মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানের শিকার হওয়া অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলেও জঙ্গি যোগাযোগের ঝুঁকিসহ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নানা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি) এক সমীক্ষায় এসব ঝুঁকির কথা উল্লেথ করে বলা হয়েছে, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও দীর্ঘদিন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করলে বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, এই সংকটের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগসাজশ প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি রয়েছে।
‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশে অবস্থানজনিত সমস্যা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিষয়ক সমীক্ষা’ শীর্ষক এক গবেষণায় পাঁচ ধরনের প্রভাব ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরা হয়েছে।
আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প সরেজমিন পরিদর্শন করে তৈরি করা ওই গবেষণায় উঠে আসা প্রভাব ও ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে-ত্রাণ ও জীবনধারণে প্রভাব, নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি, পরিবেশগত ঝুঁকি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় প্রভাব ও জাতীয় উন্নয়নে প্রভাব।
সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সহায়তায় ত্রাণ সরবারহ এবং তার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের পক্ষে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ধারণের সহায়তা দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর দ্রুত পূর্ণাঙ্গ তালিকা করে ত্রাণ বিতরণে সমতা নিশ্চিত করা না গেলে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। যে কারণে সার্বিক ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সহিংসতায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
মাদক, চোরাচালানসহ সামাজিক নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন ঝুঁকির কথা তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন অপরাধ এবং সহিংসতা বাড়বে। বিশেষ করে তা হবে নারী ও শিশুদের প্রতি।
‘আর ওই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল মাদক, চোরাচালান, হত্যা, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মতো নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের জড়িত ফেলাতে পারে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে গেলে তা বহুমুখী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির কারণ হবে।’
রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘সাংগঠনিক কাঠামো’ শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণার ফলাফলে।
পরিবেশগত বিভিন্ন ঝুঁকির কথা তুলে ধরে সেখানে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থানরত অঞ্চলে ধ্বংস হওয়া পাহাড় কাটা, বনভূমি উজাড় ও অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাণ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে যা ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি।
কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় পড়া বিভিন্ন প্রভাবের কথা তুলে ধরে গবেষণায় বলা হয়েছে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ফলে দ্রব্যমূ্ল্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়া, যোগাযোগের ব্যয় বেড়ে যাওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানাবিধ সেবায় স্থবিরতা, মান ও অভিগম্যতার অবনতিসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কেবল স্থানীয়ভাবেই নয় জাতীয় উন্নয়নেও রোহিঙ্গা সংকট কীভাবে প্রভাব ফেলতে পাবে সে বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপণার বিষয়টি সরকার ও উন্নয়ন সংস্থার ওপর বাড়তি চাপ হয়ে আসায় বাংলাদেশের অন্যান্য বিপন্ন এলাকা ও জনগণের (হাওর ও উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত) পুনর্বাসন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপণা ব্যয় সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতি এবং উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলার ঝুঁকি রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের অবস্থানরত অঞ্চলের পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেঠে গবেষণায়।
উদ্ভুত রোহিঙ্গা পরিস্থিত যাতে একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে না পড়ে সে জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে। আন্তর্জাতিক মহলকেও এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।