একুশে মানেই কি শুধু শোকের হয়ে রয়ে যাবে? একুশ মানেই কি মাতমের, কান্নার, বেদনার থেকে যাবে? কখনো কি এই দিনে বাংলার আকাশে একটুখানি সুখের ছোঁয়া মিলবে না? মিলবে না প্রিয়জনের সঙ্গে সুখ ভাগাভাগি করার সুযোগ? ভালোবাসার মাতৃভাষার সঙ্গে নিরুদ্বিগ্ন জীবন কাটানোর মূহুর্ত?
১৯৫২ সালের এই দিনে ঝরেছিলো ভাষার তরে প্রাণ। সেদিন আকাশে-বাতাসে উড়েছিলো গোলাবারুদের ধোয়া। আজ ২০১৯ সাল! শহিদ মিনারের ওপাশেই, এক দেয়াল পরেই সত্তরটি দেহ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। কিছু পথ হেঁটে গেলেই মিলবে পুরনো ঢাকার চকবাজারের আকাশে পুড়ে যাওয়া মানুষের ধোয়া।
শহিদ বেদিতে একুশের মহান ভাষা সংগ্রামীদের প্রতি চলছে শ্রদ্ধাঞ্জলি। আর এক দেয়াল পরেই মেডিকেলের মর্গে চলছে আর্তনাদ। চকবাজারের নৃশংস অগ্নিকাণ্ডে পোড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়াদের স্বজন তারা। কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ মা, ভাই, বোন, বন্ধু কিংবা কেউ হারিয়েছেন তার প্রিয়তম স্বামীকে। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এক মা বলছেন, কেন চলে গেলি? কিভাবে ছেড়ে গেলি আমাকে?
যে মা সন্তানের জন্ম দিলেন। সেই মা পৃথিবীতে একা, সম্পূর্ণ একা পড়ে আছেন, সন্তান হারানোর বেদনায় আহজারি করছেন। তার আদরের, কলিজার টুকরা সন্তান পুড়ে হয়ে গেছেন অঙ্গার!
আজ আকাশটি নীল হয়ে গেছে। বিষে বিষাক্ত নীলাম্ভর আকাশের দিক তাকালেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে! মর্গের পাশে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। নিরীহ মানুষের আহজারি সইতে যে বড্ড কষ্ট হয়! বুক আনচান করে উঠে! এমন একটি দিনেই আকাশ নীল হতে পারলো? এমন একটি দিনেই বিষ ছড়াতে পারলো আকাশ? এমন দিনেই ঢাকার আকাশে উঠেছে শোকের মাতম, বেদনার ঢেউ উঠতে পারলো!
সকালে চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় পোড়া ভবনে হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ছাপ। ভবনের নিচে কত রকমের পোড়া বোতল, গাড়িগুলো বোম ব্লাস্টের মতো পুড়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন দেখছি সিরিয়ার কোনো নগর, প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি বোমায় পোড়ে যাওয়া গাড়ি, যেন মহাযুদ্ধের পরের ধ্বংসস্তুপ। পাশে তাকিয়ে দেখি, পুড়ে গেছে মসজিদের একটুরো দেয়ালও।
এক ভবনের সঙ্গে লাগোয়া আরেকটি ভবন। ঘিঞ্জি, আবদ্ধ, বাঁকানো গলি। সেই গলির ভেতরেই ভবনের সঙ্গে ভবন লেগে জোরপূর্বক টিকে থাকা। ভাঙাচুরা স্থাপনা, পুরনো জরাজীর্নতায় বেসামাল অবস্থা ভবনগুলোর।
বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে চকবাজারের নন্দকুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সেই আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ থেকে সকাল ১১টা পযন্তও ৭০ জন মৃতের কথা বলা হয়। আর স্থানীয়রা বলছৈন, দেড় শতাধিক তো মারা যেতেই পারেন। এই ভবনে নাকি প্রায় আড়াইশ লোকের বাস।
টানা দশ ঘণ্টা পুড়তে থাকা ভবনে কত মানুষ পোড়ে ছাই হয়ে গেছে হয়তো কেউ জানে না। কত মা তার সন্তানের সোনামুখ দেখতে পাবে না তা কেউ জানে না! এখন ঢাকা মেডিকেলে চলছে ডিএনএ টেস্ট। লাশ শনাক্ত করতে হবে। এতোটাই পোড়ে অঙ্গার হয়েছে যে, শনাক্ত করাও দু:সাধ্য হয়ে গেছে।
আগুন লাগাল সঙ্গে সঙ্গে এই সরু গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির প্রবেশ অসম্ভবই বলা চলে। তবু ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের ৩৯টি ইউনিট। টানা দশ ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনেন তারা।
প্রশ্ন হলো কিভাবে আগুন লাগলো? এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তারা বলছেন তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে। তবে স্থানীয়দের কথায় জানা গেলো, প্রথমে এক পিকআপের সাথে প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ, সেই পিকআপে ছিল সিলিন্ডার গ্যাস। সেটার বিস্ফোরণ আগে হয় অথবা হয় প্রাইভেট কারের সিএনজি বিস্ফোরণ। এর পাশেই ছিল হোটেল, হোটেলে রান্না হচ্ছিল গ্যাসে, সেই গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ। সাথে থাকা বৈদ্যুতিক খুটিতে ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ!
এভাবেই ছড়িয়ে পড়লো আগুন। আগুন ছড়িয়ে গেল ভবনে, ছিল নেল পালিশের কেমিক্যালের গোডাউন থেকে শুরু করে পারফিউমের কেমিক্যাল। এমনকি লাইটার রিফিলের গ্যাসের ছোট ছোট জার। দুদিন আগেও সাত ট্রাক কেমিক্যাল ঢুকেছে নাকি সেখানে।
ওয়াহিদ ম্যানসন থেকে খানিক দূরে বাস করেন মজিদ সাহেব। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, পুড়ে ছাই হওয়া ওয়াহিদ ম্যানসনের ওয়াহিদ সাহেব মারা গেছেন আগেই, তার দুই ছেলে এ ভবনে থাকতেন। কি দুর্ভাগ্য, তারা যে কেমিক্যাল গোডাউন ভাড়া দিলেন, তার বিস্ফোরণেই প্রাণ গেছে নিজেদের পরিবারের লোকদের।
শোনা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাজেমেন্ট বিভাগের এক মেধাবী শিক্ষার্থীও এই আগুনে পুড়ে গেছে। কাওসার আহমেদ নামের সেই মেধাবী মুখটি তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিলো। সেই স্বপ্ন পোড়ে ছাই হয়ে গেছে আজ!
এই বেদনার কথা কে কাকে বুঝাবে? কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? অনেকে বলবেন, নিমতলির অগ্নিকাণ্ড থেকে শিক্ষা নেয়া হলো না। অবৈধভাবে কেমিক্যাল গোডাউন রাখা হয়েছে এখানে। কিন্তু কার কথা কে শুনবে? কে কাকে মানাবে কিংবা কে কাকে বুঝাবে? কে এই অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে?
যদিও ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে সরকার আছে বলে ঘোষণা দেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, যতো রকম সহযোগিতা করা দরকার তা করা হবে। ক্ষতিস্থদের পুনর্বাসন করা হবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, নিমতলির ট্রাজেডির পরেও যে ঘটনা ঘটলো তা আমাদের জন্য শিক্ষা। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব কেমিক্যাল কারখানা সরানোর জন্য আমরা সকল ধরনের সহায়তা দিব। এখানে যেন কোনো ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন না থাকে সেটি নিশ্চিত করা হবে।
যতো শান্তনা, যতো আশ্বাসই দেওয়া হোক না কেন, যে মানুষ পুড়ে গেছে, যে প্রাণ ঝরে গেছে তা ফিরবে না। এখন যদি আগামীর জন্য কিছুটা সচেতন হওয়া যায় সেটাই একমাত্র উপায়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল শাকিল নেওয়াজ তেমনটাই বলছেন, সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।