আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস আজ। ১৯৯৩ সাল থেকে ‘বিশ্ব দারিদ্র্যবিমোচন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গঠনে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান ধ্বনিত হয় এদিনে।
১৮৯টি রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে ২০০০ সালে জাতিসংঘে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অবিলম্বে বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার ভয়ঙ্কর শিকার হয় দরিদ্র মানুষ। অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রধান সমস্যা হলো দারিদ্র্য।
বর্তমান বাংলাদেশে এখনো প্রায় ৪ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এদের মধ্যে প্রায় ২ কোটি লোক যারা রয়েছে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যে এমনটিই দেখা গেছে। তবে বিশ্বব্যাংক বলছে, হিসাব অনুযায়ী দৈনিক গড়ে ন্যূনতম ১ থেকে দেড় ডলার পর্যন্ত আয় হলে তাকে দারিদ্র্যের তালিকায় রাখা হয়।
বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসা-ব্যয়ের ৬২ শতাংশ নিজেই বহন করে। এই ব্যয় মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা দরিদ্র হয়ে পড়ে। আর যারা দরিদ্র, তারা নিঃস্ব হয়ে যায়। এ দেশে দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এই সমস্যা উত্তরণে সহজ পথ নেই।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি ১ শতাংশ বাড়লে আয় বাড়ে দশমিক ৮ শতাংশ। সেজন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হবে বলে অভিমত দেন তারা।
একজন ব্যক্তি তার অর্জিত আয় দিয়ে দৈনিক ন্যূনতম ২২শ’ ক্যালরি পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের সামর্থ্য থাকলে তাকে দারিদ্র্যমুক্ত বলা হয়। এর কম খাদ্য খেলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ১৮শ’ ক্যালরির কম হলে অতি দরিদ্রের তালিকায় বিবেচনা করা হয়।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কতিপয় সামাজিক সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা। বিশেষ করে নব্বই দশকের পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে অনন্য সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ।
২০১০ সালে এটি ছিল ৩১ দশমিক ৫ ভাগ। অন্যদিকে, ১৯৯২ সালে এ হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ ভাগ। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অবদান এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে “সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড” লাভ করেন।
এক জরিপে দেখা যায়, দারিদ্রের হার কমানোর ক্ষেত্রে ভারতকে টপকে গেছে বাংলাদেশ, নেপাল এবং রুয়ান্ডা। এই তিনটি দেশই আগামী ২০ বছরের মধ্যে দারিদ্র্য নির্মূল করতে পারবে যদি দারিদ্র্য বিমোচনে বর্তমান অগ্রগতি ধরে রাখা যায়।
জরিপে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে নেপাল, রুয়ান্ডা ও বাংলাদেশের সাফল্যের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়। এতে বলা হয়, ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচনে ভারতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল ও বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের গতি অনেক মন্থর।
নেপালে দারিদ্র্য বিমোচনের বার্ষিক হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ, রুয়ান্ডায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। সেখানে ভারতে এই হার মোটে ১ দশমিক ২ শতাংশ।
সমীক্ষায় ২২টি দেশের গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকে (এমপিআই) বাংলাদেশ, নেপাল ও রুয়ান্ডা দারিদ্র্য নিরসনে সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে আছে।
অক্সফোর্ড ‘পোভার্টি এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ (ওপিএইচআই) পরিচালিত এই জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সুশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সামাজিক বিনিয়োগের যুগপৎ কার্যকারিতায় নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ার পরও নেপাল ও বাংলাদেশ দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে সফল হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্র।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
দারিদ্র্য নিরসনে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে মনে করছে গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ। মানুষের আয় বেড়েছে; কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট করছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, দারিদ্র্য হ্রাসের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০১৩ এবং ২০২১ শেষে এই হার ২৭.৫ শতাংশ ও ১৭ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯১-৯২ সালে যেখানে ৫ কোটি ১৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার নিচে বসবাস করত সেখানে ২০০৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ৫ কোটি ৬০ লাখে দাঁড়িয়েছে।
দারিদ্র্য পরিমাপে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় দেশে প্রকৃত দারিদ্র্যের হার পরিমাপ করা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেছে উন্নয়ন অন্বেষণ।
একজন মানুষের দৈনিক আয় যদি এক ডলার হয়, তাহলে তাকে দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু এক বছর পর যদি তার আয় ১ দশমিক ৩ ডলার হয়, তাহলে তাকে দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। দারিদ্র্য পরিমাপের আরেকটি মাপকাঠি হলো মাথাপিছু প্রতিদিন ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব সাধারণভাবে তা গ্রহণ করতে খরচ হবে ৫০ টাকা (০.৭১ ডলার)। সেই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, যোগাযোগসহ অন্যান্য খরচও আছে, যা মাত্র ১ দশমিক ২৫ ডলার দ্বারা অনেকটাই অসম্ভব। ফলে ভোগব্যয়কে দারিদ্র্যের পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মনে করছে সংগঠনটি।
সরকার দারিদ্র্য নিরসনে পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য হ্রাসের হার সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, জনশক্তি রপ্তানিতে মন্দাভাব, প্রকৃত আয় কমে যাওয়াকে দায়ী করছে।
বিগত বছরের তুলনায় বর্তমানে দারিদ্র্যের গভীরতা এবং ব্যাপকতা হ্রাসের হার কম হওয়ায় বর্তমানে অসমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য রাষ্ট্রের সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার অভাব, সমান আয়ের কর্মসংস্থানের অভাব, বণ্টন ব্যবস্থার সমস্যা, তদারকির দুর্বলতা, নীতি কাঠামোর অভাব, সাংবিধানিক নীতির অনিশ্চয়তা এবং অধিক জনসংখ্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের যে সাফল্য এতে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা সঠিকভাবে এগিয়েছে। তবে এখনো এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দারিদ্র্য কমে আসায় আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র বিমোচন, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নসহ অধিকাংশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে সরকারের সার্বিক সফলতা কাম্য।