চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শুধু খেলার মাঠই সমাধান নয়

একটা খুব পপুলার কথা আমরা সব সময় শুনি যে, শিশু-কিশোররা প্রযুক্তিতে বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠছে এবং তারা খেলাধুলা করে না বলে জঙ্গিবাদের মতো ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াচ্ছে।

এ কারণে রাজধানী ঢাকায় পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকা এবং কোথাও কোনো মাঠ দখল হয়ে গেলে আমরা সচেতন নাগরিকেরা খুব আহা উহু করি। গণমাধ্যমে খবর হয়। টকশোতে ঝড় ওঠে।

প্রশ্ন হলো, যারা খেলাধুলা করে, তারা কি অপরাধে জড়ায় না?

গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিতণ্ডার জেরে খুন হয়েছেন এক তরুণ। তাকে খুন করেছেন যারা, তারাও বয়সে কিশোর-তরুণ। তারাও ক্রিকেট খেলেন। গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, রাজধানীর ফার্মগেটের গ্রিন সুপার মার্কেটের পেছনে রাকিবুল ইসলাম ওরফে মুন্না (১৮) নামের এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। চলতি বছরে তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ বলেছে, রাকিবুলকে ছুরিকাঘাতকারীরা বয়সে কিশোর।

গবেষকরা বলেন, একটি আদর্শ নগরীর বাসিন্দাদের জন্য নগরের মোট আয়তনের অন্তত ১০ শতাংশ জায়গা খোলা মাঠ বা পার্কের জন্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় খেলার মাঠ আছে মাত্র চার শতাংশ জায়গা। এমনকি এই স্বল্প জায়গাও এখন দখলদাররা গিলে খাচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এবং ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি)-এর হিসাবে, রাজধানীতে গড়ে দুই লাখ ৩০ হাজার ৭৬৯ জন মানুষের জন্য খেলার মাঠ আছে মাত্র ১টি। রাজধানীতে মাঠের অভাবে ছেলে-মেয়েরা সড়ক, গ্যারেজ বা বাসার নিচের সংকীর্ণ জায়গা অথবা ছাদে খেলাধুলা করে। দুই সিটি করপোরেশনে খেলার মাঠ রয়েছে ২৫টি। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই দখলে চলে গেছে।

অনেক মাঠ ব্যবহারের অনুপযোগী। খেলার মাঠগুলোতে নির্মাণ সামগ্রী রাখা, মেলার আয়োজন, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কনসার্ট, রাজনৈতিক কর্মসূচি এমনকি দৈনন্দিন বাজারও বসে।খেলার মাঠের বাইরে যেসব উন্মুক্ত স্থান বা খোলা জায়গা আছে, সেগুলোও খেলাধুলার উপযোগী থাকছে না। সেসব জায়গায় গড়ে উঠছে বস্তি। এসব কারণে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে শিশু-কিশোরদের খেলার সুযোগ । রোবটের মতো যান্ত্রিকভাবে তারা বেড়ে উঠছে ঘরের ভেতরে টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে, বারান্দায়, বড়জোর বাসার নিচের ছোট জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে। আসল খেলাধুলার সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় শিশু-কিশোরদের নির্ভরতা বাড়ছে প্রযুক্তির খেলা অর্থাৎ ভিডিও গেমসে। এমন তথ্যও বেরিয়ে আসছে যে, মারামারি ও যুদ্ধের ভিডিও গেমস খেলে খেলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে একধরনের সহিংস মনোভাব গড়ে উঠছে।

সম্প্রতি জার্মানির একটি শপিংমলে সন্ত্রাসী হামলার পরে এ ঘটনায় অভিযুক্ত তরুণের বাসা থেকে পুলিশ বেশকিছু জিনিস জব্দ করার পরে প্রমাণ পেয়েছে যে, ওই তরুণ যুদ্ধ বিষয়ক ভিডিও গেমসে আসক্ত ছিল। এসব কারণে বলা হয়, শিশু কিশোর ও তরুণদের সুস্থ বিনোদন, শরীর চর্চা এবং মানসিক বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। বলা হয়, খেলাধুলার সুযোগ পেলে কিশোর তরুণদের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?

ছোটবেলায় আমরা দেখেছি পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা নিয়ে কী ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হয়। আবাহনী মোহামেডান খেলা নিয়েও রক্তারক্তি কম হয়নি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা অন্য জায়গায়। সমস্যা তার বোধে, তার বেড়ে ওঠায়। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা এবং নিরোগ শরীর নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য খেলার মাঠ যেমন আবশ্যক, তেমনি এটিও দেখা দরকার, শিশু-কিশোরদের জন্য আমরা কী ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। তারা কী ধরনের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে। মূল্যবোধের কোন স্তর তারা দেখছে বাবা মায়ের। তাদের সামনে কেমন ভবিষ্যৎ আমরা তৈরি করে দিচ্ছি।

খেলার মাঠ গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু একটি শিশু কীভাবে বেড়ে উঠছে, পরিবার তাকে কী শেখাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে কী শিখছে, কারা তার শিক্ষক, সেই শিক্ষকের কী যোগ্যতা, শিক্ষক হিসেবে সে কতটা আপ টু দ্য মার্ক, বাইরের দুনিয়ায় শিশু কী দেখছে, টেলিভিশনে কী দেখছে, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে সে কী করছে, শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়ে সে কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে, কাদের সাথে খেলছে, খেলার ছলে আসলে সে কোনো চরমপন্থী রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সাথে মিশে যাচ্ছে কি না, স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় তার পড়াশোনার বাইরের জগতটা কেমন-এসব ব্যাপার আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও সব বিষয়ে অভিভাবকের খোঁজ রাখা সম্ভবও হয় না। যে বাবা ঘুষ খায়, যে বাবা মানুষ ঠকায়, যে বাবা জনগণের পয়সা চুরি করে, যে বাবা নিজেই অসৎ-সে তার সন্তানকে ভালো হবার শিক্ষা দেবে কীভাবে? যে মা বাবা মিথ্যার ভেতরে বসবাস করে, তারা কী করে তার সন্তানকে সততার কথা বলবে? সুতরাং খেলাধুলা আর শরীর চর্চাই সমাধান নয়। সমস্যা আরও গভীরে। সমস্যা আমাদের মগজে। আমাদের মননে। আমাদের সামগ্রিক জীবনচর্চায়। খেলাধুলা তার খুবই ছোট্ট একটি অধ্যায় মাত্র।

আমাদের খেলার মাঠ প্রয়োজন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারও চেয়ে বেশি জরুরি মানুষ হিসেবে আগে অভিভাবকের তৈরি হওয়া। আপনি নিজে দুই নম্বরি করবেন, অথচ আপনার সন্তান ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে-এটি প্রত্যাশা করা অন্যায় এবং হাস্যকর।

তখন আপনার সন্তান পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করবে, খেলাধুলা করে শরীর ঠিক রাখবে-আবার সতীর্থের পিঠে ছুরিও মারবে। সে বড় চাকরি করবে। অনেক পয়সা কামাবে। বাড়িগাড়ি বানাবে। জীবনের সফলতার সব ধাপই অতিক্রম করবে। কিন্তু মানুষ হবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)