বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বইয়ের গন্ধ কি এখনকার ছেলে-মেয়েরা নেয়? নতুন বই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত ভুল করেও উল্টায়? বিশেষ করে বাংলা বইয়ের গল্প বা কবিতাগুলো পড়ে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক অভিভাবকও বিব্রতবোধ করবেন। কারণ তারা জানেন আজকাল ছেলে-মেয়েরা ক্লাসের পাঠ্যবই কখনো বছরের শুরুতে পাওয়ার পর নেড়েচেড়ে দেখে না। খোদ অভিভাবকেরাও ছেলে-মেয়েদের ওই বই উল্টাতে বলেন না। অথচ তারা যখন ছোট ছিলেন তখন নতুন বইয়ের গন্ধ নিতেন। বাংলা বইয়ের সবগুলো গল্প কবিতা পড়ে ফেলতেন এক বসায়।
এখন অভিভাবকদের অত সময় কই? ছেলে-মেয়েরা বছর শেষ হতে রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই নতুন ক্লাসে ওঠার পর কার কাছে প্রাইভেট পড়বে, সেই চিন্তায় থাকে। বাবা-মায়েরাও চিন্তায় পড়ে যায়, কোথায় পড়ালে সন্তান জিপিএ-৫ পাবে, গোল্ডেন এ পাবে। ক্লাসে বই পাওয়ার আগে, ক্লাস শুরুর আগে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দেয়।
পাঠ্যবই পড়ার সময় কই তাদের? কোচিং থেকে নোট সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি কোচিং এর শিক্ষকেরা বলে দেয় অমুক প্রকাশনীর গাইড বই কিনে ফেল। ওটাতে ভালভাবে লেখা হয়েছে। এই যে অমুক প্রকাশনীর গাইড বই ভাল, এই বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রকাশনা সংস্থা প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন হাই স্কুল ও কলেজে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের উপঢৌকন দিয়ে আসে। পাশাপাশি কোচিংএর শিক্ষকেরাও ওই উপঢৌকন পেয়ে থাকে। তাই গাইড বইয়ের বিজ্ঞাপনে নেমে যায় মানুষ গড়ার কারিগর নামের এইসব শিক্ষক!
আমাদের অভিভাবকদেরও খানিকটা গাফিলতি রয়েছে। তারা কেন ছেলে-মেয়েদের পাঠ্যবই পড়ার ব্যাপারে তাগিদ দেন না। তারাও শিক্ষকদের কথামত গাইড বই আর সহায়ক বই কিনে দেন হাজার হাজার টাকার। আর ছেলে-মেয়েরা বুঝে না বুঝে সেই গাইড বই মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ছেড়ে আসে। নিজের ভেতরে সৃজনশীলতার বীজ রোপন করার মত ফুসরত তাদের নেই। তারা কোনো কিছু ভাবে না। তাদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই। যে শিক্ষকদের ক্লাসে সব বোঝানোর কথা, তা না করে তাদের প্রাইভেট পড়তে কেন উদ্ধুদ্ধ করছে? এসব ভাবার সময় নেই তাদের। কারণ দুপুরে এই শিক্ষক, বিকেলে ওই শিক্ষক করতে করতে দিন পার হয়ে যায়। রাতে আবার ক্লাসের পড়া তৈরি করতে হয়। তারপর রয়েছে কোচিং এর পরীক্ষা, কোনটা রেখে কোনটা করবে, দিশেহারা হয়ে যায়। মাথায় কোনো কিছু কাজ করে না। অনেকটা রোবটের মত জীবন চলে যেন শিক্ষার্থীদের।
আর এইসব কিছুর মূলে হচ্ছেন ক্লাসের শিক্ষক। তারা যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকমত পালন করেন ক্লাসে, তা হলে ছেলে-মেয়েদের আর কোচিং করার জন্য অযথা সময় নষ্ট করতে হয় না। মায়েদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। তারা যদি ক্লাসে এভাবে ছেলে-মেয়েদের বলে দেয়, ‘তোমরা তোমাদের বাংলা পাঠ্যবইয়ের ওই গল্পটা কাল পড়ে আসবা। ক্লাসে আমি তোমাদের পরীক্ষা নিব। কি প্রশ্ন হবে তা আমি কাল ক্লাসে এসেই তাৎক্ষণিকভাবে বলব। দেখি তোমরা কে কিভাবে লেখো?’ তা হলেই ছেলে-মেয়েদের ভেতরে নিজের থেকে লেখার আগ্রহ বা অভ্যাসটা তৈরি হবে। নোট বইয়ের প্রতি মুখাপেক্ষি হয়ে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। তা না হলে ওই কোচিং নির্ভর শিক্ষাই আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রকৃত শিক্ষার বারোটা বাজাবে।
সম্প্রতি জানা যাচ্ছে কোচিং-প্রাইভেট, নোট-গাইড ও সহায়ক বই নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এসব অপরাধে কেউ জড়িত থাকলে জেল-জরিমানা বা চাকরিচ্যুত করা হবে।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হওয়ার পরে ২০১১ সালের শুরুতে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করার জন্য কমিটি গঠন করা হয়। তারপর শুধু আলোচনা হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
যাক, আশার কথা হচ্ছে সেই আইনটি খুব শিগগিরই আলোর মুখ দেখছে। কিন্তু এই আশার কথার পাশাপাশি সরকারকে এটাও ভাবতে হবে, যারা ক্লাসে পাঠদান করবেন, সেই শিক্ষকদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, তাদেরকে সরকারের তরফ থেকে বেতন দেওয়া হয় শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। ক্লাসে না বুঝিয়ে কোচিংএ যেতে উৎসাহি করার জন্য নয়। কিংবা তার কাছে যাতে প্রাইভেট পড়ে এই আশায় ক্লাসে ফাঁকি দেওয়াও চলবে না। আর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে। যাতে তারা নিজের থেকে যে কোনো ধরনের প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারে। কারণ বাজারে আর গাইড বই পাওয়া যাবে না। কোচিংও করা যাবে না। এটা ভালমত বোঝাতে পারলে সরকারের এই আইনের যে উদ্দেশ্য তা পরিপূর্ণতা লাভ করবে। আর তা না হলে শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতে চ্যালেঞ্জটি শিক্ষকেরাই নিতে পারেন।
সরকারকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে গাইড বই-নোট বইয়ের প্রকাশকদের এবং কোচিং-বাণিজ্য করা ব্যক্তিদের। যারা শিক্ষাকে পণ্য করে কামিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। আর আমাদের অভিভাবকদের মনে করা দরকার তারা যখন পড়াশোনা করেছেন তখন কজন শিক্ষকের কাছে তারা দৌড়াতেন? নিজেরাই পাঠ্যবই পড়ে নোট তৈরি করে পরীক্ষা দিয়েছেন। তখন আজকের মত গাইড বই বা সহায়ক বই ছিল না। তারা তো খারাপ রেজাল্ট করেননি। তারা যদি পারেন, তা হলে তাদের ছেলে-মেয়েদের সেই চর্চা করাতে দোষ কোথায়? শুধু প্রয়োজন নিজেদের একটু সজাগ দৃষ্টি আর দায়িত্বশীল হওয়া।
আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষকেরা কি একটু যত্নবান হতে পারেন না? অভিভাককেরা একটু দায়িত্ববান হতে পারেন না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)