হাঁপিয়ে উঠেছিলেন! আর ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না? বাসায় থাকতে ভালো লাগছিল না? আবার বাইরেও আতঙ্ক। একদিকে অফিস শুরু হচ্ছে আবার বাচ্চারা বাসায়, কারণ স্কুল বন্ধ। অচিরেই খুলে যাবে স্কুলও। বাসায় কাজের সহায়তাকারীও আসছিল না। ওয়ার্কফর্ম অফিস, বাসার কাজের চাপ, বাচ্চাদের অনলাইন স্কুল ও হোমওয়ার্কের চাপ, রান্নার চাপ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পান না। একটু যে বাইরে যেয়ে রিলাক্স করবেন কিন্তু অন্য ব্যক্তিকে ভয় করছেন সংক্রামণের কারণ হিসেবে। আবার অপর ব্যক্তি আপনাকে সন্দেহ করছে। আত্মীয়, প্রতিবেশী বন্ধুর সাথে দেখা হয় না। আড্ডা, বেড়ানো সব বন্ধ। ব্যবসা বন্ধ, আয়-রোজগার নেই বলেই চলে, জমানো টাকায় হাত পড়েছে, কারো কারো তো জমানো টাকাও নেই। অর্থের কষ্ট শুরু হয়ে গেছে। কেমন একটা দম বন্ধ অবস্থা। এই অবস্থা শুধু আপনার নয় পৃথিবীজুড়েই এই অবস্থা, শুধু মাত্র কয়েকটা দেশ সৌভাগ্যবান যেখানে এখন থাবা দেয়নি করোনা নামের ভাইরাস। তো সরকার তো আপনাদের মতোই হাঁপিয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ কে সামাল দিতে হিমসিম খেয়ে গেছে। পারছে না রুখতে না পারছে জনগণকে ঘরে আটকে রেখে একবেলা ভাতডালের ব্যবস্থা করতে। না পারছে চিকিৎসা ব্যবস্থার সুব্যবস্থা করে দিতে। এই না পারার কারণ কিন্তু সরকার প্রধান নন। উনার চারপাশে থাকা দেয়াল হয়ে থাকা মানুষগুলো গাছের খেয়ে তোলার কুড়িয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে ফলে জনগণ ভুগছে আর আর সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলির মুখ থুবড়ে পরছে। অর্থবানদের সমস্যা একটা নেই তেমন, নিম্নবিত্তদের জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন সহায়তা করছে। ঝামেলায় পরেছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। তাদের কাছে না যাচ্ছে সরকারী ত্রাণ বা তারা না পারছে কারো কাছে হাত পাততে।
গত তিন চার মাসে পৃথিবী অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। একদিকে মৃত্যুভয়, অন্যদিকে অর্থাভাব। কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে, সেটা ভেবেই এখন মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে। দেশে আক্রান্তের লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এটা তথ্য যেমন উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনই মানুষকে একটা সময় কাজে ফিরতেই হবে, এই কঠোর বাস্তবকেও উপেক্ষা করা যায় না। তাই সতর্ক থাকার সময় এসেছে।খোলা বাজার থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ কামরা, যেখানে অনেক মানুষের সমাগম, সেখানে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই মেট্রো রেল, লাইব্রেরি, অফিস ইত্যাদি জায়গায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে অনেক বেশি।আশেপাশে দেখতে পাচ্ছি, মাস্ক পরে এক অদৃশ্য উৎসাহের সূচনা হয়েছে। কিন্তু শুধু মাস্ক পরলেই সুরক্ষিত থাকা যাবে না। রোগ প্রতিরোধের বাকি দু’টো স্তম্ভের কথা মানুষ প্রায়ই ভুলে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোয়ার বিকল্প কিন্তু মাস্ক পরা নয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভাইরাসের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এখন প্রয়োজন সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার মনের জোর। আর আগামী বেশ কিছু মাস এই নতুন জীবনধারাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার অধ্যবসায়…।
গত ১০০ বছরে পৃথিবী এরকম মহামারী দেখেনি। শহরের প্রায় সমস্ত বড় হাসপাতালে এখন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি। ফলে আউটডোর চলছে গুটিকয়েক রোগী নিয়ে, হাসপাতালের ক্যান্টিন বন্ধ, ভেতরের রাস্তাগুলো ফাঁকা, বাইরে গাড়ির লাইন নেই…। হাসপাতালে ঢোকার মুখেই এখন ট্রাই রুম।এখান থেকে ভাগ হয়ে যাচ্ছে রোগী। যাঁদের কোভিড উপসর্গ আছে ও পরীক্ষা প্রয়োজন এবং যাঁদের সেই সব উপসর্গ নেই।
করোনা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও, ঋণাত্মক চাপ বা নেগেটিভ প্রেশার বজায় রাখার জন্য খুব ঠান্ডা রাখা যায় না। আমাদের পরনে থাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক। এই ধরনের পোশাকে হাওয়া বা তরল পদার্থ জামা ভেদ করে ঢুকতে পারে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীর ঘামে ভিজে যায়। পাশাপাশি চোখে চশমা ও মুখে মাস্ক পরতে হয়। এই বিশেষ মাস্কের নাম N-95 বা FFP2। বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি ভেদ করে করোনার জীবাণু শ্বাসনালীতে প্রবেশ করার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশেরও বেশি কম। কিন্তু সমস্যা হল, এটা পরে শ্বাস নিতে প্রচণ্ড অসুবিধা হয়। ফলে দম বন্ধ হয়ে আসে, মুখমণ্ডল ঘেমে যায়। তাই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, চশমার কাচে বাষ্প জমে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। পাশাপাশি এই মাস্ক নাকের ব্রিজের উপর চেপে বসে ব্যথার উদ্রেক করে।এই গোটাটা মিলিয়ে হচ্ছে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট বা পিপিই। পিপিই একবার পড়লে জল বা খাদ্য গ্রহণ করা যায় না, এমনকী শৌচালয়েও যাওয়া যায় না। প্রায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা একটানা এভাবে কাজ করতে হয়।
করোনা হয়তো আর কোনওদিনই যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিজ্ঞানী, থেকে বিভিন্নদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী —সকলের মুখে এখন একটাই কথা। করোনাকে নিয়েই বাঁচা শিখতে হবে। পরিষ্কার থাকতে হবে. সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা। প্রতিষেধক মিললে সুবিধা হবে। কিন্তু এই রোগকে নির্মূল করা যাবে না। এইডসের মতোই করোনাকে নিয়েই থাকতে হবে। করোনা মুক্ত পৃথিবী এখনও সোনার পাথরবাটিই!
করোনাকে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এমনটাই জানিয়ে দিয়েছে। হু-এর এই ঘোষণার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। চীন, জাপান, আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি, ইজরায়েল যাই দাবি করুক না কেন, বাস্তবটা হল, করোনা ভ্যাকসিন এখনো নাগালের ধারেকাছে নেই। ইতিহাস বলছে, চিকেন পক্সের ভ্যাকসিনের জন্য ৪২ বছর, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জন্য ১৬ বছর, ইবোলার জন্য ৪৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। তাই করোনাকে শায়েস্তা করার ওষুধ তাড়াতাড়ি আসবে, এমন ভাবাটা একটু বাড়াবাড়িই হবে। এই অবস্থায় বাঁচার মন্ত্র, সতর্ক হোন, কিন্তু আতঙ্কিত হবেন না। আত্মকেন্দ্রিক হোন, কিন্তু স্বার্থপর নয়।
এতদিন আত্মকেন্দ্রিক শব্দটির দিকে আমরা বাঁকা চোখে তাকাতাম। সামাজিক জীবনে আত্মকেন্দ্রিকতা ছিল প্রায় গালিগালাজের সমান। আত্মকেন্দ্রিকতা আর স্বার্থপরতাকে আমরা সমান চোখে দেখে এসেছি। দু’টি শব্দের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। তবে তফাৎটা খুবই সুক্ষ্ম। নিজের কিসে ভালো হবে, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ শুধু ডুবে থাকে সেই চিন্তায়। আর আত্মকেন্দ্রিকতার সঙ্গে যখন অন্যের সুখ সুবিধা অগ্রাহ্য করার মানসিকতা জড়িয়ে যায়, তখনই মানুষ হয় স্বার্থপর।
করোনার আবহে আরও অনেক কিছুর মতোই বদলে গিয়েছে আত্মকেন্দ্রিক শব্দটির তাৎপর্য। এই মুহূর্তে আত্মকেন্দ্রিকতা আর কটাক্ষ করার শব্দবন্ধ নয়। বরং বলা ভালো, আমাদের আজ আত্মকেন্দ্রিক হওয়ারই সময়। নিজের ভালোটা নিজেকেই বুঝতে হবে। আর সেটা বুঝলেই সহজ হয়ে যাবে করোনার সঙ্গে সহাবস্থান। করোনা থাকবে, থাকব আমরাও। পাশাপাশি, অথচ সমান্তরাল। ঠিক দু’টি রেললাইনের মতো। মিলে গেলেই বিপদ।
করোনা মোকাবিলার জন্য আমাদের আজ আত্মকেন্দ্রিক হতে হবে, কিন্তু স্বার্থপর নয়। তেলটা ঢালতে হবে নিজের চরকাতেই। নিজের দায়িত্বটা ঠিকঠাক পালন করলে করোনাকে ভয় নেই। চিকিৎসকরা বারে বারে বলেছেন, করোনার ছোবল থেকে বাঁচার জন্য চারটি কাজই যথেষ্ট। বাইরে বেরুলে মাস্ক পরতে হবে। নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করার আগে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে হাত। বাইরে বেরুলে বজায় রাখতে হবে দূরত্ব। আর ঘরে ফিরেই জামা, কাপড় ও মাস্ক জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতদূর পারুন স্বাভাবিক জীবন কাটান, “নিয়ম মানলে তো ভাল। কিন্তু যা হচ্ছে তা কোনও নিয়ম নয়। অবৈজ্ঞানিক সব ব্যাপার। এই যে গরমের মধ্যে ঘণ্টায় ঘণ্টায় গরম পানি খাচ্ছেন, চা খাচ্ছেন, কী এর কারণ? ভাইরাস মরবে? ভাইরাসকে মারতে গেলে পানির তাপমাত্রা যা হতে হবে, তাতে তো মানুষই মরে যাবে! অত চা খেলে গ্যাস্ট্রিক বাড়বে!’’ কেউ আবার রোদে দাঁড়িয়ে থাকছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ তাতে ভিটামিন ডি তৈরি হবে, করোনা পালাবে! ভিটামিন ডি দরকার। এখন বলে নয়, সব সময়েই দরকার। কিন্তু বাড়াবাড়ি করলে তো বিপদ। তাঁদের অভিমত: ‘‘আসলে মানুষকে ভাল করে বুঝানো হচ্ছে না। স্রেফ বলে দেওয়া হচ্ছে এটা করো, ওটা করো। কেন করতে হবে, না করলে কী হবে তা না বুঝলে যা হয়। কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কেউ বাড়াবাড়ি করছেন। আর রোগ থেকে যাচ্ছে রোগের মতো। অতিমারির মোকাবিলা এভাবে হয় না।’’ তাদের পরামর্শ, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হয়। ট্রেনিং দিতে হয় লাগাতার। তারপর সবাই যখন বুঝেন এই পথে চললে ভাল হবে, তাঁরা নিজেরাই ঠিকঠাকক নিয়ম মানেন, উপর থেকে চাপিয়ে দিতে হয় না।”
খুব জটিল কিছু নয়। কিন্তু অনেকেই নিজের কাজগুলো ঠিকঠাক করছি না। উল্টে বাইরের দিকে তাকাতে যাচ্ছি। নিজের ঘরটা না সামলে পরকে জ্ঞান দিচ্ছি। আর সেটা করতে গিয়েই কখনও পুলিশের সঙ্গে লাঠালাঠি করছি, কখনও প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে গড়ে তুলছি ব্যারিকেড। মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। ভাবখানা এমন, দেখ কেমন দিলাম!
গতকাল যারা ছিল সব থেকে নিকটজন, সেই পাড়া প্রতিবেশী মহল্লাবাসীর অমানবিক রূপ দেখছে জীবন সায়হ্নে এসে চরম দুর্ব্যবহার, নিষ্ঠুরতা ও অসংযমের শিকার হতে হচ্ছে বয়স্ক বাবা-মাকে, পরিবারের বয়স্ক পরিজনকে। করোনা আবহে স্পষ্ট উপলব্ধি করছে মানুষ, চেনা মানুষগুলোও আজ কেমন যেন অচেনা নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।
দিন যত যাচ্ছে আতঙ্ক আমাদের ততই গ্রাস করে নিচ্ছে। আচ্ছা, সতর্ক হতে গিয়ে কি আমরা একটু বেশি মাত্রায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি? প্রশ্নটা দিন দিন খুব বড় হয়ে উঠছে। লক্ষণটা ভালো ঠেকছে না। আতঙ্ক ঘুনপোকার মতোই ক্ষতিকারক। প্রতিনিয়ত, প্রতিটা মুহূর্ত কুরে কুরে খায়। ভিতরটা একেবারে ফোঁপরা করে দেয়।
তাই আতঙ্ক থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজতে হবে। কোনটা করা উচিত, আর কোনটা নয়, সেটা বুঝতে হবে হৃদয় দিয়ে। তা না হলে আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ভাবতে হবে, আতঙ্কিত হয়ে আমরা নিজেদের অজান্তেই সমাজের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করে ফেলছি না তো?
এটা করোনাকে হারানোর পথ নয়। করোনা মোকাবিলায় দরকার সহমর্মিতা। মারণ ভাইরাস মোকাবিলার বার্তা বাজছে মোবাইলে মোবাইলে, ‘রোগের সঙ্গে লড়তে হবে, রোগীর সঙ্গে নয়। ওদের সঙ্গে ভেদাভেদ করবেন না।’ একেবারে সঠিক কথা।
করোনাভাইরাস থেকে না পালিয়ে বরং নিয়ম মেনে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক জীবন করার চেষ্টা করতে হবে, শিখতে নিতে হবে শত্রুর সাথে বসবাসের নিয়মাবলী। বিশেষজ্ঞের দেয়া নিয়মাবলী মেনে যথাযথভাবে হাত ধোয়া, ভীর এড়িয়ে চলা, মাস্ক ও গ্লাভস পরে আমাদের শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। প্যানিক না ছড়িয়ে একে অন্যের সহযোগিতা করতে হবে। কারণ দুঃসময়ের নিষ্ঠুরতা আমাদের এত বছরের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট করে দেবে। তাই আতঙ্কিত হবার বদলে শত্রুর সাথে বসবাস শিখে নিতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)