জগদ্বিখ্যাত ‘রোমান হলিডে’ সিনেমার প্রিন্সেস অ্যানের কথা নিশ্চয়ই অনেকের স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী এই রাজকুমারী রোম নগরী দেখতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ছকবাঁধা রাজকীয় জীবনে তিনি যেন হয়ে ওঠেছিলেন ত্যক্ত বিরক্ত। জো ব্রাডলি (গ্রেগরি পেক) নামের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে রাতের আঁধারে প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান। এ ছবিতে প্রিন্সেস অ্যানের রোমান্টিক চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন। দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য তিনি অর্জন করেন অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব এবং বাফটা পুরস্কার। সহজাত সৌন্দর্য ও হৃদয়ছোঁয়া অভিনয় তিনি মানুষের মন জয় করে নেওয়ার পাশাপাশি হয়ে ওঠেন একজন ফ্যাশন আইকন। তার সৌন্দর্য, তার প্রতিভা, তার মমত্ববোধ, তার সহানুভূতি আর তার সংবেদনশীলতায় বিমোহিত হয়েছেন অনুরাগীরা। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে নারী কিংবদন্তী হিসেবে বিরল সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
১৯২৯ সালের ৪ মে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে তার জন্ম। পুরো নাম অড্রে ক্যাথলিন রাস্টন। শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছে বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার পরিবার ছিল নেদারল্যান্ডসে। সে সময় ষোল বছর বয়সী এই কিশোরী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় তিনি ব্যালে নাচের মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য অর্থ যোগাড় করেন। সেবা করেন মিত্রবাহিনীর আহত সদস্যদের। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ব্যালে শিল্পী হওয়ার। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্যই তিনি ১৯৪৮ সালে লন্ডনে যান। কিন্তু যার কপালে আছে সফল অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে ওঠার লেখন, সে কী আর শুধু ব্যালে নাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে!
অড্রে হেপবার্নের চলচ্চিত্রে আগমনের বিষয়টা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন বা ইচ্ছে থেকে নয়, তিনি চলচ্চিত্রে এসেছিলেন জীবিকার তাগিদে। অভিনয় জীবনের প্রথমদিকে কয়েকটি ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে সহ অভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে আসে ‘রোমান হলিডে’। এই সাফল্যের পর ১৯৫৪ সালে সাবরিনা ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এরপর খ্যাতি, সাফল্য, পুরস্কার তার কাছে খুবই মামুলি হয়ে পড়ে। হৃদয়ছোঁয়া অভিনয় দিয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নেন ভক্তদের মনে।
তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে দি নান’স স্টোরি (১৯৫৯), ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফিনি’স (১৯৬১), চ্যারেড (১৯৬৩), মাই ফেয়ার লেডি (১৯৬৪), হাউ টু স্টিল এ মিলিয়ন (১৯৬৬), ওয়েট আনটিল ডার্ক (১৯৬৭) অন্যতম। তিনবার কেন্দ্রীয় চরিত্রে শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ অভিনেত্রী হিসেবে বাফটা পুরস্কার অর্জনের রেকর্ড গড়েন। এ ছবিগুলোতে অড্রে তার পোশাক, তার সৌন্দর্য আর তার চুলের স্টাইল দিয়ে জয় করেন অসংখ্য ভক্তের হৃদয়। ‘প্রিন্সেস অ্যান’, ‘সাবরিনা’ কিংবা ‘নান’ হিসেবে তার চমৎকার অভিনয় কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। অড্রে হেপবার্ন পৃথিবীর সেই চৌদ্দ জন সৌভাগ্যবান মানুষের একজন, একই সঙ্গে অ্যামি, গ্র্যামি, অস্কার ও টোনি – এই চারটি বিশ্বখ্যাত পুরস্কার যাদের মুকুটে শোভিত হয়ে আছে।
সর্বগুণসম্পন্না এই মহিয়সী বিশ্বের ৬টি ভাষা -ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ ও জার্মান অনর্গল বলতে পারতেন।
অড্রে হেপবার্ন তার সফলতা দিয়ে শুধু আকাশ ছোঁয়নি, বরং আরো অসীমকে তিনি স্পর্শ করেছেন। তিনি সফলতার পেছনে ছোটেননি, সফলতাই তার কাছে ছুটে এসেছে।
সাবরিনা চলচ্চিত্রের একটি সংলাপে তার বাবা বলেছিলেন, ‘ইউ আর স্টিল রিচিং ফর দ্য মুন।’
উত্তরে সাবরিনা (অড্রে হেপবার্ন) বলেছিলেন, ‘নো ফাদার, দ্য মুন’স রিচিং ফর মি।’
আসলে নিজের যোগ্যতা এবং দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে এই বিশ্বে তিনি এমন একটি জায়গা করে নিয়েছেন, যেখানে প্রতিনিয়ত তাকে ছোঁয়ার জন্য আকাশের চাঁদ ছুটে আসতো।
অভিনয় আর সৌন্দর্য দিয়েই সকলের মন জয় করার পাশাপাশি মানবতার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন কিংবদন্তী এ অভিনেত্রী। জাতিসংঘের হয়ে দেশে দেশে শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। এসেছিলেন বাংলাদেশেও। ১৯৮৯ সালের সেই সফরে তিনি আপন হয়ে ওঠেছিলেন এ দেশের শিশুদের। ইউনিসেফের গুডউইল দূতের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে তিনি সম্মানিত হন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’-এ। মানবসেবায় দৃষ্টান্তমূলক কাজের জন্য নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তার একটি প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছে জাতিসংঘ। ভালোবেসে টিউলিপ, লিলি ও গোলাপের সঙ্গে তার নাম যুক্ত করেছেন অড্রে অনুরাগীরা।
মানবতার সেবায় দীর্ঘ দিন কাজ করেছিলেন অড্রে। কিন্তু জীবনের শেষদিকে এসে আক্রান্ত হন মরণব্যাধি ক্যানসারে। শরীরে মৃত্যুযাতনা নিয়েও তিনি দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। রোমান হলিডে ছবিতে অড্রে বলেছিলেন ‘আমি জানিনা কীভাবে বিদায় বলতে হয়।’ কিন্তু বাস্তবে তিনি পৃথিবীকে বিদায় বলেছেন। ১৯৯২ সালের ২০ জানুয়ারি থেমে যায় তার পথচলা। সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট এক শহরে ঘুমের মধ্যে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন সুন্দরের এই দেবী।
সাবরিনা চলচ্চিত্রে অড্রে বলেছিলেন, ‘প্যারিসে গিয়ে আমি শিখেছি কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়, কীভাবে জীবনকে পাশ না কাটিয়ে পৃথিবীর মাঝে থেকে পৃথিবীর একজন হওয়া যায়। এই জীবন থেকে আমি কখনো দূরে পালিয়ে যাব না। না জীবন থেকে, না প্রেম থেকে।’
জীবন থেকে হয়তো অড্রে অনেক দূরে চলে গেছেন, কিন্তু কোটি কোটি অনুরাগীর হৃদয়ে যে জায়গা তিনি করে নিয়েছেন তার জন্য তিনি এখনো আছেন এই পৃথিবীর মাঝে।
ভুবনবিখ্যাত এই অভিনেত্রী ভীষণ পছন্দ করতেন কবিতা। তার একাকিত্বকে ভরিয়ে দিতেন কিটস, শেলী কিংবা রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের ‘অনন্ত প্রেম’। আর এ কারণে তার মৃত্যুর পর বন্ধু ও সহঅভিনেতা গ্রেগরি পেক আবৃত্তি করেছিলেন,
‘তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শতরূপে, শতবার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।’
অড্রে হেপবার্নের প্রিয় কবিতার মতোই তার অনুরাগীরা জনমে জনমে যুগে যুগে শতরূপে ভালবেসে যাবে এই প্রিয়দর্শিনীকে।