনের অমৃতের স্বাদ নিতে পারলো না। হয়ে পড়লো সন্ত্রাসবাদের হেমলক সোসাইটি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)