গত কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষাগত সাফল্যের খবর। জিপিএ ফাইভ আর গোল্ডন জিপিএ প্রাপ্ত সন্তানদের জন্য পিতামাতার গর্বের শেষ নেই। ফুলের মতো ফুটফুটে শিশুরা সব আমাদের ভবিষ্যতের শুভবার্তা জানান দিচ্ছে তার সাফল্যের মধ্য দিয়ে। এই গর্ব বড় স্বাভাবিক, প্রত্যেক মানুষের জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য একসময় সন্তানের জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। মানুষ সন্তানের মধ্যেই নিজের ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করে। এর বাইরেও সচেতন পিতামাতা সন্তানকে শিক্ষিত সুনাগরিক গড়ার প্রশ্নে নিজেদের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করেন।
একেকটি পরীক্ষায় সাফল্য সেই চেষ্টারই ফসল। আজকের দিনে সন্তানের সঙ্গে বাবা মা অনেক বেশি নিবিড়। সন্তান পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ কর্মজীবন কিংবা সংসার জীবনে প্রবেশের আগ পর্যন্ত পিতামাতার সম্পৃক্তি থাকে ছায়ার মতো। বিশেষ করে শহর নগরে। সন্তানের পড়াশোনার যাবতীয় চাপ ও দায়িত্বের অনেকটা বহন করেন পিতামাতা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তানের পড়াশোনা নিছকই বিনিয়োগ। সন্তানকে গড়ে তুলে ভালো কর্মের সন্ধান পর্যন্ত পৌছে দেয়া পর্যন্ত পিতামাতার দায়িত্ব থেকে বিরতি নেই।
এই দায়িত্ব পালনের সামনে পেছনে বহু সংকট ও আখ্যানের জন্ম হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য হালের বলদ, ভিটেমাটি বিক্রি, নানা শর্তে ধার কর্য্যসহ অনেক ঘটনা থাকে। কখনো কখনো পারিবারিক অনটনে মধ্যপথে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার অগণিত ঘটনা আছে। এই বিষয়টিতে বলা হয় ঝরে পড়া। বৃন্তচ্যুত হয়ে পড়া। আমাদের দেশে বড় একটি অংশের ঝরে পড়া রয়েছে প্রাথমিক শ্রেণিতে। এই ঝরে পড়াকে বলা হয় অংকুরেই ঝরে পড়া। এই বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি সংস্থার অনেক বাণিজ্যিক প্রকল্প রয়েছে।
প্রতি বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। ফল আমরা কুড়াই। যে ফলগুলো পাকা তার হিসাব আমরা রাখি। কিন্তু কোন ফল কৃত্রিমভাবে পাকানো আর কোন ফল গাছের গোড়ায় অযত্নে অবহেলায় শুকিয়ে পড়ে যায় তার হিসাব কি রাখা হয়?
শুকনো ও পুষ্টির অভাবে গাছ থেকে ঝরে পড়া ফলগুলো একটু হাতে নিয়ে দেখা দরকার আছে। আমার ধারণা পিএসসি পরীক্ষার প্রবর্তনটা সেই লক্ষ্য থেকেই। প্রশ্ন হলো, শিশুদের অকৃতকার্য করিয়ে আমরা কোন ফায়দা হাসিল করতে চাই? এবছর পিএসসি ও এবতেদায়ী মাদ্রাসায় অকৃতকার্যের হার এক দশমিক ৪৮ ভাগ। সর্মমোট পরীক্ষার্থী ছিল ৩২ লাখ ৫৪ হাজার ৫শ ১৪ জন। এর মধ্যে অকৃতকার্যের সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার। সারাদেশে এই ৪৮ হাজার শিশু কারা? কে তাদের বাবা মা, কে তাদের শিক্ষক?
বাবা মাকে খুঁজে বের করতে গেলে হয়তো হতাশ হতে হবে। বাবা মা সন্তানের মুখে দু মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা দিতেই হিমশিম খান। অনেকের বাবা মা নেই। অনেকের থেকেও নেই। অনেক বিলাসী ও উদাসীন বাবা মাও রয়েছেন, যারা সন্তানের প্রতি অমনোযোগী। তারাও দায় এড়িয়ে যেতে পারেন কিন্তু শিক্ষকরা কি পারেন দায় এড়িয়ে যেতে? তারা প্রতি বছর হাজার হাজার শিশুর জিপিএ ফাইভ পাওয়ার পেছনে অবদান রাখেন। গর্বে গদগদ হয়ে যান। কিন্তু হাজার হাজার শিশুর অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে তাদের দায়টুকু নিয়ে তারা কি অনুতপ্ত হন?
শিশুরা কেন অকৃতকার্য হবে? এ কেমন নিয়ম? শিশুরা কি নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে পারে? তারা তো শিক্ষক শিক্ষিকা আর বাবা মাকেই অনুসরণ করে। তারা কি বোঝে পরীক্ষার চাপ? কিন্তু অসহ্য চাপ তাদের সইতে হয়। পিতামাতার প্রতিযোগিতামুখী চিন্তার ভারটুকু বয়ে বেড়াতে হয় কোমলমতি শিশুদের।
অনেক আগে থেকেই আলোচিত হচ্ছিল শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের ব্যাগের ওজন নিয়ে। আদালতের আদেশ, বছরের পর বছর ধরে শিক্ষার্থী অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের প্রতিবাদ উদ্বেগের পর মাস তিনেক আগে মানে গত বছর অক্টোবরে শিশু শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সরকারি অনুমোদনহীন যেকোন বই ও শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর বিষয়ে সতর্ক করে আদেশ জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। আদেশে বলা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক শিশুদের জন্য যেসব বই অনুমোদন করেছে তা পরিবহনে কোন ছেলে-মেয়েদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যেসব ছাত্রছাত্রী ব্যাগে বই বহন করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী এর ওজন যাতে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এটি ছিল বাহ্যিক একটি বিষয়। অর্থাৎ শিশু যে বোঝা বাহ্যিকভাবে কাঁধে বইছে তার ওজন কমানোর চিন্তা করা হয়েছে, কিন্তু শিশু মনের ভেতর যে চাপ বহন করছে তার ওজন কমানোর চিন্তা তো করা হচ্ছেই না বরং ‘অকৃতকার্য’ হওয়ার দায় চাপিয়ে তার জীবনীশক্তিকে অংকুরেই ঝরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেউ কি কখনো চিন্তা করে দেখেছেন, শিশু কেন ফেল করবে? তাদের কোনো ব্যর্থতায় দায় কি তাদের কাঁধে চাপানো যায়? বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুর আবার ব্যর্থতা কিসের তার জীবনে সবই তো সফলতা হওয়ার কথা। একটি সুন্দর পরিবেশ রচনা করতে পারলে, একটু দেখিয়ে দিলেই যে মাথা লাখ কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিমান স্মরণশক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎ চমক দেখাতে পারে, তাকেই করছি অকৃতকার্য। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু নেই।
মানা যায়, পাস আর ফেল হাত ধরাধরি করে চলে। কেউ পাস করলে কেউ ফেল করবে এটিই স্বাভাবিক। এমন ব্যবস্থা কেন প্রবর্তন করা যায় না, যেখানে সব শিশু সমান শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কেউ গোল্ডেন জিপিএ যেমন পাবে না, কেউ অকৃতকার্যও হবে না। সব শিশুই তো গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার যোগ্য। যে শিশু পায় না তার দায় তো এক অর্থে সরকারের ওপরও বর্তায়। ওই শিশুর তো প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে, সে কেন ভালো ফল করতে পারেনি? সে কেন অকৃতকার্য হয়েছে? বা সে কেন গোল্ডেন জিপিএ পায়নি? শিক্ষক বলবে, পড়াশোনা করেনি তাই ভালো ফলাফল করেনি। শিশু কীভাবে পড়াশোনা করবে? সে তো কারো না কারো দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। যদি সে স্বাধীন হয়, তাহলে তো সে জীবন থেকেই ঝরে যায়।
শিশুর অকৃতকার্য হওয়া বা পরীক্ষায় ফেল করাকে শিক্ষক যেমন ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেন একইভাবে পরিবারও বিষয়টিকে দেখে অপরাধ হিসেবে। পরীক্ষায় পাস করতে না পারাটা তার অন্যায় হয়েছে। এর জন্য কোনো কোনো পরিবারে শিশুকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যাদের পিতামাতা নেই তাদেরকে অপরাধী গণ্য করে শিক্ষকরা। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডবিধির ৮৩ ধারা অনুযায়ী ৭ বছরের বেশি এবং ১২ বছরের কম শিশুর দ্বারা কৃত কোনোকিছুই অপরাধ বলে গণ্য হবে না যে ক্ষেত্রে উক্ত অপরাধের ব্যাপারে শিশুর বোধশক্তি এতদুর পরিপক্কতা লাভ করে নাই সে স্বীয় আচরণের প্রকৃতি ও পরিণতি বিচার করতে পারে। উপরন্তু যে শিশু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলো, সে তার শিক্ষার অধিকার পুরোপুরি না পাওয়ার বিষয়ে শিক্ষককে দায়ী করতে পারে, সরকারকেও দায়ী করতে বাধা নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)