প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে এখন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাচ্ছে রোবটের ব্যবহার। ১৯২০ সালের পর শিল্পক্ষেত্রে যে রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে তা আজ মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানব আকৃতির পাশাপাশি রোবটে যোগ হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
অনেক পরে হলেও বাংলাদেশও গুরুত্ব দিচ্ছে রোবট ও রোবটিক্স শিক্ষার ওপর। রোবট নিয়ে বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে ‘রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে আলাদা বিভাগ। ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টেও সম্প্রতি রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য পরিবেশনের কাজে।
বুধবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আইসিটি খাতে গবেষণা খুব প্রয়োজন আর নিজের দেশে যাতে গবেষণার ব্যবস্থা করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
বাংলাদেশে রোবটিক্স শিক্ষা ও গবেষণার সামগ্রিক অবস্থাসহ এর সমস্যা সম্ভাবনা এবং সার্বিক দিক নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের তিন শিক্ষক ড. শামীম আহমেদ, ড. সুগত আহমেদ এবং অভিষেক কুমার ঘোষ; যাদের প্রত্যেকেরই এ বিষয়ের ওপর পিএইচডিসহ দেশি-বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে।
রোবট ও রোবটিক্স
রোবট একটি ইলেক্ট্রো-যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার কাজকর্ম, অবয়ব ও চলাফেরা দেখে মনে হয় এটি স্বেচ্ছায় কাজ করছে। এটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যা মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে পারে অথবা এর কাজের ধরণ দেখে মনে হবে এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে।
রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবোটা’ থেকে, যার অর্থ ফোরসড লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। অর্থাৎ যে যন্ত্র নিজে নিজে মানুষের কাজে সাহায্য করে এবং নানাবিধ কাজে মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই রোবট।
রোবটিক্স হলো প্রযুক্তির একটি শাখা যেটি রোবট সমূহের ডিজাইন, নির্মাণ, কার্যক্রম ও প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে।
বাংলাদেশে রোবটিক্স শিক্ষা
রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কমপিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর সমন্বিত রূপ। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই তিনটি বিষয়ে আলাদাভাবে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থাকলেও কেবল রোবটিক্সের ওপর কোন আলাদা বিভাগ বা কোর্স ছিল না। ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম চালু করে ‘রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে বিভাগ। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রতিব্যাচে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে বিভাগটিতে। একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দুইজন প্রভাষক নিয়ে শুরু হওয়া বিভাগটিতে এখন শিক্ষক সংখ্যা ছয় জন। শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য গড়ে উঠছে ছয়টি আলাদা ল্যাব। তবে সবগুলো ল্যাব এখনও গবেষণা বা ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য পুরোপুরি চালু হয়নি। কিছু ল্যাবের কাজ শেষ পর্যায়ে, কয়েকটিতে চলছে যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ।
এই বিভাগটি গড়ে তোলার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মানব কল্যানে রোবটের ব্যবহার ও বিস্তার যে কী পরিমান বেড়েছে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই। তাছাড়া শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন সেক্টরে বোবটের ব্যবহার বাড়লেও আমরা সেদিক থেকে পিছিয়ে ছিলাম; এ বিষয়ে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও তেমন সুযোগ ছিল না। তাই রোবটিক্স বিষয়ে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরির জন্যই মূলত বিভাগটি গড়ে তোলা হয়।
রোবটিক্স শিক্ষায় গুরুত্ব যে কারণে
বাংলাদেশ কৃষি নির্ভরতা থেকে ধীরে ধীরে শিল্প নির্ভর অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ে এখনও বিদেশি যন্ত্রপাতি এবং লোকবলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।বিশেষায়িত শিক্ষা না থাকায় দেশীয় জনবল এখনও নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ে যেতে পারছে না। কিন্তু শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদশীলতা বাড়াতে এবং এবং বৃহৎ সমৃদ্ধির জন্য রোবট এবং রোবটিক্সের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় একাডেমিক ও বিশেষায়িত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে যে চাহিদা দেশীয় জনবল দ্বারা পুরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কেমিক্যাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর পিএইচডি করা ড. শামীম আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বাংলাদেশের যেকোন ইন্ড্রাস্টি সম্পর্কে খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন ওপর থেকে যারা নিয়ন্ত্রণ করছে তারা কিন্তু সবাই বাইরের দেশের। বাংলাদেশের কিছু লোকজন অপারেটিং লেভেলে থাকলেও বেশিরভাগ লোকই মেশিন সুইচ করা বা এ জাতীয় কাজে নিয়োজিত। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রোগ্রাম তৈরি বা এ জাতীয় কাজগুলো বেশির ভাগই করে বাইরের লোকজন। আমাদের টার্গেট নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ে যাতে দেশীয় লোকবল নিয়োগ করা যায়। সে লক্ষেই আমাদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।
রোবট ব্যবহারে কী লাভ
রোবট ব্যবহারের ফলে শিল্পের উৎপাদনশীলতা এবং নির্ভুলতা কীভাবে বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে পারে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে পিএচি করা ড. সুগত আহমেদ বলেন: ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কমপিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর সমন্বিত রূপ হচ্ছে রোবটিক্স। তাই যে কাজের জন্য তিনজন ইঞ্জিনিয়ার দরকার সেখানে একজন রোবটিক্স বিশেষজ্ঞই যথেষ্ট। কারণ এই তিনটি বিষয়েই তার ধারণা রয়েছে এবং কীভাবে তার সমন্বয় করা যায় তাও সে অন্যদের থেকে ভালো বোঝে।
ড. শামীম আহমেদ বলেন: মানুষকে একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেমের মধ্যে কাজ করতে হয়। তাছাড়া শারীরিক ক্লান্তি বা অবসাদের কারণে তার কাজের গতিও সব সময়ই একই থাকে না। কিন্তু রোবটকে দিয়ে আপনি চাইলে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করাতে পারবেন। তাদের কাজের সুক্ষ্মতা ও নির্ভুলতাও শতভাগ।
তবে রোবটকে কখনই মানুষের বিকল্প মনে করেন না তারা। তাদের মতে, রোবট হচ্ছে মানুষের সহযোগী। মানুষ যে কাজগুলো করতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে রোবট দিয়েই সে কাজগুলো করানো হচ্ছে। ফলে লাভটা মানুষেরই হচ্ছে।
রোবটের ব্যবহারে মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাবে কি না?
কর্মক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার বাড়লে মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাবে কি না সে বিতর্ক চলছে শুরু থেকেই। কিন্তু শিক্ষকেরা বলছেন এটি ভুল ধারণা। রোবটের ব্যবহারে মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাবে না, বরং উৎপাদনশীলতা বাড়বে বহুগুণে।
বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অভিষেক কুমার ঘোষ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন: নব্বই দশকে যখন কৃষিক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেলে তখন এ ধরনের একটি কথা উঠলো যে মানুষের কাজকর্ম কমে যাবে কি না। কিন্তু এতবছর পরে এসে আপনি কী দেখছেন? মানুষের কর্মসংস্থান কি কমেছে? উল্টো কাজের জন্য মানুষ আরও পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু মেশিনের ব্যবহার কিন্তু বহুগুণে বেড়েছে। বেড়েছে কৃষকের উৎপাদনশীলতাও।
ড. সুগত আহমেদ বলেন: রোবটের ব্যবহারে মানুষের ভুমিকা পরিবর্তন হবে কিন্তু কর্মহীন হয়ে পড়বে না। আগে যিনি গায়ে খেটে কাজ করতেন এখন তিনি মেশিন পরিচালনার কাজে যুক্ত হবেন।
রোবট সম্পর্কে প্রচলিত মিথ
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বেশিরভাগ মনে করে রোবট মানেই মানুষের মত দেখতে অবয়ব বা মানুষের মত সাধারণ কাজকর্মে পারদর্শী। কিন্তু এটা আসলে রোবটিক্সের একটি মাত্র দিক।
অভিষেক ঘোষ বলেন: মানব আকৃতির রোবট আসলে রোবটিক্সের একটি মাত্র দিক। আরও নানা রকম রোবট রয়েছে। যেগুলোর আকৃতি মানুষের মত নয়। কাজের উপযোগি করে তাদের আকৃতি দেওয়া হয়। ফার্মাসিউটিক্যালস, টেক্সটাইল ইত্যাদি শিল্পে বিভিন্ন আকৃতির রোবট ব্যবহার করা হয়।
শিক্ষা বিস্তারে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা
বাংলাদেশে রোবটিক্স শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে থাকলেও সামনে এর অনেক সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু অন্যান্য যেকোন শিক্ষার চেয়ে এ শিক্ষায় খরচ অনেক বেশি। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কাজের জন্য একটা সাধারণ যন্ত্রের খরচও অনেক ক্ষেত্রে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা। তাই এই শিক্ষার বিস্তারে সরকারের পাশাপাশি প্রয়োজন শিল্প উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা।
ডক্টর শামীম আহমেদ বলেন: ল্যাবের জন্য সাধারণ একটা মেশিন কিনতেও অনেক অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তা সব সময় বহন করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা চাচ্ছি শিল্প উদ্যোক্তারা যাতে এ বিভাগকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে আসেন। কারণ আমাদের বিভাগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে শিল্পক্ষেত্রের সমৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করা।
যে লক্ষ্য নিয়ে রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটি গড়ে তোলা হয়েছে সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা।