পৃথিবীর সব দেশের সংখ্যালঘুদের সংকট মোটামুটি একইরকম।‘স্বপ্নের দেশ’ আমেরিকার সংখ্যালঘুরা যেমন সেখানের সংখ্যাগুরুদের হাতে মার খায়, তেমনি এশিয়ায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে দাবিকৃত বাংলাদেশও এই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুত্বের টানাপড়েনের বাইরে নয়। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশের প্রতিবেশী এবং বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে খ্যাত ভারতও। বাংলাদেশে যারা সংখ্যাগুরু, ওখানে তারাই সংখ্যালঘু।
ছেচল্লিশে দেশভাগের কিছু আগে থেকেই এই ভূখণ্ডের একটি জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং দলে দলে হিন্দুরা পাড়ি জমায় ওপার বাংলায়। সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র-এরকম গালভরা শব্দের চেতনায় একাত্তরে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও সংখ্যালঘুরা সংখ্যালঘুই রয়ে যায়। নামমাত্র মূল্যে হিন্দুদের জমি কিনে নেয়া অথবা না কিনেই দখল কিংবা জমি বেচতে বাধ্য করার মতো কেস স্টাডি দেশের প্রত্যেক জনপদেই রয়েছে।
সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর যেসব মানুষের ব্যাংকে এখন হাজার কোটি টাকা ব্যালান্স, তাদের অনেকের হাতেই সংখ্যালঘুদের রক্ত কিংবা চোখের পানি আছে।এখানে সংখ্যালঘু কেবল হিন্দুরাই নয়, সংখ্যালঘুর তালিকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (আদিবাসী বলা নিষেধ), সংখ্যালঘুর তালিকায় হিন্দু-মুসলিম দলিত। অর্থাৎ শক্তিমান সংখ্যাগুরুদের থাবা থেকে কোনো সংখ্যালঘুরই নিস্তার নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গত ৩০ অক্টোবর যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি যে খুব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম এমন কোনো ‘দুঃখজনক’ ঘটনা ঘটলো, ব্যাপারটা এমন নয়। নিয়মিত বিরতিতেই এই ঘটনা ঘটে। তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ কিংবা গুজবে প্রকাশ্য দিবালোকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে। মনে রাখা দরকার, তিনিও একজন ‘মালাউনের বাচ্চা’।
ফলে আজকে যখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হিন্দুদের ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে গাল দিয়েছেন কি দেননি বলে তর্ক হচ্ছে, প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে-এটি খুবই হাস্যকর। কেননা, এই ভূখণ্ডের একটি বড় জনগোষ্ঠীই তা শিক্ষিত অশিক্ষিত গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক-মনে মনে তারা হিন্দুদের ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলেই গালি দেন এবং তারা বিশ্বাস করেন, ‘মালাউনের বাচ্চারা এই দেশকে ওউন করে না।এই দেশে আয় করে। টাকা পাঠায় ইন্ডিয়ায়।’
সুতরাং একজন মন্ত্রীর মুখ থেকে এই শব্দটি বের হলো কি না হলো না-সেটি আসলে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুত্বের এই তর্কে নতুন উসকানি বৈ কিছু নয়।
চোখ ফেরানো যাক দেশের উত্তর জনপদে; গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে।৬ নভেম্বর সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করেছে সাঁওতালদের। রংপুর সুগার মিলের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হলেও, সাঁওতালদের দাবি, অনেক আগে থেকেই ওখান থেকে তাদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ৬ নভেম্বর তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। প্রতিবাদ করতে গেলে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।শ্যামল হেমব্রম নামে একজনের মাথার খুলি উড়ে যায়। গুলিবিদ্ধ আরও বেশ কয়েকজন। সব মিলিয়ে আহত অন্তত ৩০। কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
তবে ঘটনার পরদিন ৭ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের খবরে বলা হয়েছে, রংপুর মেডিকেলে ভর্তি আহত সাঁওতালদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। উল্টো তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এমনকি আহতদের সাথে দেখা করতেও পারছেন না তাদের স্বজনরা।
বন-পাহাড় থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে উচ্ছেদ এটিই প্রথম নয়। মধুপুর বনের গাছ কেটে নেয়ার অভিযোগে শত শত আদিবাসীর বিরুদ্ধে মামলা এবং মামলায় হয়রানিও বহু পুরনো স্টাইল। যে মানুষেরা বনের ওপর নির্ভরশীল, যুগ যুগ ধরে যেখানে তারা বসবাস করেন, সেখানের গাছপালা কেটে নিয়ে নিজেদের আসাবস্থল অরক্ষিত করার মতো আত্মঘাতি কাজ করা যে কোনো অর্থেই যৌক্তিক নয়, তা যুক্তিবাদী যেকোনো মানুষের পক্ষেই বোঝা সহজ। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের বোঝায়, ওরাই বনের শত্রু। কারণ ওরা সংখ্যালঘু।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)