দেশ এখন শিক্ষা বিষয়ক লোকদের নানা কর্মসূচি ও বক্তব্যে বেশ টালমাটাল। অনলাইন, অফলাইন দু’ভাবেই মানুষের আলোচনার খোরাক হয়েছে তারা।
২৩ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হল সারাদেশ হতে আগত সহকারী শিক্ষকদের আমরণ অনশন কর্মসূচি। তাদের অভিযোগ তারা বেতন বৈষম্যের শিকার। প্রধান শিক্ষকদের সাথে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য চার ধাপ। তাদের দাবি একধাপ নিচে রাখতে হবে।
পরদিন ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের এই আন্দোলন মুখর সময়েই শিক্ষাভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের সহনীয় ভাবে ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি আরও বললেন,খালি যে অফিসাররা ‘চোর’ তা নয়।মন্ত্রীরাও ‘চোর’ আমিও ‘চোর’।
এরই মাঝে ২৬ ডিসেম্বর এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরাও আন্দোলনে নামল। এখন শুনছি প্রধান শিক্ষকরাও সংগঠিত হচ্ছে।
সহকারী শিক্ষকদের আমরণ অনশন স্থগিত হয়ে গেল শিক্ষক নেতাদের বিভাজনে। ২৫ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান ফিজারের নিকট হতে পানি খেয়ে অনশন ভাঙল এক পক্ষ। অন্য পক্ষ শ্লোগান দিলো :অনশন ভাঙি নাই-ভুঁয়া নেতা মানি না/দালালের কাল হাত -ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও/আমাদের আন্দোলন চলছে,চলবেই। এর পরদিন ২৬ ডিসেম্বর আন্দোলন শুরু করল নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা।
সরকারের শেষ বছরে শিক্ষা বিভাগ একযোগে এমন টালমাটাল হয়ে উঠল কেন? তারা কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়ে সাড়া না পেয়ে রাজপথে নেমেছেন? তবে কি শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যর্থ?
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশনকারী শিক্ষকদের এমন কথাও বলতে শোনা গেছে তারা বলেছেন,আমরা বেতন চাই না। প্রধানমন্ত্রী এসে আমাদের দেখে যাক। এতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে তাদের বিভাগীয় মন্ত্রীর উপর কোন আস্থা ও নির্ভরতা নেই? শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান যদি প্রধান মন্ত্রীকেই করতে হয় তাহলে দু’দুটো মন্ত্রণালয়ের কী দরকার?
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের ‘চোরতত্ত্ব’ ও ‘ঘুষতত্ত্ব’ গোটা মন্ত্রীসভা ও সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তার এই বক্তব্যে মন্ত্রীসভার সদস্যদের মাঝেও দেখা দিয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। তার এই চোর তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রী পাগলের প্রলাপ বকেছেন,তিনি ‘চোর ‘ হতে পারেন আমরা কোন মন্ত্রী ‘চোর’ নই। বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
দুজনই মন্ত্রীর একজন নিজেদর ‘চোর’ অপরজন কেউ নন, বলে যে দাবি করলেন.. মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে? শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ কি কথাটা বেফাঁস বলেছেন নাকি সত্যকথন হিসাবে বলেছেন? বিষয়টি ভাবাচ্ছে সবাইকে। শিক্ষামন্ত্রীর এধরণের বক্তব্যে, তার মন্ত্রী পদে থাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ১ সাজ্জাদুল হাসানের উদ্যোগে আয়োজিত এক পাইলটিয়ান পুনর্মিলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। এতে তিনি বলেন,বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে আমরা প্রজন্মকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারবো।আমাদের বিশ্বমানের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।নতুন প্রজন্মের মেধা বিকশিত করতে হবে। তার বক্তব্য অনুসারে সেই বিশ্বমানের শিক্ষায় ঘুষের মাত্রাটা কী হবে?জাতীয় মানের শিক্ষায় যদি’ সহনশীল ঘুষ’তত্ত্ব থাকে তাহলে বিশ্বমানের শিক্ষায় কোন তত্ত্ব হাজির হবে?এই পুনর্মিলনতে আরও বক্তব্য রাখেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করার আহবান জানান। তিনি উপস্থিত শিক্ষা মন্ত্রী কে উদ্দেশ্য করে বলেন,আপনি প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক। প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে হবে।সংবিধানের মূল মন্ত্র ছাত্রদের বুঝাতে হবে।ভারতে ছাত্রছাত্রীদের সংবিধান শেখানো হয়।বছরে একদিন সংবিধানের উপর ক্লাস নেয়া যেতে পারে।সবাইকে নিজের ভুলগুলো বুঝে নিজেকে আদর্শিক মানুষ হওয়ার আহবান জানান তিনি। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ স্বীকার করেন, শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে আমার অনেক ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতা রয়েছে।’এই ত্রুটি ও ব্যর্থতার দায় শিক্ষামন্ত্রীর আর এর ভুক্তভোগী হয় পুরো জাতি। তাই নয় কি?শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ শিক্ষার মৌলিক অধিকার, ছাত্রদের সংবিধান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতির উপর কথা না বলে তিনি বলেন, চলতি অর্থ বছরে আমরা এই বিদ্যালয়কে দশতলা বিল্ডিং করে নেব।একজন শিক্ষামন্ত্রীর যদি প্রতিশ্রুতির কথা বলে জনতার করতালি পাওয়াই মুখ্য আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ সহজেই অনুমেয়।
এই পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড.সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।তিনি বলেন,শিক্ষামন্ত্রীর অনেক চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তার মিল রয়েছে।পাঠ্যপুস্তক কমিটিতে তিনি আমাকে রেখেছিলেন।তবে কি পাঠ্য পুস্তকের ভুলগুলোও মন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করেই করেছেন? প্রশ্নপত্রে ভুলের দায়ে দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করে অথচ আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তকে ভুল করেও শিক্ষামন্ত্রী ও পাঠ্যপুস্তক কমিটির শিক্ষাবিদগণ বহাল তবিয়তে থাকেন!এই অনুষ্ঠানেই কেউ কেউ শিক্ষামন্ত্রীকে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক ও সফল শিক্ষামন্ত্রী বলে অভিহিত করেছেন। তারা শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আপনি প্রধান মন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়ন করছেন।’ অথচ শিক্ষামন্ত্রীর লাগাতার ত্রুটি,ব্যর্থতা ও বেফাঁস কথাবার্তায় প্রশ্ন বিদ্ধ হচ্ছে গোটা মন্ত্রীসভা।এতে কি প্রধান মন্ত্রী প্রশ্নবিদ্ধ হননি? শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে দেখিয়ে বলেন,আমি উনাদের পরামর্শেই চলি। তাহলে শিক্ষাবিদগণ কী পরামর্শ দিলেন মন্ত্রীকে? সহনশীল ঘুষ তত্ত্বটাও কি তাদেরই পরামর্শ?নাকি ক্ষমতা ও নিজ নিজ কর্তৃত্ব ধরে রাখতে একজন আরেকজনের পক্ষে কথা বলার মিশনে নেমেছে সবাই?কিন্তু জনগন কী ভাবছে?
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ শুধু নিজের মন্ত্রণালয়কেই ঘুষখোর বলেন নি অন্যদেরও বলেছেন। তিনি সেটাকে ‘সহনশীল ঘুষতত্ত্ব’ দিয়ে পরিবর্তন করতে চান। তিনি তার বক্তব্যের আত্মপক্ষ সমর্থনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনেক শিক্ষক এসে আমার কাছে কান্নাকাটি করে বলতেন,আমরা নিম্ন বেতনে চাকরি করি,এত টাকা আমরা কোথা থেকে দেব।এক মাসের বেতন সম্পূর্ণ টাকা ঘুষ দিলে পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা খাব কী করে?ঘুষের মাত্রা আরেকটু সহনীয় হলেও বাঁচতাম বলে তারা মন্তব্য করতেন।এটা শিক্ষকদের কথা।’ শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের এই টক অব দি কান্ট্রি বক্তব্যের সূত্র ধরে সিরাজগঞ্জের সেই ধর্ষিতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিশোরীর মায়ের কথা মনে পড়ল। মায়ের সামনে গণধর্ষনের শিকার কিশোরীর অসহায় মা ধর্ষকদের অনুরুধ করেছিল,বাবারা আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একটু রয়েসয়ে একজন একজন করে যাও।’ অসহায় মা একথা বলেছিলেন এজন্য যে ধর্ষকরা ছিল প্রবল শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তার ছিল না। তবে কি বাংলাদেশেও ঘুষখোররা অপ্রতিরোধ্য প্রবল হয়ে উঠেছে? তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়েছে খোদ সরকার? তাই ধর্ষিতা কিশোরীর মায়ের মত সরকারকেই বলতে হচ্ছে, বাবারা রয়েসয়ে ঘুষ খেয়ো!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)