রাখাইন থেকে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক চাপে আছে মিয়ানমার। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে তাদের অনুসন্ধানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এসব নির্যাতনের তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে। অপরাধের তীব্রতা উল্লেখ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তদন্ত করা দরকার বলেও প্রতিবেদনে দাবি করে জাতিসংঘ।
কিন্তু মিয়ানমার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। উল্টো তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমন করা হয়েছে বলে দাবি করছে। অপরাধ সংঘটিত এলাকায় সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দেশটি। তবে গণহত্যার অভিযোগ যে মিথ্যা ছিল তা প্রমাণ করতে ও সাংবাদিকদের সন্তুষ্ট করতে গত মাসের শেষ দিকে সরকারের নেতৃত্বে সংরক্ষিত এলাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।
সেখান থেকে ঘুরে এসে রাখাইনের বর্ণনা দিয়েছেন সিএনএন’র কয়েকজন সাংবাদিক। জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের এক সপ্তাহ পরই তারা মিয়ানমার সফরে যান।
তারা বলেছেন, ‘জরাজীর্ণ সড়ক ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছিল। রাখাইনের যে ৩৯২টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এখান থেকে তার অস্তিত্ব পাওয়া কঠিন। শুধু কালো ক্ষীয়মাণ গাছ দেখা যাচ্ছে। বর্ষাকালও বেশিরভাগ ঝলসানো চিহ্ন মুছে ফেলতে সহায়তা করেছে। মাঠগুলো ভরে গেছে সবুজে সবুজে। বুলডোজারের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ ও নির্মাণকাজ রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ স্মৃতি মুছে ফেলছে, যেখানে এক বছর আগেও ছিল তাদের বসবাস।’
ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের গ্রাম ইন ডিন
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে যেসব ভয়াবহতার খবর উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম ইন ডিন গ্রাম। এখানেই সাংবাদিকদের যাতায়াত প্রথম বন্ধ করা হয়।
জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, এখানে নারী, পুরুষ, শিশুদের হত্যা করার পাশাপাশি আহত করা হয়। তাদের ওপর গুলি ও ছুরি চালানো হয়। এই গ্রামেই ১০ রোহিঙ্গা পুরুষকে মেরে গণকবর দেয়া হয়। এই অপরাধ ধারণ করার ফলে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ৭ সৈন্যকেও জেল দেয়া হয়। এই নৃশংসতার কারণেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শাস্তি পাওয়া উচিত বলে জানায় জাতিসংঘ।
সিএনএন’র সাংবাদিকরা ওই গণকবর দেখাতে বলেন। কিন্তু স্থানীয়রা জানায়, খারাপ আত্মা বের হয়ে আসতে পারে, তাই এটার অনুমতি নেই। বৌদ্ধ গ্রামবাসী একপর্যায়ে রেঘে যেতে শুরু করে এবং উচ্চস্বরে তাদের চলে যেতে বলে।
ইন ডিনে ৭ হাজারের মতো লোক ছিল, যাদের ৯০ ভাগ ছিল রোহিঙ্গা। এখন সেখানে কোন রোহিঙ্গা বা তাদের ঘরবাড়ি কিছুই নেই। স্থানীয় বৌদ্ধরাও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। মুসলিমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হুমকি দিচ্ছিল বলে বৌদ্ধদের অভিযোগ। তবে বৌদ্ধদের এলাকায় কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বৌদ্ধ গ্রামবাসী সাংবাদিকদের দেখে আশ্চর্য হয়নি, কারণ এ বিষয়ে তাদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল।
এখনও অনেক রোহিঙ্গা থেকে গেছে রাখাইনে। তারা সিএনএন’র সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। তারা এখনো আতঙ্কগ্রস্ত।
৫০ বছর বয়সী মোহাম্মেদ উদ্দিন বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ভালো’ ‘খুব ভালো’। এরপর তিনি কিছুক্ষণ থেমে বলেন, ‘এটা আসল উত্তর না’।
আরেকজন বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা ‘বড় সমস্যা’, কারণ ‘সরকারের লোক’ তাদের ঘিরে রেখেছে।
মংডুর এক যুবক ফোনে ভীতির কথা জানিয়ে বলেন, এখানে কোন স্বাধীনতা নেই, মুসলিমদের জন্য কোন জায়গা নেই এখানে। আমার কোন চাকরি নেই, শিক্ষা নেই। আমরা কোথাও যেতে পারি না, সরকার আমাদের কয়েদির মতো করে রেখেছে।
রাখাইনে এখনও ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে। তাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। তাদের চলাচলেরও ওপরও রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়ার ভয়ে আছে, ভয় আছে অবশিষ্ট সম্পদ হারানোর।
রাখাইনের উত্তর অংশে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ এ অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। এখানকার একজন বলেন, আমরা আমাদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আমাদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জীবন রক্ষা করা।
তারা মিয়ানমারের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে খুব ভীত। বিজিবির পাহাড়ায় তারা বাংলাদেশেও ঢুকতে পারছে না। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সহায়তায় তারা বেঁচে আছে।
তারা জানায়, তারা এক নরক থেকে আরেক নরকে এসে পড়েছে, কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে এটা ভালো। কেউ এমন পরিস্থিতিতে থাকতে চায় না, কিন্তু তাদের জন্য মিয়ানমার এখনো নিরাপদ নয় বলে জানায়।
এতকিছুর পরও মিয়ানমার জানায় তাদের দেশে কখনই গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি। মংডু পৌরসভার প্রশাসক ইউ মাইন্ট এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় একথা জানিয়ে বলেন, যদি কোন গণহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে এখনও এখানে কীভাবে মুসলিমরা বসবাস করছে?
তিনি আরও অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়েছে। ‘একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল পেতে’ ১৯৪০ সাল থেকেই রোহিঙ্গারা সহিংসতা জিইয়ে রেখেছে। রোহিঙ্গারা সুযোগ পেলেই আদিবাসীদের হত্যা করবে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ তিনটি সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আপাতদৃষ্টিতে তার কোন অগ্রগতি নেই। জাতিসংঘের ইয়াংহি লি বলেছেন, মিয়ানমার এ বিষয়ে ‘কোন অগ্রগতি করেনি বা ‘বাস্তবিক কোন আগ্রহ দেখায়নি’।