পারভীন হক সিকদার প্রথম কোনো ব্যাংকের চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা একমাত্র বাংলাদেশী নারী। বেসরকারি খাতে এই দেশের প্রথম ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারপার্সন হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে তিনি রেখেছেন অনন্য সাধারণ ভূমিকা। আর এখন তিনি এই ব্যাংকেরই নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে পালন করেছেন দায়িত্ব।
একজন উচ্চ শিক্ষিত নারী উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব পারভীন হক সিকদার। ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে মেয়েদের ডাক্তারি পেশায় এগিয়ে আসতে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন তিনি।
সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ এবং মনোয়ার সিকদার মেডিকেল কলেজ এই দেশে মেয়েদের ডাক্তারি শিক্ষায় অনন্য দুটি প্রতিষ্ঠান। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে রয়েছে পারভীন হক সিকদারের অক্লান্ত পরিশ্রম। সম্প্রতি এই নারী উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব একাদশ জাতীয় সংসদের শরীয়তপুর জেলা থেকে সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পারভীন হক সিকদারের প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে চলে আসে তার পিতা জয়নুল হক সিকদারের পরিচয়। তাই এখানে পারভীন হক সিকদারের পিতা এবং তাদের পারিবারিক নানামুখি উন্নয়ন উদ্যোগসহ প্রভৃতি বিষয় উল্লেখযোগ্য। জাতীয় অর্থনীতিতে একজন নামী ব্যক্তিত্ব জয়নুল হক সিকদার। যিনি তার কর্মদক্ষতা, একাগ্রতা ও মেধার গুণে আজকের অবস্থানে অধিষ্ঠিত।
প্রতিজ্ঞা, নিষ্ঠা আর শ্রমের মাধ্যমে একজন মানুষের একার পক্ষে বিরাট স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব তা প্রত্যক্ষ করতে হলে যেতে হবে জয়নুল হক সিকদারের কাছে। সততা, কর্মনিষ্ঠা ও একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করে মানুষ যে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পারে জনাব জয়নুল হক সিকদার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জয়নুল হক সিকদার একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি কিংবদন্তি, একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে জয়নুল হক সিকদার মেজাজী ও একরোখা মনে হলেও বাস্তবে তিনি হৃদয়বান, পরোপকারী ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত একজন দেশপ্রেমিক।
পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই খ্যাতি ছড়িয়েছে তাদের মৃত্যুর পর। কিন্তু জয়নুল হক সিকদার এমনই একজন কিংবদন্তী যার খ্যাতি তার জীবদ্দশাতেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, আলোকিত করেছে দেশ বিদেশের লাখ লাখ পরিবার। হাসি ফুটিয়েছেন লাখ লাখ মা বাবার মুখে। এসব সম্ভব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, একাধিক মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় নির্মাণ করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম। তিনি একমাত্র কিংবদন্তি সর্বজন শ্রদ্ধেয় জয়নুল হক সিকদার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবারই তিনি চাচা কতো আপন, কতো কাছের।
অকুতোভয় দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার এদেশকে স্বাধীন করার জন্য, যেখানে শুনেছেন শত্রুবাহিনীর কথা, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বীরের মতো। যুদ্ধ করেছেন নিজের জীবনকে বিপন্ন করে। তিনি একাই মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই তার আপন ভাতিজা বিশিষ্ট ছাত্রনেতা এম এ রেজা, চাচাতো ভাই আব্দুল হাকিম সিকদার, মন্টু সিকদার, মান্নান সিকদার, মতি সিকদার এদেরকেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন। বড় ছেলে মমতাজুল সিকদার ওরফে মঞ্জু মাত্র ১২/১৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
এরকম একটি দুঃসাহসিক ও ত্যাগী পরিবার আর একটি দেখা যায়নি। জয়নুল হক সিকদারের জন্ম ১৫ মে ১৯৩৩ সালে ভারতের আসামে। জয়নুল হক সিকদারের লেখাপড়া হাতেখড়ি হয় আসামের বিলাসপুর বাড়িতে। স্কুলজীবন শেষ হওয়ার আগেই সপ্তম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় জয়নুল হক সিকদারের প্রতিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। হিন্দু শিক্ষক রাসুল (স.) সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে পারিবারিক সিদ্ধান্তানুযায়ী স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা সমাপনীর জন্য আলীগড় অবস্থানের পর আবার বালক জয়নুল হক আসামে ফিরে এসে ইন্দ্রনারায়ণ একাডেমিতে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে তিনি অল্প সময়েই ছাত্রদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে পৈত্রিক আদিনিবাস কার্তিকপুর হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত বরিশাল সেন্টার থেকে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন।
জয়নুল হক সিকদার ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় একবার বাবার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ব্যবসা ছিল নেশার মত। আসামে মেলা চলাকালীন সময়ে লটারির টিকেট বিক্রির ব্যবস্থা করে ভালই লাভ করতেন। ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা থেকে আসামে ফিরে ঢাকায় জমি ক্রয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা পিতার কাছে চান। পিতা উপদেশ দেন কলেজে ভর্তি হয়ে লেখা পড়া করে বড় হয়ে নিজে আয় করে জমি ক্রয় করতে। পিতার কাছে টাকা না পেয়ে তিনি ঠিক করলেন নিজ প্রচেষ্টায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবেন। একটি ক্যামেরা, একটি দামি ঘড়ি, তিনটি সোনার আংটি ও দুটি সোনার মোহর নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। প্রথম জীবনে তিনি বার বছর আর্মিতে চাকুরি করেন। পরবর্তীতে তিনি ট্রাক ক্রয়ের মাধ্যমে জীবনের প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত জীবনে জয়নুল হক সিকদার অলৌকিকতার প্রভাব, অলৌকিক শক্তির সহায়তা অলৌকিকভাবে বিভিন্ন জিনিস পাওয়ার ঘটনা অনেক।
ব্যক্তিগত জীবনে জয়নুল হক সিকদার আল্লাহ ভীরু একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। জয়নুল হক সিকদার একটি ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্র নিয়ে ছয় দশকের বেশি সময় ধরে ব্যবসায় অব্যাহতভাবে অবিশ্বাস্য সফলতা অর্জন করে চলছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অনিয়ম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন মুহূর্তের মধ্যে। ১৯৫৭-৫৮ সালে ৪টা ট্রাক দিয়ে প্রভিনসিয়াল ইঞ্জিনিয়ার্স কোম্পানির সঙ্গে ধানমন্ডি এলাকায় মাটি ভরাট কাজ যৌথভাবে শুরু করার পর প্রচুর লাভ আসতে থাকায় ধানমন্ডি ১৫ নং সড়কের বর্তমানে (৮নং) পশ্চিমে জায়গা ক্রয় করে বাড়ি তৈরি করেন। ১৯৬০-৬১ সালে রায়েরবাজার এলাকায় এক এক করে ১০টা ইটের ভাটা চালু করেন। এরপর নিজ নামে ঠিকাদারি ব্যবসা করার জন্য জয়নুল হক সিকদার অ্যান্ড সন্স এবং পরবর্তীতে জয়নুল হক সিকদার প্রাইভেট লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সরকার থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ঠিকাদারী লাইসেন্স অনুমোদন পান। পরবর্তীতে তিনি প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারী লাইসেন্স অনুমোদন পান।
অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অনেক স্থানে ইমারত ও ব্রিজ নির্মাণ করে কন্ট্রাক্টর হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে (১৯৬৬-৬৭) ও বিশ্ব ব্যাংকের (১৯৭০) কাজ করার প্রাক যোগ্যতা অর্জন করেন। ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রচুর লাভ আসতে থাকায় ১৯৭০ সালে পূর্ব রায়ের বাজার এলাকায় কয়েকশত বিঘা জমি ক্রয় করেন। তার ব্যবসাতে এতই সফলতা আসে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিকে সিকদার সাহেবের ভাতিজা এম এ রেজার সঙ্গে ব্যবসা করতে বলেছিলেন। তিনি নিজ হাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে দিয়েছিলেন শেখ অ্যান্ড সিকদার কোম্পানি।
জয়নুল হক সিকদার প্রায়ই বলেন বঙ্গবন্ধুর মত আপোষহীন সাহসী দেশপ্রেমিক নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ কোন কালেই স্বাধীন হতে পারত না। শুধু তাই নয় জাতির জনক হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ন্যায়নীতির তুলনাবিহীন দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে একজন। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে তৎকালীন শেখ মুজিব সরকার ১৭টি জেলায় গভীর নলকূপ বসানোর কাজ হাতে নেন। সিকদার সাহেব পান তৎকালীন সমগ্র যশোর জেলার কাজ। দুটি সিনেমা প্রযোজনা করেছিলেন। একটি আলো তুমি আলেয়া অন্যটি আদালত। এ ব্যবসায়ও তিনি সফলতা অর্জন করেন।
শরিয়তপুর অঞ্চলের মানুষের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের সু ব্যবস্থার জন্য তিনি দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি ফরিদা ও এমভি পান্না দিয়ে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস চালু করেন। নৌপথে মাল পরিবহন সুবিধার্থে দুটি বার্জ ও একটি টাং বোট ক্রয় করেন। ব্যবসায় বিভিন্ন রকম সফলতা আসতে থাকায় তিনি নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তিনি মনের দুঃখে এদেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানেও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার চারদিন পর সিকদার সাহেব তার বাড়ির আঙ্গিনায় চারটি গরু জবাই করে বঙ্গবন্ধুর কুলখানি করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে এতো গভীরভাবে ভালবাসতেন যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ১২ বছর পর্যন্ত তিনি ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জয়নুল হক সিকদার সপরিবারে আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা ব্যবসা প্রসারের পাশাপাশি তিনি সেখানে বিখ্যাত সেঞ্চুরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হন। এক লাখ পঁচাশি হাজার ডলারে মারবিস্টায় একটি বাড়ি ক্রয় করেন। এই বাড়িটি এখন অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আমেরিকায় বসবাসের জন্য তিনি আরেকটি বাড়ি ক্রয় করেন। আমেরিকায় আরও অনেকগুলো বাড়ি ক্রয় করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে আমদানি রফতানি ব্যবসা শুরু করেন।
বাংলাদেশের পোশাক তৈরি করে আমেরিকাতে বিক্রয়ের ব্যবস্থা ও এনার্জি ড্রিংকের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া গ্যাস স্টেশন ও অটোমেটিক কার ওয়াশিং এর ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে আমেরিকাতে ৮টি গ্যাস স্টেশন ও ১২টি অটোমেটিক কার ওয়াশিং সেন্টারে ব্যবসা রয়েছে তার। আমেরিকায় কই নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। মেঝ ছেলে নিক হক সিকদার দক্ষতার সঙ্গে তা পরিচালনা করছেন। আমেরিকার একাধিক শহরে এর শাখা রয়েছে। পৃথিবীর কয়েকটি দেশের দ্বীপ এলাকায় কই রেস্টুরেন্ট ও কই রিসোর্ট অ্যান্ড রেসিডেন্স প্রতিষ্ঠা করেও সিকদার গ্রুপের ব্যবসায়িক সফলতা প্রসারিত হচ্ছে। যেমন আমেরিকা, আবুধাবি, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড এবং সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিজ।
জয়নুল হক সিকদার আমেরিকা থেকে ফিরে নতুনভাবে ব্যবসা চালু করেন। ১৯৮৩ সালের ২৩ মার্চ প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের তিনি উদ্যোক্তা পরিচালক ও বর্তমানে চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার নিজেই। ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার ধানমন্ডির পশ্চিম প্রান্তে রায়ের বাজার এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি হাসপাতাল, যা জেড এইচ সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এ মেডিকেলে কার্ডিয়াক কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার চালু হয়। ২০০০ সালের ১১ মে কার্ডিয়াক কেয়ার সেন্টারটি উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের অবহেলিত মহিলা জনগোষ্ঠীকে উন্নত সেবাদানের লক্ষে তিনি মহিলা মেডিকেল স্থাপন করেন। এর ফলে প্রতিবছর এখান থেকে প্রচুর মহিলা ডাক্তার সৃষ্টি হবে, সেজন্য গোটা জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০১১ সালের ১৮ জুলাই শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুরের মধুপুরে জয়নুল হক সিকদার নিজস্ব অর্থায়নে ১৮ বিঘা জমির ওপর জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি শুরু করেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- জেডএইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, পারভীন হক সিকদার প্রবীণ হিতৈষী নিবাস ও পারভীন হক সিকদার দুস্থ নিবাস।
জয়নুল হক সিকদারের আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কার্তিকপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মধুপুরে অবস্থিত মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ২০১৫-১৬ শিক্ষা বছরে সরকারি অনুমোদন পেয়ে ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেছে, জয়নুল হক সিকদার বলেন, আমি আমার এলাকার দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত তরুণ প্রজন্মের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করার জন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। অর্থ উপার্জনের জন্য আমি এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিনি। এখান থেকে আমি একটি পয়সাও গ্রহণ করব না। আমার একটাই আশা এখান থেকে যেন হতদরিদ্র গ্রামের সন্তানেরা সুশিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মত মানুষ হতে পারে।
জয়নুল হক সিকদার বাংলাদেশে তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় একাধিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তিনি এখন মুন্সিগঞ্জের নিমতলা, সিরাজদিখান, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, জামালপুর, নীলগিরি, খুলনা এবং কক্সবাজারের কাপ্তাইতে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুন্সিগঞ্জের নিমতলায় ৫০ বিঘা জমির ওপর ৫ লাখ বর্গফুট রুম স্পেস সম্বলিত ৬ তলা বিশিষ্ট জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় থ্রি স্টার মানের সিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলাস যাত্রা শুরু করে ১লা ডিসেম্বর ২০১৫। কাপ্তাইয়ে ৭০ বিঘা জমির ওপর হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের নির্মাণ কাজ চলছে। খুলনার মংলা বন্দরে ৬টি নতুন জেটির তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাওয়ার প্যাক হোল্ডিং লিমিটেড কোম্পানির নামে কেরানীগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট পাওয়ার স্টেশন রয়েছে।
এছাড়া এখানে ২০০ মেগা ওয়াট ও ১০০ মেগাওয়াট আরও দুটি পাওয়ার স্টেশনের কাজ চলছে। জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট একটি পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। নীলগিরিতেও ১০০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট একটি পাওয়ার স্টেশন রয়েছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের সংযোগ লাইনে যোগ হচ্ছে। সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক হোল্ডিং ঢাকা মাওয়া মহাসড়কের পাশে ৭ দশমিক ১১ একর জমিতে বিওও পদ্ধতিতে কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। সিকদার গ্রুপের আর এন্ড আর এভিয়েশন লিমিটেড বেসরকারি খাতে সফল এভিয়েশন কোম্পানি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এখানে এ পর্যন্ত ৭টি অত্যাধুনিক সুপরিসর হেলিকপ্টার ও একটি জেট বিমান যোগ হয়েছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে জরুরি পরিস্থিতিতে অনেকেই সুযোগ নিতে পারছেন।
সিকদার গ্রুপের প্রচেষ্টায় শরিয়তপুরের মধুপুর গ্রামে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নান্দনিক পরিবেশে একটি বিমানবন্দর ও পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি দেশের সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে আধুনিক বিমান প্রকৌশলী ও বৈমানিক সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। জয়নুল হক সিকদার প্রতিষ্ঠা করছেন তার পিতা মকফর উদ্দিন সিকদার ফাউন্ডেশনের অধিভুক্ত সিকদার এডুকেশনাল সাপোর্ট কমপ্লেক্স। এর আওতায় মেধাবী ছেলেমেয়েদের পারিবারিক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র নিঃস্ব মেধাবী ছেলেমেয়েদের ৪৮টি পরিবারের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ২৫০টি মেধাবী শিক্ষার্থীদের পরিবারের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। জয়নুল হক সিকদারের স্বপ্ন গোটা বিশ্বকে নিয়ে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তার ও তার পরিবারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে সুসম্পর্ক তৈরি হয়।
নেপালে ২০১৫ সালে ভূমিকম্পে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। জয়নুল হক সিকদার মেডিকেল টিম পাঠানোর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে নেপাল সরকার চিঠির মাধ্যমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। সামাজিক কর্মকাণ্ড ও জনহিতকর কাজে জয়নুল হক সিকদারের বর্ণনা শেষ করা যাবে না। জয়নুল হক সিকদারের একক অর্থায়নে নির্মিত প্রতিষ্ঠান সমূহ : জেড, এইচ. সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা। জেড এইচ. সিকদার ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, শরীয়তপুর, মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, শরীয়তপুর, গোলার মাঠ বায়তুল আমান জামে মসজিদ, নড়িয়া, শরীয়তপুর, কার্তিকপুর বাজার জামে মসজিদ, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর, কার্তিকপুর বাজার জামে মসজিদ, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর, শেখপাড়া জামে মসজিদ, মধুপুর, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর, পূর্ব দিনারা তালুকদার বাড়ি জামে মসজিদ, সুরেশ্বর জামে মসজিদ, গফুর মাওলানা জামে মসজিদ, কেদারপুর, কার্তিকপুর মধুপুর জামে মসজিদ, রামভদ্রপুর জামে মসজিদ, দক্ষিণ ডিঙ্গামানিক রহমানিয়া বাইতুস সালাম জামে মসজিদ, নড়িয়া, শরীয়তপুর, আল মদিনা জামে মসজিদ, ডিঙ্গামানিক, নড়িয়া, শরীয়তপুর, সুরেশ্বর দফাদার বাড়ি জামে মসজিদ, কবির শাহ্ মাজার, উমরা দক্ষিণ খান, ঢাকা।
জেড. এইচ. সিকদার মেডিকেল জামে মসজিদ, ঢাকা, চরভাগা জামে মসজিদ (এনামুল হক শামীমের বাড়ির সামনে), হাতেমবাগ জামে মসজিদ, বাবা গফুর আলী রেস্ট হাউজ, আজমির, আজমির শরিফ জান্নাতি গেট দরজা (খাজা বাবা), বঙ্গবন্ধু আদর্শ হাইস্কুল, চরভাগা, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর, মনোয়ারা সিকদার হাইস্কুল, ভেদরগঞ্জ, ডি এম খালি মনোয়ারা সিকদার হাইস্কুল, কোদালপুর আবদুর রাজ্জাক হাইস্কুল, মকফর উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ, রায়ের বাজার, ঢাকা, মকফর উদ্দিন জাতীয় আইন মহাবিদ্যালয় (ন্যাশনাল ল’ কলেজ), মধ্যদিনারা বাইতুল আমান জামে মসজিদ, নড়িয়া, শরীয়তপুর, দিনারা করনহুগলী বাইতুল আমান জামে মসজিদ, নড়িয়া, শরীয়তপুর, সোনাখোলা আল মদিনা নূরজামে মসজিদ, নড়িয়া, শরীয়তপুর, বেগম লুৎফুননেছা মহিলা মাদ্রাসা, মানুয়া, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর, ভোজেশ্বর জামে মসজিদ, শরীয়তপুর, বিঝারী বাজার জামে মসজিদ, শরীয়তপুর, ঘড়িষার বাজার জামে মসজিদ, ডা. মোসলেহ উদ্দিন জামে মসজিদ, খলিফা বাড়ি জামে মসজিদ, কারানহোগলা, চরভাগা জামে মসজিদ, শরীয়তপুর, কানার মসজিদ, শরীয়তপুর, নূর ই মদিনা নগর জামে মসজিদ (সিকদার মেডিকেলের পিছনে।, শামসুন্নাহার হাইস্কুল, রামভদ্রপুর শরীয়তপুর, মনোয়ারা সিকদার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভেদরগঞ্জ, রামভদ্রপুর দয়ালিয়া জামে মসজিদ, মুক্তারচর চুকদার বাড়ি জামে মসজিদ (নড়িয়া পশ্চিম পার্শ্ব), মিলিনিয়াম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সুইমিংপুল, জরিনা সিকদার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ, রায়ের বাজার, ঢাকা, জরিনা সিকদার প্রাইমারি অ্যান্ড হাইস্কুল, রায়ের বাজার, ঢাকা, মনোয়ার সিকদার রেস্ট হাউস, মধুপুর, শরীয়তপুর, জেড, এইচ. সিকদার এডুকেশনাল সাপোর্ট কমপ্লেক্স, মনিকা এস্টেট, ঢাকা, সুরেশ্বর সুফি মেহের উল্লাহ্ জামে মসজিদ, সুরেশ্বর, শরীয়তপুর, মিলিনিয়াম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, হাসপাতাল এরিয়া, পশ্চিম ধানমন্ডি, ঢাকা, শেখ পাড়া জামে মসজিদ, মধুরপুর, শরীয়তপুর, সিকদার অর্গানিক মার্কেট, রায়ের বাজার ঢাকা, বাবরি জামে মসজিদ, বেগম বিবি জামে মসজিদ, রামভদ্রপুর, শরীয়তপুর। চারআনা রাঢ়ী জামে মসজিদ, শরীয়তপুর, মহেশখালী দালালবাড়ি জামে মসজিদ, সরদারবাড়ি জামে মসজিদ, উত্তর রামভদ্রপুর, শরীয়তপুর, রামভদ্রপুর আকন্দবাড়ি জামে মসজিদ, রামভদ্রপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসা, শরীয়তপুর, তমিজ খাঁন জামে মসজিদ, জেড. এইচ. সিকদার শপিং কমপ্লেক্স, সিরাজদিখান, মুন্সিগঞ্জ, জেড. এইচ. সিকদার শপিং কমপ্লেক্স, নিমতলা, মুন্সিগঞ্জ। এছাড়া দেশে-বিদেশে আরো অনেকগুলো মসজিদ, মাদ্রাসা, মাজার, স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন।
জয়নুল হক সিকদার এখন ৮৬ বছর বয়সেও নিয়মিত অফিস করেন। তার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। সবাই এখন দেশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি জয়নুল হক সিকদারের কন্যা পারভীন হক সিকদার একান্ত সাক্ষাতকারে তাদের পারিবারিক সমাজসেবা মূলক উদ্যোগ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং নারীর এগিয়ে যাওয়াসহ সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে কথা বলেন।
প্রশ্ন: নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতিনিধি আপনারা আর নারীর থমকে যাওয়ার প্রতিনিধি সোনাগাজীর নুসরাতরা। নারী হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার এই প্রতিনিধি হওয়া কিভাবে সম্ভব হলো?
পারভীন হক সিকদার: নারীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশাল ভূমিকা আছে। নারীকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্যে তিনি কাজ করছেন। আমি প্রথমে নারী এন্টারপ্রেনার হিসেবে কাজ করেছি। বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের প্রথম ন্যাশনাল ব্যাংকের মহিলা চেয়ারম্যান বাংলাদেশে আমি প্রথম ছিলাম। সেই কাজ আমি আমার সততা ও নিষ্ঠার সাথে করতে পেরেছি আমি জানি। আর আমার রাজনীতি করার স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই ছিল কিন্তু কোন না কোন কারণে তা হয়ে ওঠে নাই। এখন আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রশ্ন: আপনি সংসদে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সকল নারীরা কি একই সুযোগ পাবে? তৃণমূলের নারীদের নিয়ে শীর্ষস্থানীয় নারীরা কি করছেন?
পারভীন হক সিকদার: আমরা তো চেষ্টা করছি। তৃণমূল থেকেই এখন নারীরা কিন্তু ভাল করছে। ক্রিকেট দেখুন- গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েরা কতো ভাল করছে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে।কোন ব্যাক আপ ছাড়াই নারীরা সমাজে উন্নতি করছে।চেষ্টা থাকলে কাউকে কোন কিছু থেকে দমিয়ে রাখা যায় না- এটা আমি মনে করি।
প্রশ্ন: আপনাকে কি কখনো দমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল?
পারভীন হক সিকদার: আমাকে দমানোর চেষ্টা করা হয়নি। কারণ আমার বাবা তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার সাপোর্ট ছিল বলে আমি এতো তাড়াতাড়ি উঠে আসতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন- তাই নারীরা আর পিছিয়ে থাকবেন বলে আমার মনে হয় না।
প্রশ্ন: সকলের বাবা তো জয়নুল হক সিকদার নয়- তাদের জন্যে কি বলবেন আপনি?
পারভীন হক সিকদার: কিন্তু আমাদের সকলের মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটাই আমাদের বড় পাওয়া। তার মনটা উদার সমুদ্রের মত। নারীদেরকে তিনি তৃণমূল থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন। তিনি যেহেতু আছেন এবং দেশ পরিচালনা করছেন। তাই আমার মনে হয় না। নারীরা আর পিছিয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: ব্যাংকগুলোতে আত্মীয়করণ হয়ে গেছে- বলা হয়। আপনি ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আর এখন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। এই দায়িত্ব কি আপনি বাবার কারণে পেয়েছেন নাকি নিজের যোগ্যতায়?
পারভীন হক সিকদার: কিছুটা বাবার কারণে আর কিছুটা নিজের যোগ্যতায়।
প্রশ্ন: কোনটা বেশি বাবার কারণ নাকি যোগ্যতা?
পারভীন হক সিকদার: দুইটাই আছে। কারণ আমি যোগ্য না হলে এতো বড় পদে কি একজনকে বসানো সম্ভব হয়? সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কাজ করার ক্ষমতা তো থাকতে হয়।
প্রশ্ন: সিকদার গ্রুপ তো অনেক বড়। এতো বড় প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শাখা আপনি দেখেন? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা কতোটা?
পারভীন হক সিকদার: আমি হসপিটাল এবং ব্যাংক এই দুইটাই মেইনলি দেখি। কনস্ট্রাকশন আর রিয়েল এস্টেটসহ অন্য সব সেক্টরে আমি ইনভলভ হই না। কারণ ওই সব সেক্টর আমি খুব ভাল বুঝি না।
প্রশ্ন: ব্যবসার মাধ্যমে রাজনীতিতে চলে আসলেন- কিভাবে সম্ভব হলো তা?
পারভীন হক সিকদার: ছোটবেলা থেকে রাজনীতিতে আসার শখ ছিল আমার। কোন কারণে এই জায়গায় আসা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্বপ্ন ছিল আমার। তাই দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তাই তার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: নিজের স্বপ্ন পূরণের সাথে সাথে নিজের এলাকার জনগণের স্বপ্ন কি পূরণ হবে?
পারভীন হক সিকদার: মানুষের স্বপ্ন পূরণ করতেই আমি রাজনীতিতে এসেছি। আমার নিজের চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তাই মানুষের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমি কাজ করতে এসেছি। মানুষের পাশে থাকতে চাই। শুধু শরিয়তপুরবাসী বলেই না? যতো গরীব মানুষ আছে সবার পাশেই আমি থাকতে চাই। আর্থিকভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে বা মেডিকেলের মাধ্যমে যেভাবেই হোক মানুষকে সহযোগিতা করতে চাই। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যেই আমার রাজনীতিতে আসা।
প্রশ্ন: শরীয়তপুরে এমপি আপনি। তাই আপনার স্বপ্ন কি শুধু শরীয়তপুরকে কেন্দ্র করে নাকি সারা বাংলাদেশ?
পারভীন হক সিকদার: আমি সারাদেশের জন্যেই কাজ করতে চাই- শুধু শরীয়তপুর না? শরীয়তপুর থেকে আমি এমপি হয়েছি। আমি সেখানকার মানুষের দেখভাল অবশ্যই করবো । কিন্তু সারা বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ বিশেষ করে নারীরা তাদের জন্যে কাজ করবো। যার যেখানে প্রয়োজন সবার পাশেই আমি থাকতে চাই। আমি নিজে একজন ডাক্তার। ডাক্তারি পড়াশোনার সময় থেকেই আমি চেয়েছি সেবা দিয়ে মানুষের পাশে থাকতে।
প্রশ্ন: সমসাময়িক সময়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে নানা বাধা আসছে। সম্প্রতি সোনাগাজীতে নুসরাত অমানবিক লালসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। একজন মানুষ হিসেবে এই সব ভুক্তভোগী মানুষের জন্যে কী করা উচিৎ?
পারভীন হক সিকদার: নুসরাতের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এর জন্যে সমবেদনা জানানোর আসলে কোন ভাষা নেই। নুসরাতের ঘটনাটি শোনামাত্রই আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই সুযোগ না দিয়েই নুসরাত চলে যায়। এই রকম বাধা নারীদের সামনে আসবেই। এইসব বাধা অতিক্রম করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নারী হয়ে জন্ম নিয়েছি আমরা তাই লড়াই আমাদেরকে চালিয়ে যেতেই হবে।
প্রশ্ন: সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ আপনাদের। নারীদের জন্যে আপনি আর কী কী কাজ করেছেন এবং করবেন?
পারভীন হক সিকদার: আমি নারীদের জন্যে অনেক কিছু করেছি এবং করছি। দুঃস্থ মহিলা, অটিজম স্কুল, বিধবা ভাতা, শিশু সহায়তা এবং বৃদ্ধদের নিয়ে ছোটবেলা থেকেই কাজ করছি। রিক্সাওয়ালা এবং হত দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের আমি আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে তাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছি। মেয়েদের ফ্রিতে ডাক্তার হিসেবে তৈরির জন্যে আমরা প্রতি বছর আর্থিক বিনিয়োগ করছি। সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ, মনোয়ার সিকদার মেডিকেল কলেজ এবং আমাদের ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে নারীদের শিক্ষিত করে তাদের এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। মেয়েদের বিনা পয়সায় আমরা পড়াশোনার সুযোগ করে দেই। যতো রকমের সহযোগিতা দরকার আমরা তা করে থাকি। নারীদের পাশে সবসময়ই আছি এবং থাকবো। বাংলাদেশ এখন যে জায়গায় চলে গেছে তাতে নারীদের আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: নারীদের নিয়ে আর কোন কোন জায়গায় কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
পারভীন হক সিকদার: আমাদের সবার আরও সচেতন হতে হবে। সবাইকে আরও ভাল মানুষ হতে হবে। এছাড়া সবাইকে আরও সততার সাথে নিজেদের কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন: ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজের সততার ক্ষেত্রে ভারসাম্য কিভাবে রাখেন?
পারভীন হক সিকদার: এই পর্যন্ত আমি যা করেছি সততার সাথেই করেছি। আমি ন্যাশনাল ব্যাংকের যখন চেয়ারপার্সন ছিলাম তখন সততার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছি। রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছি এবং সততার সাথে আমার দায়িত্ব পালন করবো। সততার সাথে কাজ করলে কেউ পিছিয়ে থাকে না। দেশকে ভালবাসলে এবং ভাল মানুষ হলে দেশের জন্যে যে কেউ কাজ করবেই।
প্রশ্ন: অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের আরও এগিয়ে নিতে কী করতে হবে?
পারভীন হক সিকদার: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নারীরা কোন দিকেই এখন পিছিয়ে নেই। নারীরা যেখানেই হাত দেয় সেখানেই সোনা ফলে। নারীরা ফুটবল, ক্রিকেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব ক্ষেত্রে ভাল করছে। এখন নারীদের রেজাল্ট দেখেন? ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা রেজাল্ট ভাল করছে। অটিজমের অনুষ্ঠানে দেখলাম- ছোট ছোট শিশুরা কি সাংঘাতিক ট্যালেন্ট ! তাই আমার মনে হয়- এই দেশে নারীদের আর কেউ পিছিয়ে রাখতে পারবে।
প্রশ্ন: নির্যাতিত নারীর পাশে আইন ঠিক মতো দাঁড়াচ্ছে কি না?
পারভীন হক সিকদার: আইন নির্যাতিত নারীর পাশে অবশ্যই দাঁড়াচ্ছে। তবে এই জায়গায় গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। মিডিয়া নির্যাতিত মানুষের পাশে থাকলে রাষ্ট্রের জন্যে এই কাজগুলো করা আরও সহজ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: অবশ্যই। মিডিয়া না থাকলে সোনাগাজীর এই ঘটনা সারা বাংলাদেশকে এই ভাবে সচেতন করে তুলতো না। তবে মিডিয়া তো শুধু তুলে ধরে। তাই দোষীদের শাস্তি দেওয়া তো আইনের কাজ। সেই কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি?
পারভীন হক সিকদার: হ্যাঁ। এই জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। ইনশাল্লাহ, আইনের শাসন এই দেশে প্রতিষ্ঠা তিনি করবেনই।
প্রশ্ন: নারীদের উদ্দেশে সব শেষ কী বলতে চান? তারা কি ভয় পেয়ে থেমে যাবে নাকি আরও শক্ত হয়ে এগিয়ে যাবে?
পারভীন হক সিকদার: নারী কখনো ভয় পায় না। নিজেরা নিজেদের মত এগিয়ে গেলে নারীর মুক্তি রুখতে পারে এমন শক্তি কারও নেই- এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।