‘রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে গেলেন ভিসি’ অথবা ‘পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়লেন গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য’ কিংবা ‘ভিসির পদত্যাগে ক্যাম্পাসে উল্লাস’ এরকম লজ্জাজনক সংবাদ শিরোনামও আমাদের পড়তে হয়।
একজন ভিসি একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সমাজের আর দশটি পেশার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মানুষ একটু বাড়তি সম্মান করে, সমীহ করে, শ্রদ্ধা করে। সেই সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্রদের নিয়ে এমন সংবাদ শিরোনাম কি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত? একজন ভিসি পদত্যাগ করবেন এবং সেই আনন্দে তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে উল্লাস করবে, মিষ্টি বিতরণ করবে, এটি ওই শিক্ষকের জন্য শুধু ভয়াবহ লজ্জারই নয়, বরং তিনি সারা জীবন যা পড়লেন, যা শিখলেন এবং ছাত্রছাত্রীদের যা শেখালেন, তার সবই কি এতে ব্যর্থ হয়ে যায় না?
যে শিক্ষক শব্দটির আগে ‘আদর্শবান’ কথাটি যুক্ত হয়, তারাই নিয়মিত বিরতিতে এরকম খারাপ খবরের শিরোনাম হবেন কেন? কেন তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের তদন্ত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে? এই কেনর উত্তর জানতে হলে আমাদের এই প্রশ্নটি করতে হয় যে, একজন ব্যক্তি কী করে এবং কোন কোন যোগ্যতায় শিক্ষক হয়ে ওঠেন এবং এ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াচ্ছেন, তাদের কতজন আসলে ‘শিক্ষক’।
একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন বলেই কি তিনি শিক্ষক? তিনি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হন এবং ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় পাসের জন্য পরামর্শ দেন, এ কারণেই কি তিনি শিক্ষক? তিনি প্রত্যেক দিন ঘড়ি ধরে আসেন, ঘড়ি ধরে ক্লাস নেন এবং ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যান বলেই কি তিনি শিক্ষক?
না, তিনি শিক্ষক এ কারণে যে, তিনি যতক্ষণ তার শিক্ষার্থীদের সাথে থাকেন, ততক্ষণ তিনি আলোর পথ দেখান। ছাত্রছাত্রীদেরকে তিনি জানিয়ে দেন আলোর মাঝেও বিদঘুটে অন্ধকার বিরাজ করে। শিক্ষক সেই আলো-অন্ধকারের ভেদ বুঝিয়ে দেন। তাকে সত্যের পথ দেখান এবং মিথ্যাকে চেনান। তিনি তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেন না। এ কারণে তিনি শিক্ষক। এখন আপনি আপনার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন, কতজন শিক্ষক আছেন।
প্রসঙ্গত আমাদের এই প্রশ্নেরও উত্তর জানতে হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ আসলে কী? যে প্রশ্নটি সম্প্রতি ফেসবুকে উত্থাপন করে ঝড় তুলেছিলেন গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী।
পণ্ডিতরা বলেন, স্কুলে পড়ানো হয়; কলেজে লোকে পড়ে; আর বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান তৈরি করে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পুরাতন জ্ঞান বিশুদ্ধ করা এবং নতুন জ্ঞান তৈরি করা। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী জ্ঞান তৈরি করছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বড় কাজ মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো। এখন যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো না করে, যদি তারা পুরাতন জ্ঞান বিশুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয় এবং সেই চেষ্টাটাও না করে, যদি সেখানে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানোর কোনো আয়োজন না থাকে, বরং উল্টো মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করার আয়োজন খোদ শিক্ষকরাই করেন, তাহলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওই ব্যক্তিদের আদৌ শিক্ষক বলা যাবে কি না? যদি না যায় তাহলে তো ভিসিরা পালিয়ে যাবেনই। তারা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়বেন এবং সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা তাদের অপসারণের দাবিতে রাস্তায় নামবেন এবং তারা পালিয়ে গেলে আনন্দে উল্লাস করবেন, এটিই স্বাভাবিক।
দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এরকম আন্দোলনের মুখে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একেএম নুরুন নবি। যিনি কোষাধ্যক্ষসহ একইসঙ্গে ১৪টি পদে একাই দায়িত্ব পালন করতেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি।
নানা অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বাধা দিয়েছিলেন এবং পদে থাকাকালীন তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেননি বলেও অভিযোগ ওঠে।এছাড়া শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে বিতর্কিত হওয়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এসএম ইমামুল হককেও আন্দোলনের মুখে ছুটি দেয়া হয়।
সবশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ওইদিনই তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় উপাচার্য পদ থেকে তাকে অপসারণের সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মীজানুর রহমানকে নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে ছাত্রলীগকে চাঁদা দেয়ার ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি ফারজানা ইসলামও। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে তার একটি অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর দলমত নির্বিশেষে সব মহল থেকেই তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন সৎ মানুষ হিসেবেই পরিচিত। অথচ বিতর্ক তারও পিছু ছাড়েনি। বলা হচ্ছে, তার এই বিতর্কিত হওয়ার জন্য দায়ী তার স্বামী ও সন্তান। যদি তাই হয়, তাহলে উপাচার্য নিজে এর দায় এড়াতে পারেন না।
তার অপসারণ দাবিতে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন চলছে। কিন্তু তিনি পদ না ছাড়তে অনড়। তিনি দোষী কি নির্দোষ, তা হয়তো তদন্তে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যখন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠলো, তখন একটি সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করে তার কি উপাচার্যর পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল না?
প্রশ্নটি এ কারণে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা উপাচার্যদের কাছ থেকে মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও শালিনতা প্রত্যাশা করে। ফলে তিনি তখন তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীকে বলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তোর মতো বেয়াদব তৈরি করা’ অথবা ‘বিশ্ববিদ্যালয় কি তোর বাপ চালায়’ ইত্যাদি, তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং তাদের মনে এই প্রশ্নও তৈরি হয়, এরকম নিম্নশ্রেণীর এবং নিম্নরুচির মানুষেরা কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারলেন!
এটিও বাস্তবতা যে, শিক্ষক ও ভিসিরা সমাজের বাইরের কেউ নন। যখন একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে শিক্ষকরা মুক্ত থাকবেন, সবাই হয়তো সেটি প্রত্যাশাও করেন না। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো পদ যেহেতু রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘বণ্টন’ করা হয়, অর্থাৎ শিক্ষকের অ্যাকাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা যাই থাকুক না কেন, তিনি দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে যদি ভিসি হতে না পারেন, সেখানে তার কাছ থেকে অন্য পেশার মানুষের চেয়ে বাড়তি নীতি-নৈতিকতা প্রত্যাশা করাও হয়তো ভুল।
কিন্তু তারপরও শিক্ষকদের কাছে মানুষের একটু বাড়তি প্রত্যাশা থাকেই। এই প্রত্যাশাটা একদিনে তৈরি হয়নি। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন ক্রমেই একেকটি পঁচা-দুর্গন্ধময় অশিক্ষার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে, তেমনি শিক্ষকরাও যেন আর শিক্ষক পরিচয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না। যেন তারা আরও বেশি কিছু চান। যেন তারাও অসৎ ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারীদের সাথে পাল্লা দিয়ে এমন কিছু পেতে মরিয়া, যা পাওয়ার জন্য শুধু শিক্ষক পরিচয়টি আর যথেষ্ট নয়।
যে কারণে তাদের ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম করতে হয়, পরীক্ষায় ভালো নম্বর দেয়ার লোভ দেখিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়তে হয়, চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ নিতে হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের নয়ছয় করতে হয় অথবা ক্ষমতাসীনদের চাপে পড়ে চুপ থাকতে হয়, নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠলেও চেয়ার আঁকড়ে থাকতে হয়, ইত্যাদি। ফলে আমরা যখন বলি যে, শিক্ষক এ কারণে শিক্ষক যে, তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের আলোর পথ দেখাবেন, সেটি বস্তুত বইয়ের কালো অক্ষরেই নির্জীব নিরর্থক বাক্য হয়ে পড়ে থাকে।
বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তার মানে শিক্ষকরা সেই মেরুদণ্ডের কারিগর। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যখন মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েন, তখন সেই জাতির মেরুদণ্ড সোজা হবে কী করে? কোনো একটি জাতি শুধু অর্থবিত্ত, সম্পদ আর প্রবৃদ্ধি দিয়ে উন্নত হয় না। তার উন্নতির প্রথম এবং প্রধান সূচক তার নীতি-নৈতিকতা, যার ভিত্তি রচনা করেন শিক্ষকরা। অথচ সেই শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে এখন যে ক্ষয়, তার পেছনে মোটা দাগে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে দায়ী করা হলেও সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষকের দায়ও অনেক। ফলে যখন সকল পেশার, সকল শ্রেণির, সকল স্তরের মানুষও নষ্ট হয়ে যায়, তখনও মানুষ শিক্ষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ প্রত্যাশা করে। আমরা এখনও এই প্রত্যাশা করি। আমাদের শিক্ষকরা সত্যিকারের পথপ্রদর্শক এবং জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবেন, সেই সুদিনের প্রত্যাশায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।