বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাস পৃথিবীকে তীব্রভাবে আঘাত করেছে। এই আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেছে সমগ্র বিশ্ব। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ পড়ে গেছে দীর্ঘ লকডাউনের কবলে। কিন্তু যখন ধীরে ধীরে লকডাউন উঠে যাবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তখন কীভাবে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বা কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যাবে?
এসব নিয়ে বহু প্রশ্ন আসছে, আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই একটি বিষয়, যেখানে কিছু দেশ করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ সহজ করার সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একটি পরিস্থিতি লক্ষ্য করছেন, আর সেটা হলো লকডাউন পরবর্তী জীবনে নিয়ে মানুষের উদ্বেগ। যারা সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপের মধ্যে থেকে যায়, তারা এই বিধিগুলো প্রত্যাহার করা হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা নিয়ে বেশ ভীত।
‘এটি আমাদের বেশিরভাগের জন্যই অস্বস্তিকর পরিবেশ নিয়ে আসতে চলেছে‘-বলছিলেন, আকাঙ্খা ভাটিয়া।
২৫ বছর বয়সী এই মানসিক স্বাস্থ্য এবং মহিলাদের অধিকারের পক্ষের লেখিকা ও আইনজীবী লকডাউনের আগে বেশ উদ্বেগেই ছিলেন। এই উদ্বেগ নিয়ে কীভাবে তিনি আইসোলেশনে চলে যান, তা শেয়ার করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
রাজধানী দিল্লিতে তার কর্মস্থল ও বসবাস। তবে লকডাউন ঘোষণার সময় তিনি তার মা-বাবার সাথে চেন্নাইতে চলে যান।
“পুরো এক মাসের লকডাউনে এটি এতো সহজ ছিলো না। এই সময় প্রচুর কেঁদেছি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।”
অন্যদের মতোই লকডাউনের সময় আকাঙ্খাও কিছু বিষয়ে লড়াই করেছেন। করোনাভাইরাসের আগের জীবনে যে, উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরেছিলো বাড়িতে আসার পর এমন কিছু থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কারণ তিনি তার মা-বাবার সাথে বাড়িতে থাকতে পেরেছেন, যারা তাকে নিরাপদবোধ করতে সহায়তা করেছেন।
আকাঙ্খা নিজেকে অন্তর্মুখী হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘কঠিন এই সময়ে সামাজিকীকরণ এমন একটি বিষয় যা তার উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। যদিও তিনি পরিবারের সাথে নিরুদ্বেগ এবং স্বাচ্ছন্দ্যে সময় পার করছেন। কিন্তু লকডাউনের পর কীভাবে তার আগের জীবনে ফিরে আসবেন সে বিষয়ে চরমভাবে ভাবছেন।’
তিনি বলছেন, যতো যাই উদ্বেগ থাকুক না কেন আপনাকে আবারও আগের মতো অভ্যস্থ হয়ে উঠতে হবে। কারণ, আপনি বাধ্য ও নিস্পত্তিহীন পরিস্থিতিতে পড়েছেন।
তবে মনোবিদরা বলছেন, লকডাউনের প্রভাব খুব নেতিবাচক হতে পারে। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্যাবস্থায় আঘাত আসতে পারে। এটি যে শুধু আক্রান্তদের ক্ষেত্রে হবে তা নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারীদেরও ওপরও প্রভাব ফেলবে।
‘আপনি দীর্ঘ সময় ভেতরে থাকার পর বাইরে যেতে অদ্ভূত পরিস্থিতির অনুভব করতে পারেন‘-বলছিলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে যুক্তরাজ্যের সংগঠন অ্যাঙ্কজেইটি, ইউকে এর প্রধান নির্বাহী নিকি লিডবেটার।
তিনি বলছিলেন, আপনি সম্ভবত এমন কিছু করতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে পারেন, যা আপনি আগে করেছেন। যেমন অফিসে মুখোমুখি বসে সভা বা মিটিং, গণপরিবহন ব্যবহার করা-ইত্যাদি। এসব করতে আপনার মনে সংক্রমণ শঙ্কার চাপ বাড়তে পারে।
“মূলত আমরা এমন এক সময় লকডাউনে পড়ে গেছি, যেখানে খুব কম সময় হাতেই পেয়েছি। আচমকা এমন বন্দিত্ব অবস্থা সত্যি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে সবার মাঝে।”
যেমনটা বলছিলেন, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সাইকিয়াট্রিক বিভাগের অধ্যাপক ড. স্টিভেন টেইলর, ‘এটি লোকজনের জন্য অত্যন্ত চাপের বিষয়‘।
“এমন চাপের মাঝেও বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে লকডাউন তুলে নিতে চেষ্টা করছেন। শঙ্কার ব্যাপার হলো, এতে পরে সমস্যা তৈরি করতে পারে, যদিনা নেতৃবৃন্দ জনগণকে সঠিক গাইডলাইন দিতে ব্যর্থ হয়।”
২০১৯ সালে ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের সূচনার কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বই ‘দ্য সাইকোলজি অব প্যান্ডেমিকের লেখক ড. টেইলর বলছেন, মহামারীর ক্ষেত্রে সংক্রমণের বিস্তার এবং সংক্রমণ একটা মানসিক ঘটনা। এটি কেবল কিছু বাগ বা পোকা নয় যা বিশ্বজুড়ে এলোমেলোভাবে চলছে। এটি মানুষের আচরণের ওপর নির্ভর করে, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তাই মানুষের আচরণকে থামাতে হয়েছে লকডাউনের মাধ্যমে। কিন্তু তা একটা সময় উম্মুক্ত হবে। এই উম্মুক্ত হওয়ার মধ্যেই মানুষের যতো মানসিক চাপ এসে পড়ছে।
ড. টেইলর বলছেন, যখন লকডাউনের নিয়ম শিথিল করার চেষ্টা চলবে, তখন ভালো নেতৃত্ব এই নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনসাধারণ যেন নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসী বোধ করে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং গাইডলাইন মেনে চলতে কঠোর হবে।
“মহামারী পরবর্তী বিশ্বে পুনরায় আত্মীকরণের ব্যাপারে নেতাদের সুস্পষ্ট যোগাযোগ স্থাপন করা দরকার। তাদের এটি নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত যে, এখন ঠিক আছে সবকিছু। আমরা এখন পূর্বের মতো একত্রিত হতে পারি। মূলত দক্ষ নেতৃত্ব এভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়েই তার সকল নীতি গ্রহণ করবে। এই বিষয়ে গাইডলাইনগুলো এমন স্পষ্ট হওয়া দরকার যেন মানুষর মন থেকে অনিশ্চিয়তা ও উদ্বেগ দূর হয়ে যায়।
তিনি বলছেন, অবশ্য এতো কিছুর মাঝেও কিছু লোক অ্যাগ্রোফোবিয়া বা ভেতরে ব্যাধির লক্ষণ নিয়ে ভীত হবে। মানুষের অ্যাগ্রোফোবিয়ায় ভোগার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। মূলত অনেকে বাইরে গিয়ে ভয় পেয়েছেন। তবে অনেকের অনুপ্রেরণা আলাদা। কেউ আবার ভয় পাচ্ছেন না, ইচ্ছা মতো বিচরণ করছেন। তাই অ্যাগ্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে পারে। কেননা, তারা আতঙ্কে থাকেন।
“শত উদ্বেগ, সংকটের মাঝেও লকডাউন এবং নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়ার পর পুনরায় এমন কিছু কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে হয়তো, যা আপনি চাচ্ছেন না। কিন্তু করতে হচ্ছে। যদিও মানুষ চাইছে পুরনো স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরতে। নতুন স্বাভাবিক অবস্থা তথা মানুষ পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছে” – বলছিলেন লিডবেটার। কিন্তু আবার একদিনে নিজের শূণ্য থেকে ১০০ তে যাওয়ার আশা করাও অনুচিত।
অনেকে আগের রুটিনে ফিরে যেতে চাইবে। তবে লিডবেটার বলছেন, আপনি যদি আগের রুটিনে ফিরে আসতে অসুবিধায় পড়েন, তবে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। যেমনি করে লকডাউনের রুটিনে প্রবেশ করা আমাদের জন্য কঠিন বলে মনে হয়েছে। তেমনি এটিও যৌক্তিক যে, লকডাউনের রুটিন থেকে বেরিয়ে আসাও খুব কঠিন মনে করবো আমরা-এটা স্বাভাবিক। কাজেই আমাদেরকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, এটি একটি যেমন শারীরিক প্রক্রিয়া তেমনি মানসিকও একটি ব্যাপার।
লিডবেটার এই সময় সংকটাপন্ন লোকদের প্রতি সৌম্য ও বিনয়ী হতে উৎসাহিত করেছেন।
“যদি লোকজন সত্যিই উদ্বেগের সাথে লড়াই করে এবং তারা লকডাউনের পুরো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে মহামারীটি সত্যই তাদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাহলে তাদের জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা দরকার। আর উপসর্গের শঙ্কা দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এই সময় একা লড়াই করা উচিত নয়’।
তিনি এসময় উদ্বেগ দূর করতে বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পরামর্শও দিয়েছেন।
আর ড. টেইলর বলছেন, এতে করে অনেকে যেভাবে উদ্বেগে আছেন, তা কেটে যাবে।
তিনি বলেন, “সুসংবাদটি হলো এই যে, লোকজন এতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।”
“আমি আশা করি যে উদ্বিগ্ন ব্যক্তিরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কিংবা সম্ভবত কয়েক মাস পরে লকডাউন নিষেধাজ্ঞাগুলো সরে গেলে সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে কিছু লোকের মানসিক সমস্যা দীর্ঘায়িতও হতে পারে।
এই সময় বিশেষজ্ঞরা মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন এবং জীবনকে স্বাভাবিভাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন আর লকডাউনকে বহুমুখি কাজের দ্বারা কার্যকর করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সাথে লকডাউন উঠে গেলে নিজের সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে মানসিকতা সেটাকে শক্ত করার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে পুরনো স্বাভাবিক অবস্থা থেকে আমাদের নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা কঠিন হলেও অসম্ভব হবে না বলেই মনে করেন মনোবিদরা।
যেমন আকাঙ্খা ভাটিয়া ইতোমধ্যে ভারতে লকডাউন উঠে গেলে কীভাবে নতুন জীবন মোকাবিলা করবেন, সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।
তিনি বলছেন, তিনি এমন কিছু কাজ করতে যাচ্ছেন যা বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, যেমন খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা- ইত্যাদি।
“এটিকে যতোটা সম্ভব সহজ-সরল করে রাখুন। হঠাৎ নতুন কিছু নিয়ে ডুবে যাবেন না, যেমন আমি পূর্বের মতো প্রতিদিন পার্টি নিয়ে উন্মাদ হয়ে যাব না।”
তিনি ধীরে ধীরে লকডাউনের পৃথিবীতে কীভাবে নতুন করে মানিয়ে নেওয়া যাওয়া যায়, সে বিষয়ে অনুশীলন শুরু করেছেন। এমনকি নতুন কিছু শিখছেন তিনি, যেন পরবর্তী বিশ্বে কাজে লাগে। শখের কাজগুলো চালিয়ে নিচ্ছেন।
তিনি বলছিলেন, আমি এখনই কোরিয়ান ভাষা শিখছি। আমি চাই সাব টাইটেল ছাড়াই আমার প্রিয় কোরিয়ান ড্রামাগুলো যেন দেখতে পারি।